লন্ডন, প্যারিস, বার্লিনে আতশবাজি, ইউক্রেইনে যুদ্ধ শেষ আর কোভিড-পূর্ববর্তী স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আশায় ২০২২ সালকে বিদায় জানিয়েছে এশিয়া ও ইউরোপ। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স লিখেছে, ইউক্রেইনে সংঘাত, অর্থনৈতিক চাপ ও বৈশ্বিক উষ্ণতার ভয়াবহ প্রভাব দাগ কাটলেও গেল বছর একই সঙ্গে নাটকীয় একটি ফুটবল বিশ্বকাপ, প্রযুক্তির ব্যাপক পরিবর্তন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্চ মোকাবেলায় বিশ্বের দেশগুলোর প্রচেষ্টাও দেখেছে।
ইউক্রেইনের ক্ষেত্রে যদিও সংঘাত বন্ধের কোনো সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছে না। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া প্রতিবেশী দেশটিতে সেনা পাঠানোর পর থেকে কিইভের সঙ্গে পুরো ইউরোপ এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও এই যুদ্ধে নানাভাবে জড়িয়ে পড়েছে।
শনিবারও রাশিয়া ইউক্রেইনজুড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে, ইউক্রেইনের মানবাধিকার বিষয়ক ন্যায়পাল যাকে ব্যাখ্যা করেছেন ‘নববর্ষের প্রাক্কালে সন্ত্রাস’ হিসেবে।
দেশটিতে সান্ধ্যাকালীন কারফিউ বলবৎ থাকায় বেশিরভাগ জায়গাতেই ২০২৩ সালের শুরু উদযাপন অসম্ভব ছিল। একাধিক আঞ্চলিক গভর্নর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বার্তা দিয়ে বিধিনিষেধ অমান্যের ব্যাপারে বাসিন্দাদের সতর্কও করেছেন।
মধ্যরাতের পর দেশটির প্রায় সব এলাকাতেই ফের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সতর্ক সংকেত বেজেছে।
“আমরা হাল ছাড়ছি না, তারা আমাদের উদযাপন নষ্ট করতে পারবে না,” বলেছেন স্বামীকে নিয়ে বর্ষবরণ উদযাপনের প্রস্তুতি নেওয়া ৩৬ বছর বয়সী ইয়ারিনা।
নববর্ষ উপলক্ষে দেওয়া ভিডিওবার্তায় ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, “আমি আমাদের সবার জন্য একটা জিনিসই কামনা করছি- জয়।”
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তার নববর্ষের ভাষণে জনগণকে সেনাবাহিনীল পেছনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
রেড স্কয়ারে প্রতিবারের মতো আতশবাজি না পুড়িয়ে অনেকটা চুপিসারেই নতুন বছরকে বরণ করে নিয়েছে মস্কো।
“কিছুই হচ্ছে না এমন ভান করা উচিত নয় কারোই, ইউক্রেইনে আমাদের লোকজন মরছে। ছুটি অবশ্যই উদযাপন করা যায়, তবে তারও সীমা থাকা উচিত,” বলেছেন ৬৮ বছর বয়সী ইয়েলেনা পপোভা।
তার মতো মস্কোর অনেক বাসিন্দাই ২০২৩ সালে শান্তি ফিরবে এমন প্রত্যাশা করছেন।
যুক্তরাজ্যের রাজধানীতে বর্ষবরণে আতশবাজির কমতি ছিল না, ইউক্রেইনের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে লন্ডন আই সেজেছিল নীল, হলুদে।
লন্ডনের মেয়রের মতে, ইউরোপের মধ্যে বর্ষবরণের সবচেয়ে বড় এই আয়োজনে রানি এলিজাবেথের প্রতি শ্রদ্ধা যেমন ছিল, তেমনি ছিল ইংল্যান্ড ফুটবল দলের লাল-সাদার কথা, ছিল সমকামিদের এলজিবিটিকিউর রংধনু রংও; ২০২২ সালে এলজিবিটিকিউ প্রাইড ইভেন্টের ৫০ বছর পূর্তি হয়েছে।
এথেন্সের পার্থেনন, বার্লিনের ব্রান্ডেনবার্গ গেইট আর প্যারিসের আখ দ্য খিউফেও আতশবাজির ঝলকানি দেখা গেছে, ২০১৯ সালের পর ফ্রান্সের রাজধানীতে প্রথম নববর্ষের আতশবাজি দেখতে শঁ এলিজে অ্যাভিনিউতে জড়ো হয়েছিল হাজার হাজার মানুষ।
তবে ইউরোপের অনেক এলাকার মতো চেক রিপাবলিকের রাজধানী প্রাগও অর্থনৈতিক চাপে নত হয়ে বর্ষবরণে আতশবাজির প্রদর্শনী বাদ দিয়েছে।
“এখন উৎসব উপযুক্ত নয়,” বলেছেন সিটি হলের মুখপাত্র ভিট হফম্যান।
তীব্র বৃষ্টি ও বাতাসের কারণে নেদারল্যান্ডসের বড় বড় শহরগুলোকেও আতশবাজি উৎসব বাতিল করতে হয়েছে।
যদিও ইউরোপের অনেক শহর বছরের এই সময়ে রেকর্ড উষ্ণতাও দেখেছে। তাপমাত্রা ১৭ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছায় প্রাগ ২৪৭ বছরের মধ্যে নববর্ষে প্রাক্কালে সবচেয়ে উষ্ণতম সময় দেখেছে।
ফ্রান্সও এ বছর নববর্ষের প্রাক্কালে উষ্ণতম সময় পার করেছে বলে জানিয়েছে দেশটির আবহাওয়া বিভাগ।
কোভিডের কারণে দুই বছর ব্যাহত হওয়ার পর অস্ট্রেলিয়া এবার বিধিনিষেধ মুক্তভাবে বর্ষবরণের উৎসবে মেতেছিল।
সিডনি নতুন বছরকে বরণ করে নিয়েছে মনোমুগ্ধকর আতশবাজিতে, প্রথমবার হারবার ব্রিজে দেখা গেছে রংধনুর ঝরনা।
উৎসব উদযাপনে মহামারীর কারণে যেসব বিধিনিষেধ ছিল, বিশ্বের অনেক দেশের মতো গত বছর সেগুলো তুলে নিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া, খুলে দিয়েছিল সীমান্ত, প্রত্যাহার করেছিল শারীরিক দূরত্বের বিধান।
চীনে কোভিড বিধিনিষেধ উঠেছে এই সেদিন, ডিসেম্বরে। দেশটির সরকার তাদের ‘শূন্য কোভিড’ নীতি থেকে সরে এসে একে একে সব নিষেধাজ্ঞা তোলা শুরু করার পর সংক্রমণ হু হু করে বাড়তেও শুরু করেছ, যে কারণে বর্ষবরণের সময়েও অনেকেই উৎসবের মেজাজে নেই।
“ভাইরাসের চলে যাওয়া উচিত, মরণ হওয়া উচিত। বিশ্বাসই করতে পারছি না, আমার সঙ্গে বাইরে যেতে পারবে এমন একজন স্বাস্থ্যবান বন্ধুও খুঁজে পাচ্ছি না আমি,” লিখেছেন পূর্বাঞ্চলীয় শ্যানডং প্রদেশের এক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী।
তবে তিনবছর আগে যে শহর থেকে মহামারীর যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেই উহানে নিরাপত্তারক্ষীদের ব্যাপক উপস্থিতি সত্ত্বেও হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়ে ঘড়ির কাঁটা ১২টায় আঘাত হানার সঙ্গে সঙ্গে বেলুন উড়িয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নিয়েছে।
ব্যারিকেড সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল, নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল শত শত পুলিশ। লোকজনকে জড়ো না হতে লাইডস্পিকারে বারবার অনুরোধও জানানো হচ্ছিল, তবে নতুন বছরকে বরণ করতে আসা হাজার হাজার মানুষের যেন সেদিকে ভ্রুক্ষেপই ছিল না।
সাংহাইতে নদীর পাশের ঐতিহাসিক ওয়াকওয়েতেও দেখা গেছে বিপুল ভিড়।
“সাংহাইতে বর্ষবরণ উদযাপনে চেংডু থেকে এসেছি আমরা। আমাদের কোভিড হয়ে গেছে, এ কারণে আমরা খানিকটা নিরাপদ বোধ করছি,” বলেছেন দুই বন্ধুকে নিয়ে ওয়াকওয়েতে আসা ডিজিটাল মিডিয়া নির্বাহী ২৮ বছর বয়সী দা দাই।
হংকং কয়েকদিন আগেই জনসমাবেশের ওপর থাকা বিধিনিষেধ তুলে নিয়েছিল। যে কারণে নববর্ষের আগে ভিক্টোরিয়া হারবারে কাউন্টডাউনে দেখা গেছে লাখো মানুষকে। শহরটি অনেক বছর ধরেই ঘডির কাঁটা মধ্যরাতে পৌঁছানোর ক্ষণগণনার মাধ্যমে বর্ষবরণের উৎসব করে আসছে।
তবে সামাজিক অস্থিরতার কারণে ২০১৯ সালে এই উৎসব বাতিল করা হয়েছিল, মহামারীর কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালেও শহরটিতে উৎসব উদযাপনের ধুম দেখা যায়নি।