নয়া পল্টনে সংঘর্ষের মামলায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসসহ দলটির ২২৪ নেতাকর্মীর জামিন আবারও নাকচ করে দিয়েছে ঢাকার হাকিম আদালত।
তাদের ‘বিশেষ’ জামিনে আবেদনের শুনানি শেষে ঢাকার মহানগর হাকিম শফিউদ্দিন সোমবার এ আদেশ দেন।
বিএনপি নেতাদের পক্ষে তাদের আইনজীবীরা রোববার ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালতে জামিনের জন্য এ আবেদন করেছিলেন। বিচারক রেজাউল করিম তখন শুনানির জন্য সোমবার দিন ঠিক করে দিয়েছিলেন। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
মির্জা ফখরুলের পক্ষে আইনজীবী সৈয়দ জয়নুল আবেদীন মেজবাহ এবং মির্জা আব্বাসের পক্ষে মহিউদ্দিন চৌধুরী জামিনের আবেদন করেন। সোমবার শুনানি করেন মাসুদ আহমেদ তালুকদার, বোরহানউদ্দিন সহ বেশ কয়েকজন আইনজীবী। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে আবদুল্লাহ আবু জামিন আবেদনের বিরোধিতা করে বক্তব্য দেন।
এদিন যে ২২৪ নেতাকর্মীর জামিন শুনানি হল, তাদের মধ্যে ফখরুল ও আব্বাসকে গ্রেপ্তার করা হয় গত শুক্রবার ভোরে; জামিন আবেদন নাকচ করে সেদিন সন্ধ্যায় তাদের কারাগারে পাঠানো হয়।
বাকিদের গ্রেপ্তার করা হয় বুধবার সন্ধ্যায়, নয়া পল্টনে বিএনপি অফিসের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের পর। বৃহস্পতিবার তাদের জামিন নাকচ করে কারাগারে পাঠায় আদালত।
জামিন নামঞ্জুরের সাত দিনের মধ্যে পুনরায় জামিন চাইতে গেলে বিশেষ আবেদন (স্পেশাল পুট আপ) করতে হয়। সে কারণে রোববার নতুন করে ‘বিশেষ আবেদন’ করেন বিএনপি নেতাদের আইনজীবীরা। কিন্তু ফল সেই একই।
শুনানিতে যা হল
আসামিদের মধ্যে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা, একজন আইনজীবী, একজন শিক্ষানবীশ আইনজীবী, চার নারী বিএনপি কর্মীসহ ২২৪ জনের পক্ষে জামিন চাওয়া হয়। এজলাস ও বারান্দা মিলিয়ে বিএনপিপন্থি আইনজীবী ছিলেন অন্তত তিনশ জন। আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ১৫ জনের মত।
শুনানির আগে এজলাসের মধ্যেই বিএনপিপন্থি কনিষ্ঠ আইনজীবীদের কয়েকজনের মোবাইল ফোনে সেলফি ছবি তোলার হিড়িক চলে। জ্যেষ্ঠ কয়েকজন তাদের থামাতে গিয়েও ব্যর্থ হন।
তুমুল হৈ চৈ আর হট্টগোলের মধ্যে শুনানিতে মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, “মির্জা ফখরুল ও আব্বাসের নাম এজাহারে নেই। এজহারভুক্ত দুই আসামি জামিনে রয়েছেন। সহ আসামিদের শর্তে তারা জামিন পেতে পারেন। বিজয়ের মাস ডিসেম্বর চলছে। তারা মুক্তি পেয়ে শহীদদের সম্মান জানাবেন।”
বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব খায়রুল কবির খোকনের এবং ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক আবদুস সালামের পক্ষে জামিন চেয়ে এ আইনজীবী বলেন, “খোকন অসুস্থ; আর সালাম একজন আইনজীবী এবং মুক্তিযোদ্ধা।”
কারাগারে থাকা অন্য আসামিদের রাজনৈতিক পরিচয়, তাদের পদমর্যাদা, তাদের বিভিন্ন কাজ আদালতের সামনে তুলে ধরেন মাসুদ আহমেদ তালুকদার।
এ সময় বিভিন্ন আসামির জন্য বিভিন্ন আইনজীবী শুনানি করতে গেলে এজলাসে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। মাসুদ আহমেদ তালুকদার সবার পক্ষে নিজেই শুনানি করে দিচ্ছেন বলার পর অন্য আইনজীবীরা শান্ত হন।
পরে এজাহারের বক্তব্য খণ্ডন করে বক্তব্য দেন মাসুদ আহমেদ তালুকদার। তিনি বলেন, “মামলার প্রকৃত ঘটনার সঙ্গে দণ্ডবিধি ও বিস্ফোরক আইনের সংশ্লিষ্ট ধারার সম্পৃক্ততা।
পাওয়া যায় না। একজন সাংবাদিক বিস্ফোরকের ভিডিও ধারন করেন। সেখানে দেখা যায় পুলিশ নিজেরাই ওই বিস্ফোরক বিএনপি কার্যালয়ে এনে রেখে যায় । সে কারণে মামলার ঘটনাটি বানানো। বিএনপির সমাবেশ বানচাল করার জন্য এই মিথ্যা মামলা।”
আবদুল্লাহ, কে এম সাজ্জাদুল হক শিহাব, আজাদ রহমানসহ কয়েকজন আইনজীবী।
দুপুর আড়াইটা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত এ শুনানি চলে। শুনানি শেষে জামিন নাকচ হয়ে গেলে মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত প্রাঙ্গণে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা মিছিল করেন।
কী অভিযোগ
বিএনপির ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ ঘিরে গত কিছুদিন ধরেই উত্তেজনা চলছে দেশের রাজনীতিতে। নয়া পল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে এই সমাবেশ করতে চেয়েছিল বিএনপি। কিন্তু পুলিশ তাদের অনুমতি দিয়েছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ব্যবহারের। এ নিয়ে অনড় অবস্থানে ছিল দুই পক্ষ।
এর মধ্যে গত বুধবার বিএনপি কর্মীরা নয়া পল্টনে জড়ো হলে পুলিশের সাথে তাদের সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষের মধ্যে আহত স্বেচ্ছাসেবক দলের এক ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতার মৃত্যু হয় হাসপাতালে।
এরপর বিএনপি অফিসে অভিযান চালিয়ে হাতবোমা পাওয়ার কথা বলা হয় পুলিশের তরফ থেকে। গ্রেপ্তার করা হয় প্রায় পাঁচশ নেতাকর্মীকে।
ওই ঘটনায় মোট চারটি মামলা করে পিুলিশ। এর মধ্যে পল্টন থানার মামলায় ৪৭৩ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় আরও দেড় থেকে দুই হাজার লোককে সেখানে আসামি করা হয়।
এজাহারে বলা হয়, ১০ ডিসেম্বরের দলীয় সমাবেশকে কেন্দ্র করে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা বুধবার নয়া পল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। এ সময় পুলিশ তাদের উঠে যেতে বললে তারা পুলিশের উপর হামলা চালায়।
একই সময় বিএনপি নেতাকর্মীরা ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় এবং ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে জানিয়ে এজাহারে বলা হয়, তাতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হন। একপর্যায়ে পুলিশ রাবার বুলেট, কাঁদানো গ্যাস ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে।
বিস্ফোরণ, জনসাধারণ ও যানবাহনে চলাচলে বাধা, যানবাহনের ক্ষতি সাধন, জনমনে আতঙ্ক ও ত্রাস সৃষ্টি, পুলিশের কাজে বাধা ও হত্যার উদ্দেশ্যে হামলার অভিযোগ আনা হয় মামলার এজাহারে।
আসামিদের মধ্যে ১৪ জনকে বৃহস্পতিবার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুই দিনের রিমান্ডে পাঠায় আদালত। বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী, আবদুস ছালাম, শহিদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, ফজলুল হক মিলন, খাইরুল কবীর খোকন, শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, সেলিম রেজা হাবিবসহ ৪৩৪ জনকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন বিচারক।
এরপর বৃহস্পতিবার শেষ রাতে মির্জা ফখরুল ও মির্জা আব্বাসকে তাদের বাসা থেকে আটক করে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যায় পুলিশ। দীর্ঘ সময় তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করার পর ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ শুক্রবার দুপুরে তাদের গ্রেপ্তার করার কথা জানান।
পল্টন থানার মামলায় তাদের গ্রেপ্তার দেখানোর কথা জানিয়ে হারুন সাংবাদিকদের বলেন, “তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগটা হল, তারা পুলিশের ওপর বর্বোরিচত হামলায়, ককটেল নিক্ষেপের উসকানিদাতা, পরিকল্পনাকারী ও নির্দেশদাতা। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে আমরা এটা পেয়েছি।”
সেদিন বিকালে মির্জা ফখরুল ও মির্জা আব্বাসকে আদালতে হাজির করে মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক তরিকুল ইসলাম।
শুনানি শেষে ঢাকার মহানগর হাকিম মোহাম্মদ জসিম দুজনের জামিন আবেদন নাকচ করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
এদিকে অনেক টানাপড়েন শেষে শুক্রবার বিকালে বিএনপিকে তাদের ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশের জন্য যাত্রাবাড়ীর গোলাপবাগ মাঠ ব্যবহারের অনুমতি দেয় পুলিশ। উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা থাকলেও শেষ পর্যন্ত শনিবার শান্তিপূর্ণভাবেই শেষ হয় সেই সমাবেশ। নেতাদের মুক্তিসহ ১০ দফা দাবি ও বিক্ষোভের নতুন কর্মসূচি দিয়ে বাড়ি ফিরে যান বিএনপি নেতা-কর্মীরা।