‘এই মোম জোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে এসো না গল্প করি!’ সেই ১৯৬৩ সালের ‘দেয়া-নেয়া’, আরতি মূখার্জীর কণ্ঠ বহু বছর পেরিয়ে কানে আসে। চাঁদের আলোয় যেমন মরচে পড়ে না, গানের ক্ষেত্রেও তাই। ‘লোডশেডিং’সিনেমার আলোছায়া খেলায় সেই কিশোর দুটো মুখ মনে পড়ে যায়। দেয়ালের গায়ে তোলা ছায়াবাজি নকশা, মিষ্টি কণ্ঠে আঁচিলের গেয়ে ওঠা। ভীরু ভীরু লজ্জায় কৈশোর মোমের আলোতেই ডেকে আনে চাঁদ কিংবা চাঁদমুখ।
থেকে যায় ওল্ডস্কুলের ‘চাঁদমামা আজ বড্ড একা, বড় হয়েছি আমি’র মতো গানও। তবে বড় আমরা হয়েছি ঠিকই। আর বড় হয়েছি বলেই হয়তো শৈশবে যে চাঁদকে ছড়া কেটে মামা বলে ডেকেছি, যৌবনে কোন এক জাদুর ছলে সে যেন হয়ে ওঠে প্রেয়সীর মুখ। কখনো প্রেমের স্মৃতিতে মধুর কোনো ফোঁড়ন। কৃষ্ণপক্ষের ইতি টেনে শুক্লপক্ষ শুরু হয়, আকাশে রূপোর থালার মতো চাঁদ ধরা দেয় এই ধরাধামে। আর সেই ধরা দেয়াকে বাংলা গানে গানে ধরে রাখা হয় অডিও ক্যাসেটের ফিতেয়, হাল আমলের প্লেলিস্টেও।
‘ঘুম ঘুম চাঁদ, ঝিকিমিকি তারা– এই মাধবী রাত, আসেনি তো কভু আর, জীবনে আমার!’ সেই কবেকার মহানায়িকার ঠোঁটে ঠোঁট মেলানো আর পর্দার পেছনে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ‘হারানো দিনের গান’, আসলেও কি হারায়? চাঁদের আপ্যায়নে, অতিথিরূপে তার আবির্ভাবে আজো যেন উঠোন বিছিয়ে বসে প্রেমিকমন। মদিরতা ঢেলে দেয় কণ্ঠে, আঁখিতে করে সুধাপান। মন ভুলে চাঁদ বেশি রূপসী, নাকি তার প্রেয়সী– সে ভাবনাও ভাবতে বসেছে। কখনো চাঁদকেই হয়তো করে নিয়েছে তার প্রেমালাপনের মাধ্যম– ‘আমি চাঁদকে বলেছি, আলো দিও আমার প্রিয়ার ঘরে।’ চাঁদ সেকথা মনে রাখে কি রাখে না, জানা হয় না। শুধু শ্রোতামন আকুলি-বিকুলি করে ভাবে– ‘সে যেন জাগে না রাত একেলা আঁধারে।’
সাহিত্যের এক পশলা বৃষ্টি মাখিয়ে হুমায়ূন চলে গিয়েছেন কতদিনই তো হলো। এখনো জোছনার ফিনিক ফুটলে হয়তো কেউ ডুকরে কাঁদে, ‘চান্নি পসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়!’ ফেলে আসা অতীতেরা এক এক করে কড়া নাড়ে, জানান দেয় নিজেদের থেকে যাওয়ার। চেনা চেনা লাগে তবু অচেনা এমন সব আগন্তুক স্মৃতিদের দেখে মনে হয়– ‘চাঁদনী পসরে কে আমারে স্মরণ করে, কে আইসা দাঁড়াইসে গো আমার দুয়ারে?’
যে ‘জোছনারাতে সবাই গেছে বনে’, ‘চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে’– যে ‘রাতে রাত ছিল পূর্ণিমা’, সে রাতের আলাপ বোধহয় আমাদের সকলেরই। উদাসী মন ধেয়ে যায় যেসব ‘পূর্ণিমাসন্ধ্যায়’, কারো কারো রজনীগন্ধায়, সেই চাঁদের আলোও সকলের। এমনই নিজের করে নিয়ে কেউ গান লিখেছেন, তো কেউ আপন করে সুর বেঁধে দিয়েছেন। সে সুর বেঁধে দেয় এমন কোনো সেতু, মর্ত্যবাসীরা জোছনাস্নান করে নেয় জোছনাসঙ্গীতের জাদুতে– বহমান বন্দনায়, ‘ওগো মায়াভরা চাঁদ আর, ওগো মায়াবিনী রাত’।
অনিন্দিতা চৌধুরী বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে অধ্যয়নরত। [email protected]