সাতচল্লিশ বছর আগে কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যার দিনটি শোক আর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছে বাংলাদেশ।
বৃহস্পতিবার সকালে ধানমণ্ডিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে এবং বনানীতে জাতীয় চার নেতার তিনজন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আরেক জাতীয় নেতা এএইচএম কামারুজ্জামানের সমাধি রয়েছে রাজশাহীতে। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ৩ নভেম্বর তার ঘনিষ্ঠ এই চার সহকর্মীকে কারাগারে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে ৩ নভেম্বর কলঙ্কময় ও বেদনাবিধুর একটি দিন। রাষ্ট্রের হেফাজতে জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যার দিনটি ‘জেল হত্যা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
দিনটি উপলক্ষে বৃহস্পতিবার সূর্য উদয় ক্ষণে বঙ্গবন্ধু ভবন এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারা দেশে সংগঠনের সকল স্তরের কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিত করা হয়। উত্তোলন করা হবে কালো পতাকা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকাল ৭টায় ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
প্রথমে সরকারপ্রধান হিসেবে একা, পরে আওয়ামী লীগ সভাপতি হিসেবে দলীয় নেতাদের নিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন শেখ হাসিনা। সেখানে তিনি কিছুসময় নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন এবং দোয়া ও মোনাজাতে অংশ নেন।
ধানমণ্ডি থেকে বনানী কবরস্থানে যান প্রধানমন্ত্রী। ১৫ অগাস্ট নির্মম হত্য্যার শিকার বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য এবং ৩ নভেম্বর কারাগারে নিহত জাতীয় নেতাদের সমাধিতে শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি ফুলের পাপাড়ি ছড়িয়ে দেন এবং মোনাজাতে অংশ নেন।
প্রধানমন্ত্রী বনানী থেকে চলে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ও বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে ফুলেল শ্রদ্ধা জানানো হয় জাতীয় নেতাদের স্মৃতির প্রতি।
একই সময়ে রাজশাহীতে এ এইচ এম কামরুজ্জামানের কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
বনানীতে শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, আব্দুর রাজ্জাক, জাহাঙ্গীর কবির নানক, শাজাহান খান, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবু-উল আলম হানিফ, হাছান মাহমুদ, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, কেন্দ্রীয় সদস্য আব্দুল আওয়াল শামীম, পারভীন জামান কল্পনাসহ কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে ধানমণ্ডিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, “পনেরই আগস্ট একটা পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়াই ছিল তাদের লক্ষ্য এবং তেশরা নভেম্বর জেলের অভ্যন্তরে যে হত্যাকাণ্ড, সেটা আসলে ১৫ অগাস্টের হত্যাকাণ্ডের ধারাবাহিকতা, একই সূত্রে গাঁথা। তেশরা নভেম্বর আমাদের জাতীয় চার নেতা, তাদের নিষ্ঠুরভাবে কারা অভ্যন্তরে হত্যা করা হয়। এই হত্যার রাজনীতির ধারায় ২০০৪ সালের একুশে অগাস্ট হত্যাকাণ্ড।”
কাদের বলেন, “আসলেই বাংলাদেশে হত্যার রাজনীতির হোতা বিএনপি। বঙ্গবন্ধু হত্যা, জেল হত্যা ও ২১ অগাস্ট হত্যাকাণ্ড তাদেরই কাজ।"
হত্যার রাজনীতি চিরতরে বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, “আজকের দিনে রাজনীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দিতে হলে এবং মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের পথে আমরা আমাদের যে চেতনাকে লালন করি, সেজন্য চিরতরে হত্যা ষড়যন্ত্রের রাজনীতি বন্ধ করতে হবে।"
জেলহত্যা দিবসকে জাতীয় শোক দিবস ঘোষণার যে দাবি তাজউদ্দীন আহমদের ছেলে সোহেল তাজ করেছেন, তা নিয়ে সরকার ভাবছে কি না– এমন প্রশ্নে ওবায়দুল কাদের বলেন, “সে দাবি করতেই পারে। এটা সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তের বিষয়। আসলে আমাদের এত দিবস... আমি কেনো মন্তব্য করতে চাই না। কিন্তু বাস্তবে সিদ্ধান্ত নেবে সরকারে উচ্চ পর্যায়।"
যেখানে চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছিল, ঢাকার সেই পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগারে এখন গড়ে তোলা হয়েছে জাদুঘর। সকালে সেখানে বঙ্গবন্ধু ও চার নেতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।
বিকাল ৩টায় রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভা হবে। সেখানে সভাপতিত্ব করবেন দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগের সকল সাংগঠনিক জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন শাখা এবং সকল সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী, সমর্থক এবং সর্বস্তরের জনগণকে ৩ নভেম্বর যথাযথ মর্যাদা ও শোকাবহ পরিবেশে স্বাস্থ্যবিধি মেনে জেলহত্যা দিবস পালনের আহবান জানিয়েছেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
নৃশংস সেই হত্যাকাণ্ড
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার উৎখাতকারী সেনাসমর্থিত চক্রান্তকারীরাই কারাগারে চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করেছিল। কারাগারের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকা অবস্থায় এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ইতিহাসে বিরল।
তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর তার ঘনিষ্ঠ চার নেতাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। পরবর্তী অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ক্যু-পাল্টা ক্যু'র ধূম্রজালের মধ্যে ৩ নভেম্বর সংঘটিত হয় জেল হত্যাকাণ্ড।
জেলহত্যার পর ২১ বছর এ হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ রাখা হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে জেলহত্যা মামলা পুনরুজ্জীবিত করে।
১৯৯৮ সালের ১৫ অক্টোবর এ মামলায় আসামি সৈয়দ ফারুক রহমানসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। তারপর বিচারিক আদালতে রায় হয়।
তবে শুধু সেনাসদস্য মোসলেউদ্দিনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে ২০০৮ সালের ২৮ আগস্ট হাই কোর্ট আপিলের রায় দেয়। ওই রায়ে নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অন্য দুই আসামি মারফত আলী এবং আবুল হোসেন মৃধাকে খালাস দেওয়া হয়।
নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা, একেএম মহিউদ্দিন আহাম্মদকেও খালাস দেওয়া হয়।
হত্যাকাণ্ডের সুদীর্ঘ ২৯ বছর পর এর বিচারের রায় হলেও জাতীয় চার নেতার পরিবারের সদস্যরা এ রায়কে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও প্রহসনের রায়’ আখ্যায়িত করে তা প্রত্যাখ্যান করেন। তাদের অভিযোগ, জেলহত্যার ষড়যন্ত্রের দায়ে কাউকে শাস্তি দেওয়া হয়নি।
আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ২০০৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর হাই কোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের আবেদন (লিভ টু আপিল) করা হয়।
২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চ হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল আবেদন মঞ্জুর করে।
কারাগারে জাতীয় চার নেতা হত্যামামলায় হাই কোর্টের রায়ে বাদ পড়লেও ২০১৩ সালের ৩০ এপ্রিল আপিল বিভাগ দফাদার মারফত আলী শাহ ও এল ডি দফাদার আবুল হাসেম মৃধার মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে রায় দেয়।
কাকতালীয়ভাবে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবসে এই চার নেতা হত্যা মামলার চূড়ান্ত আইনি লড়াইয়ের শুনানি শেষ হয়। ১৯৭১ সালের ওই দিনে এই চার নেতার নেতৃত্বে কুষ্টিয়ার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে শপথ নিয়েছিল স্বাধীন বাংলার প্রথম সরকার।