গড়নে ছোটখাটো, কালো কোকড়ানো চুল, আর মুখে ঐশ্বরিক দৃঢ়তা। আজটেকা স্টেডিয়ামে লক্ষাধিক মানুষের সামনে মানুষটা ছুটছে, ছুটছে আর ছুটছে। মিডফিল্ডার গ্লেন হডলকে পেরিয়ে আরো দুই ইংরেজকে পাশ কাটিয়ে সতীর্থ ভালদানোর দিকে বল ঠেলে দিয়েই ডিবক্সের ভেতরে ঢুকে পড়লো সে। আর্জেন্টিনার নম্বর টেন, ডিয়াগো ম্যারাডোনা।
ভলদানোর পা থেকে বল পেয়ে ইংরেজ ফুটবলার হজ নিজ পেনাল্টিবক্সে বলটি উড়িয়ে দিতেই আলবেলিস্তিয়ান নম্বর টেন যা করলেন তার জন্য প্রস্তুত ছিল না রেফারি। প্রস্তুত ছিল না গোটা বিশ্ব। গোলকিপার শিলটনকে বোকা বানিয়ে বলের সাথে লাফিয়ে উঠে চোখের পলকে বাম হাতের ধাক্কায় গোওওওল! অন্তত তিউনিশিয়ান রেফারি বাজিয়েছিলেন গোলেরই বাশি। গোল নিয়ে ইংরেজদের প্রবল আপত্তি হার মেনেছিল হয়তো ঈশ্বরের বৃহৎ পরিকল্পনা আর হতে যাওয়া ফুটবল ঈশ্বর ম্যারাডোনার একাগ্রতার যোগসাজশের সামনে।
১৯৮৬ এর আর্জেন্টিনা বনাম ইংল্যান্ডের কোয়ার্টার ফাইনালের সেদিনটা ছিল এমনই পাগলাটে। অবিস্মরণীয়, অবিশ্বাস্য, অবিসংবাদিত। যার ঢেউ ছড়িয়ে যায় হাজার মাইল দূরের সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত এক দেশ বাংলাদেশে। এমন এক সময়ে যখন সেদেশে রঙ্গিন টেলিভিশনই এসেছে বেশি দূরের কথা নয়। ঝা চকচকে না হলেও হঠাৎ পাওয়া এমন বর্ণিল বিনোদনের প্রভাবটাও মনে গেঁথে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। আর এরই মধ্যে খুব শক্তভাবে যুক্ত হয় আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়- ইংল্যান্ড।
প্রায় আড়াই যুগ পেরোনো ইংরেজ কলোনিয়াল স্মৃতি তখনো দগদগে। সেই ইংল্যান্ডকে হারিয়েছে এমন এক দল যারাও চার বছর আগের যুদ্ধের ক্ষত নিয়ে ঘুরছে। ম্যাচে হারিয়েছে নিয়ম নীতির কোনো তোয়াক্কা না করে, ইংল্যান্ডের হাতে গড়া খেলায় খোদ ইংল্যান্ডকেই বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে। "আমি আপনারে ছাড়া কাহারে করি না কুর্নিশ" মন্ত্রে নিজের বিন্দুতে অটল অবিচল থেকেছে আর্জেন্টাইন এক সদ্য পঁচিশ পেরোনো যুবক- নাম যার দিয়াগো মারাদোনা। উঠে এসেছে বাঙালির কাছে "মোর দ্যান এ ফুটবলার" বিগ্রহে।
ফলে এতোকিছুর মধ্যে ঢেউ ছড়ানো বললে ভুলই হবে, এক প্রলয়ঙ্কারী জলোচ্ছ্বাস যেন আচমকা এসে পড়লো ব-দ্বীপটিতে। ফুটবলের জলোচ্ছ্বাস, ফুটবলের উচ্ছ্বাস। তবে এই উচ্ছ্বাস যে ৩৬ বছর পরেও থাকবে সমান প্রাসঙ্গিক, তা কি কেও ভেবেছিল? প্রাসঙ্গিক তো বটেই, ৩৬ বছরে বাঙালি পেলে-পুষে আরো ফাঁপিয়ে তুলেছে তার নীল-সাদা সমর্থনের উত্তরাধিকার। টানা ৮ বিশ্বকাপ হারার ক্ষত কেবল যেন বিশ্বাসকেই জোরদারই করেছে। আরো শক্তিশালী হওয়ার প্রত্যয়ে জার্সিতে দুই তারকা লোগোটা খামচে ধরে জপিয়েছে 'আই উইল বি স্ট্রংগার, আই উইল বি স্ট্রংগার, আই উইল বি স্ট্রংগার'।
তবে এই একপাক্ষিক এবং কখনো কখনো 'অতিরঞ্জিত' এই ভালোবাসা পড়েছে প্রশ্নের সম্মুখে। যে প্রশ্নটা আসা আসলে খুব স্বাভাবিকই বটে।
"এই যে এতো আর্জেন্টিনা আর্জেন্টিনা করো, তারা কি আদৌ জানে বাংলাদেশের কথা, এই পাগলামোর কথা?" বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সৈয়দ মওলা। জানালেন জীবনে বহুবার শুনেছেন এ প্রশ্ন। "এইতো কয়েকবছর আগেও শুনতাম— ম্যারাডোনাকে নাকি একবার বলা হয়েছে বাংলাদেশে তার অনেক ফ্যান, কিন্তু তিনি নাকি বাংলাদেশ নামে যে একটা দেশ আছে তা জানেনও না। বিষয়টা জানা যতটুকু না কষ্টের, তার চেয়ে বেশি হতাশার। কারণ বাংলাদেশেরই ব্রাজিল সাপোর্টাররা এটা নিয়ে ঠাট্টা করতো। অথচ একজন মানুষের পৃথিবীর সব দেশ না চেনাটা স্বাভাবিক। পৃথিবীর কজন মানুষ সবগুলো দেশের কথা জানেন? কিন্তু এখন আর এ প্রশ্ন তোলে না। কারণ বাংলাদেশে অলটাইম গ্রেট মেসির আর্জেন্টিনা ও নাইজেরিয়ার ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। তা ছাড়া সম্প্রতি আর্জেন্টিনার কাছে বাংলাদেশের আর্জেন্টাইন সাপোর্টাররা বিশেষ নজরে এসেছে। তাই এই সম্পর্কটা এখন জানাশোনার চেয়েও অনেক বেশি।"
গত তিন- চার বিশ্বকাপে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো থাকলেও, এবারই প্রথম নেট দুনিয়ায় ফুটবল বিশ্বকাপ নিয়ে এতো ঝড় বয়ে যাওয়া। যে তর্ক- বিতর্ক আগে শোভা পেত চায়ের আড্ডায়, গলির মোড়ে, অফিস জুড়ে, এই বিশ্বকাপ শুরুর দিকে তা যেন পুরোপুরি মোড় নিতে থাকে 'কী-বোর্ড' যুদ্ধের দিকেই। আশঙ্কা করা হচ্ছিল অনলাইনের এই প্রভাবের কারণে বাস্তব দুনিয়াতেই বিশ্বকাপ জ্বর না কমে যায়। ফার্মগেট মোড় থেকে হানিফ মিয়া (৫৫) নামক এক পতাকা বিক্রেতা জানায়, "আগের চাইতে আর বেচা- কেনা কম। আগে সন্ধ্যার মধ্যেই এক ব্যাগ শেষ হয়ে যাইতো। এখন তো দুইদিন লাগে। সামনে বেচা- কেনা বাড়বে আল্লাহ্ দিলে।"
হ্যাঁ দিন গড়াতেই পাল্টাতে থাকে পরিস্থিতি। বাঙালি জানান দেয়, না ফুটবল উন্মাদনা তার কমেনি, ইন্টারনেটের দুনিয়া তাতে নতুন একটি মাত্রা যোগ করেছে মাত্র। ঢাকার আকাশ সেজেছে হলুদ- সবুজ, নীল- সাদা পতাকায়, সমানতালে এগিয়েছে ঢাকার বাইরে, ২০২২ ফুট পতাকায় ছেয়েছে ফেনীর মাঠ।
তবে সব গল্পই যেন ছাপিয়ে গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মু্হসীন হলের মাঠের কাছে। একশ দুইশ নয়, সেখানে পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি দর্শক খেলা দেখেছে এক স্ক্রিনে (দৈনিক জনকণ্ঠ, ২০২২)। টিএসসি, স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্ত্বরেও বড় পর্দায় খেলা দেখানো হলেও মুহসীন হল মাঠের উন্মাদনার চিত্র দেশি এ মিডিয়া ও মিডিয়া করে ছড়িয়েছে বিশ্বাঙ্গনে। ওহ মাই গোল, ইএসপিএন থেকে শুরু করে নামকরা সব ফুটবল পেইজে ঘুরতে থাকে বাংলাদেশি ভক্তদের ছবি, ভিডিও, নানা খবরাখবর। এরই মধ্যে ২৮ নভেম্বর আর্জেন্টিনা ফুটবল এসোসিয়েশনের ফুটবল লীগ "লীগা প্রফেশনাল দে ফুটবল" মেসির হাতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা এডিট করে বসিয়ে বাংলাদেশের জনসমর্থনের প্রতি তাদের পক্ষ থেকে ভালোবাসা প্রকাশ করে। এই ধারায় যোগ দেন আর্জেন্টিনা জাতীয় ফুটবল দলের কোচ লিওনেল স্কালোনি। সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশি সমর্থনের প্রসঙ্গ আসতেই তিনি বলেন, "বছরের পর বছর ধরে সারা বিশ্বে এ উন্মাদনা ছড়িয়ে দিয়েছে, কারণ আমাদের ম্যারাডোনা ছিলেন, এখন আমাদের মেসি আছে। এটা আমাদের জন্য দারুণ আনন্দের যে বাংলাদেশে আমাদের অনেক সমর্থক রয়েছে। সেই সাথে বিশ্বের অনেক দেশেও আমাদের সমর্থন রয়েছে। ধন্যবাদ বাংলাদেশের সমর্থকদের।"
ঘটনাপ্রবাহ এখানেই শেষ হতে পারত, নিখাদ ধন্যবাদের মধ্য দিয়ে। তবে না, ১৭ হাজার মাইল দূরের একটি দেশ যে ভালোবাসা ও সমর্থন দিয়ে চলেছে তিন যুগ ধরে তার বিনিময়ে শুধু ধন্যবাদ নয়, আলবেলিস্তিয়ানদের মাথায় ঘুরছিল অন্য কিছু। সেই অন্য কিছুর হাত ধরে বুয়েন্স আয়ার্সে উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা। মেসিদের জয়ে বাংলাদেশি জনসমাগম দেখে যেমন বোঝার উপায় থাকে না বাংলাদেশ না আর্জেন্টিনা; এবার আলবেলিস্তিয়ান ভীড়ে লাল সবুজ পতাকা হাতের উচ্ছ্বাসে অবতারণা হচ্ছে একই দ্বন্দের।
আর্জেন্টিনার গলিতে বিক্রি হচ্ছে বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের জার্সি, অলি- গলিতে আঁকা হচ্ছে লাল- সবুজ পতাকা, কেউবা আবার নিজের শরীরেই খোদাই করছে বাংলাদেশি পতাকার ট্যাটু। মূলধারার পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলো গভীর ভালোবাসায় স্মরণ করছে বাংলাদেশের নাম, উদযাপন করছে বাংলাদেশের ক্রিকেট ম্যাচের জয়। কাতার স্টেডিয়ামের বাইরে আলবেলেস্তিয়ানদের কাছে বাংলাদেশের নাম নিতেই তারা ফেটে পড়ছে উচ্ছ্বাসে, শুভকামনা জানাচ্ছে বাংলাদেশ ফুটবল দলের জন্যও।
এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশের ক্রিকেটের সমর্থনে খোলা হয়েছে ফেইসবুক গ্রুপ। পাঁচদিন বয়সী যে গ্রুপের সদস্য সংখ্যা লাখ পেরিয়েছে। কেও বা ভুয়সী প্রশংসায় ভাসাচ্ছে মেহেদি হাসান মিরাজকে, কেও বা ভালোবাসা প্রকাশ করছে সাকিব আল হাসান কে ঘিরে। ভারত বাংলাদেশ ওয়ানডে ম্যাচে বাংলাদেশের জয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছে অধিনায়ক লিটন দাসকে। 'ভামোস বাংলাদেশ' সুর তুলে সমর্থন যোগাচ্ছে বাংলাদেশকে।
এমন ফিরতি ভালোবাসায় অভিভূত বাংলাদেশিরাও। তারাও সেখানে জানান দিচ্ছে নিজের অনুভূতি। একে অন্যের ভাষা শিখতে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে জানতে দুপক্ষেরই যেন আগ্রহের কমতি নেই! অনেক আর্জেন্টাইনই আগ্রহী বাংলাদেশ- আর্জেন্টিনা সম্পর্কটা শুধুমাত্র বিশ্বকাপ কেন্দ্রিক না রেখে দুদেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক আরো শক্তিশালী করতে। অনেককেই আবার দুঃখ প্রকাশ করতে দেখা গেছে বাংলাদেশে কেন আর্জেন্টিনার সরাসরি কোনো দূতাবাস নেই এই প্রসঙ্গেও।
তবে ফুটবল ক্রিকেট সবকিছু ছাপিয়ে হাজার হাজার মাইল দূরের দুই দেশের অচেনা অদেখা মানুষের মধ্যে এইযে আগাগোড়া ইতিবাচক উষ্ণতায় মোড়ানো সম্পর্ক, এটিই বোধহয় মানুষকে আরো বেশি 'মানুষ' হিসেবে বোধ করায়। শুধু জীবনের তাগিদে ছুটে জীবন যাপনের চেয়ে জীবন যে আরেকটু বেশি উদযাপনের তা বোধ করায়। বোধ করায় 'মাদার আর্থ' এর নানা মহিমায় জীবন দানের ঋণ স্বীকারের।
ফারিয়া ফাতিমা স্নেহ পড়াশোনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে।