নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের শ্রদ্ধা, ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে চির নিদ্রায় শায়িত হলেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আকবর আলি খান, যিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্বও পালন করে গেছেন।
শুক্রবার বেলা সোয়া ৩টার দিকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
এর আগে জুমার নামাজের পর গুলশান সেন্ট্রাল মসজিদে তার জানাজা পড়ান মসজিদের খতিব ও যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসার মাওলানা মো. মাহমুদুল হাসান। বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতিতে খোলা মাঠেও স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় গুলশানের প্রধান সড়কে দাঁড়িয়েও জানাজায় অংশ নেন অনেকে।
জানাজার পর ঈদগাহ মাঠে আনা হয় জাতীয় পাতাকায় মোড়ানো আকবর আলি খানের মরদেহ। সেখানে প্রথমে ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এরপর ঢাকা জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এলএ) কাজী হাফিজুল আমিনের নেতৃত্বে সশ্রদ্ধ সালাম প্রদর্শন করা হয়।
রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের এসআই আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে পুলিশের সশস্ত্র একটি চৌকস দল গার্ড অব অনার দেয়। এ সময় এ বীর মুক্তিযোদ্ধাকে শ্রদ্ধা জানাতে এক মিনিট নীরবতা পালন করে সশস্ত্র দলটি। বিউগলের করুণ সুর হাজারো মানুষের মাঝে ছড়িয়ে যায়।
এর আগে সকালে এভারকেয়ার হাসপাতাল থেকে আকবর আলি খানের মরদেহ শেষবারের মত তার গুলশানের বাসায় নেওয়া হয়। সেখানে শ্রদ্ধা জানাতে যান সাবেক সচিব আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী, দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান, ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক মামুন রশীদসহ বিভিন্ন পেশার প্রতিনিধিরা।
আকবর আলি খানের জন্ম ১৯৪৪ সালে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতক করার পর তিনি কানাডার কুইন্স ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতি পড়েছেন। একই বিষয়ে পিএইচডিও করেছেন।
পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। অবসর নেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে। অর্থ সচিব আর এনবিআরের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও তিনি পালন করেন।
২০০৬ সালে ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হয়েছিলেন আকবর আলি। পরে নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে তিনিসহ চার উপদেষ্টা পদত্যাগ করেন।
উপদেষ্টা হিসেবে পদত্যাগের এক বছর পর ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আকবর আলি রেগুলেটরি রিফর্মস কমিশনের (আরআরসি) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।
সাবেক এই সরকারি কর্মকর্তা পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে কর্মরত থাকা অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি ছিলেন হবিগঞ্জের মহুকুমা প্রশাসক (এসডিও)।
তিনি মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে কাজ করেন। কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত থাকায় পাকিস্তান সরকার তার অনুপস্থিতিতে তাকে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়।
দেশ স্বাধীন হলে আবার সরকারি চাকরিতে যোগ দেন আকবার আলি। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে অবসর নেওয়ার পর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন।
একই সঙ্গে তিনি লেখালেখি করেছেন। অর্থনীতি, সমাজ ও স্মৃতিচারণমূলক বই লিখেছেন। পত্রপত্রিকায় নিয়মিত রাজনীতি ও আর্থ সামাজিক অবস্থা নিয়ে কলাম লিখেছেন।
আকবর আলি খানের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১৭টি। এরমধ্যে অর্থনীতি বিষয়ে তার দুটি বই ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’ এবং ‘আজব ও জবর-আজব অর্থনীতি’ পাঠকপ্রিয় হয়েছে।
অর্থনীতির বাইরে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময়ের এবং সরকারি চাকরির অভিজ্ঞতা নিয়ে স্মৃতিচারণমূলক বই লিখেছেন।
জীবনানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, বাংলায় ইসলাম প্রচার নিয়েও লিখেছেন। 'পুরানো সেই দিনের কথা' তার সবশেষ আত্মজীবনী গ্রন্থ।
তার অন্যান্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে 'ডিসকভারি অব বাংলাদেশ', 'দারিদ্র্যের অর্থনীতি: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ', 'অবাক বাংলাদেশ: বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি', 'চাবিকাঠির খোঁজে: নতুন আলোকে জীবনানন্দের বনলতা সেন', 'দুর্ভাবনা ও ভাবনা: রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে', 'বাংলায় ইসলাম প্রচারে সাফল্য: একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ', 'ফ্রেন্ডলি ফায়ারস', 'হাম্পটি ডাম্পটি ডিসঅর্ডার অ্যান্ড আদার এসেস' ও 'গ্রেশাম'স ল সিন্ড্রম অ্যান্ড বিয়ন্ড'।