গল্পে গল্পে ইতিহাস জানান তারা


মাহমুদ নেওয়াজ জয় | Published: February 13, 2023 14:04:22 | Updated: February 13, 2023 21:08:18


ইতিহাসের চমকপ্রদ সব ঘটনা গল্পের মতো করে বলছে এই পেজ, ছবি: ' ইতিহাসের গল্প' পেজের সৌজন্যে

একজন প্রকৌশল শাস্ত্রে স্নাতক, অপরজন স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি করেছেন প্রত্নতত্ত্বে। কিন্তু দুজনেই হঠাৎ à¦†à¦—্রহী হয়ে উঠলেন ইতিহাস বিষয়ে। প্রকৌশল শাস্ত্রে পড়া ছেলেটির ছিল à¦›à§‹à¦Ÿà¦¬à§‡à¦²à¦¾ থেকেই প্রচুর বই পড়ার অভ্যাস, তারপর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতে জড়িয়ে পড়লেন বিজ্ঞান বিষয়ক এক পত্রিকার সাথে। সেখানে বিভাগীয় ও পরবর্তীতে সহ-সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন। সেখান থেকে পরবর্তীতে তার আগ্রহের জায়গা হয়ে উঠলো প্রধানত ইতিহাস৷ আর তা থেকেই পরবর্তীতে শুরু হলো ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল৷ নাম - 'ইতিহাসের গল্প।

প্রকৌশলে স্নাতক à¦¸à§‡à¦‡ তরুণের নাম মুহাইমিনুল ইসলাম অন্তিক। ছিলেন খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থী। ছোটবেলা থেকেই বাবার চাকরির সূত্রে থাকতে হয়েছে দেশের বিভিন্ন জেলায়৷ পৈতৃক নিবাস ময়মনসিংহে হলেও এসএসসি ও এইচএসসি পাশ করেন ফরিদপুর থেকে। বাবা বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক হওয়ায় à¦¶à§ˆà¦¶à¦¬à¦•à¦¾à¦² à¦¥à§‡à¦•à§‡ à¦¬à¦¿à¦­à¦¿à¦¨à§à¦¨ বই পড়তেন তিনি। 

বিশ্ববিদ্যালয় পড়াকালীন সময়ে à¦«à§‡à¦‡à¦¸à¦¬à§à¦•à§‡ নিজের টাইমলাইনে শেয়ার করতেন ইতিহাস বিষয়ক বিভিন্ন পোস্ট। ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে তার পরিচয় হয় ড. আদনান আরিফ সালিমের সাথে৷ ড. সালিম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। বর্তমানে নিয়োজিত আছেন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে। 

সে সময় থেকে অন্তিক যুক্ত হয়েছিলেন রোর বাংলার সাথে। তিনি  à¦¨à¦¿à¦œà§‡à¦“ ঐতিহাসিক বিভিন্ন ব্যাপার নিয়ে লিখেছেন ৷ 

তবে ইতিহাসের গল্প বলে ফেইসবুক পেইজটি শুরু করার চিন্তা তিনি ও ড. সালিম করেছিলেন ২০১৯ এর শেষদিক থেকেই। ২০২০ সালের জুন মাসে ফেইসবুকে তারা পেইজ খোলেন 'ইতিহাসের গল্প' নামে। 

অন্তিক ভেবেছিলেন, বর্তমান যুগে অনেকেই বড় নিবন্ধ বা ফিচার পড়ে দেখার মতো সময় পায় না। তাই ইতিহাস বিষয়ে চমকপ্রদ ও অভিনব তথ্যগুলো অল্পকথায় গল্পের মতো করে উপস্থাপন করলে মানুষ জানতে আগ্রহী হবে। 

(বাম থেকে) মুহাইমিনুল ইসলাম অন্তিক ও ড. আদনান আরিফ সালিম। ছবি কৃতজ্ঞতা: মুহাইমিনুল ইসলাম অন্তিক

অন্তিক বলছিলেন, "বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হয়েও ইতিহাস নিয়ে আমার আগ্রহের কারণ মূলত শেকড়ের অনুসন্ধান। আমরা কোথা থেকে এলাম, বিভিন্ন সভ্যতা কীভাবে গড়ে উঠলো, আমাদের অতীত অবস্থা সম্পর্কে জানা- এসব কিছু আমাদের নিজেদের পরিচয় খুঁজে পেতে সহায়তা করে। তাই বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী থেকে ইতিহাসের দিকেই আগ্রহী হয়ে উঠলাম। নৃবিজ্ঞান-সম্পর্কিত ব্যাপারগুলো আমাকে খুব আকর্ষণ করতো।

ইতিহাসের গল্প পেজটি শুরু হয় ২০২০ এর জুন মাসে। তখন কোভিড সংক্রমণে অনেক কিছুই স্থবির হয়ে আছে। অফিসের কাজও কর‍তে হতো বাসা থেকেই। সে সময় অন্তিক ও ড. সালিম ভাবেন ছোট ছোট পোস্ট ও সাথে প্রাসঙ্গিক একটি ছবি দিয়ে ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয়কে সহজ করে গল্পের মতো করে বলবেন। সে সময় তারা ছাড়াও পেইজে পোস্ট করা, ছবি সংগ্রহের কাজে আরো কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক ছিলেন। 

তবে অন্তিক ভাবছিলেন বিষয়গুলো কীভাবে আরো বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে সহজে নিয়ে যাওয়া যায়। তাই চিন্তা-ভাবনা করেন ভিজুয়াল à¦®à¦¾à¦§à§à¦¯à¦®à§‡ যাওয়ার, অর্থাৎ à¦­à¦¿à¦¡à¦¿à¦“ তৈরি করার। ২০২১ এর জুন থেকে ইউটিউবেও চ্যানেল হিসেবে এসেছে ইতিহাসের গল্প।

শুরুটা হয়েছিলো অ্যান্টিভাইরাস ম্যাকাফির প্রতিষ্ঠাতা জন ম্যাকাফির জীবনীমূলক ভিডিও তৈরি করে। এরপর প্রাচীন বিভিন্ন সভ্যতা, সাম্রাজ্য, যুদ্ধ-বিগ্রহ, সাম্প্রতিক বিশ্ব, বিজ্ঞানের ক্রমবিবর্তন ইত্যাদি নিয়ে ভিডিও এসেছে তাদের চ্যানেলে। 

অন্তিক বলছিলেন, "এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে à¦®à¦¾à¦¨à§à¦· à¦­à¦¿à¦¡à¦¿à¦“, টিকটক, রিল ইত্যাদি দেখছে। আমরা চেয়েছি এই সময়টায় তারা চিন্তার উদ্রেক করার বা জানার মতো কিছু দেখুক। সেজন্য আমরা ভিডিওগুলো বেশি দীর্ঘ করি না। সাধারণত সাত-আট মিনিটের হয়। তবে সম্প্রতি সপ্তম শ্রেণির সামাজিক ইতিহাস বিষয়ক পাঠ্যবই নিয়ে আমরা ২৭ মিনিটের একটা ভিডিও করেছিলাম।

তিনি যোগ করলেন, "শুরুর দিকে ভিডিও তৈরির জন্য সবকিছু মানে স্ক্রিপ্ট, ভয়েস ওভার, ভিজুয়াল, এডিটিং- আমি করতাম। শুরুতে ভিডিওর সম্পাদনার কাজ করতাম উইন্ডোজ মুভি মেকার দিয়ে। পরে অর্ণব ভাই (ড. সালিমের ডাক নাম) স্ক্রিপ্টের দিকটা দেখতে শুরু করেন। ভয়েস ও এডিটিং আমি করি। তবে আমরা শুধু দুজনই এক্ষেত্রে কাজ করেছি, এমন নয়। আমাদের সাথে ১২-১৩ জনের একটি স্বেচ্ছাসেবী দল আছে। এর সমন্বয়ক হিসেবে আছেন আহমেদ এসসৈকত। তিনি ও গ্রুপের অন্যান্যরা সারাদেশের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে সেসব জায়গার তথ্য ও ছবি আমাদের দেন। যেমন- ফরিদপুর জাদুঘর, নাটোরের বাওড়া মসজিদ, রাজশাহীর বিভিন্ন নিদর্শন, লালবাগ কেল্লা, মোহাম্মদপুরের সাত গম্বুজ মসজিদ,  বগুড়া, রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ, দিনাজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঝিনাইদহের বারোবাজার এবং বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোয় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ইতিহাসের নিদর্শন- এমন বিভিন্ন জায়গার ভিডিও, ছবি ও প্রাসঙ্গিক তথ্য এই টিম সংগ্রহ করেছে।

এর পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে যারা উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে গিয়েছেন, তারাও বিভিন্ন প্রত্নস্থল  ও ঐতিহাসিক স্থাপনার ভিডিও ক্লিপের পাশাপাশি ছবি তুলে তাদের পাঠাচ্ছেন।

যেসব যায়গায় যাওয়া সম্ভব নয়, সেসব জায়গার ছবি হিসেবে পিক্সেল, পিক্সাবের মতো জায়গাগুলো থেকে কপিরাইট মুক্ত ছবি ও ভিডিও নেয়া হয়। আবহসঙ্গীতের জন্য তারা ইউটিউবের অডিও লাইব্রেরি থেকে আবহ নেন বলে জানান অন্তিক। 


(ঘড়ির কাঁটার দিকে) মক্কা অভিমুখে চলমান হজ্ব কাফেলা, জনৈক ব্যক্তিকে পানি পান করাচ্ছেন ভিস্তিওয়ালা, ১৯৩০ এর দশকে বোম্বেতে অনুষ্ঠিত সার্কাস ও ১৮৬০ এর দশকে পূর্ববঙ্গের বেদে সম্প্রদায়, ছবি কৃতজ্ঞতা: ইতিহাসের গল্প পেজ 

অন্তিক জানান, "সায়েন্স ম্যাগাজিনগুলো যেমন 'পপ সায়েন্স'কে তুলে ধরছে, তেমনি আমরা চাই 'পপ হিস্ট্রি' কে তুলে ধরতে। অর্থাৎ, ইতিহাস কথাটা শুনলে যেন মানুষের কাঠখোট্টা কিছু মনে না হয়। আমরা একারণে চমকপ্রদ, গভীর ও ভাবনা জাগানোর মতো বিভিন্ন বিষয়গুলোর মূল কথা সহজ ভাষায় গল্প বলার মতো করে তুলে ধরছি।'' 

সে জায়গাতে ইতোমধ্যেই বেশ ভালো সাড়া পেয়েছেন তারা। তাদের ফেইসবুক পেইজে বর্তমানে আছে ৯৫,০০০ লাইক ও ১,৭৭,০০০ জন ফলোয়ার। ইউটিউবে সাবস্ক্রাইবার হয়েছেন ১৬০০০ এর বেশি মানুষ। পেইজের পোস্টের সংখ্যা পাঁচ হাজার ছাড়িয়েছে। ইউটিউবে আছে ৯৫ টি ভিডিও।

কয়েক হাজার বছর পূর্বের প্রাক্সীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ, যুদ্ধাস্ত্র, আংটি, বিভিন্ন চমকপ্রদ মমি থেকে শুরু করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শরণার্থী, একশ বছর আগের শ্রীলঙ্কান নারী শ্রমিক কিংবা ভারতীয় নাপিত; ষাট দশকের ধানমন্ডির রাস্তা অথবা ২০০৫ সালের জাহাঙ্গীর গেট- সেই আবহমান কাল থেকে নিকট অতীত- সবই ঠাঁই পেয়েছে তাদের ফেইসবুক পেইজে। ইউটিউব ভিডিওতে এসেছে ইতিহাসের সাথে প্রাসঙ্গিক অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলিও। 

বৈচিত্র‍্যময় কনটেন্টের কারণে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন তারা। চ্যানেল 'মনেটাইজড' হয়েছে। তবে মনেটাইজেশন পেলেও এখনো অর্থ উত্তোলন শুরু করেননি তারা। কাজেই এখনো বাণিজ্যিকভাবে এটি অলাভজনক বলা চলে। তবে ভবিষ্যতে এমন ভার্চুয়াল জগতের পাশাপাশি বাস্তবেও ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা পত্র তৈরি ও সমগ্র আকারে প্রকাশের ইচ্ছা রাখেন তারা। 

অন্তিক বলেন, "আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা বইয়ের প্রায় সবই ইতিহাস বিষয়ে৷ ফিকশন পড়া হয় না বললেই চলে। বিজ্ঞানের উন্নয়ন ও ক্রমবিবর্তন সম্পর্কিত ইতিহাস, যুদ্ধ, বিভিন্ন সাম্রাজ্য ও ইসলামি বিভিন্ন বিষয়ের ইতিহাসের প্রতি বেশি আগ্রহ কাজ করে। আমরা চেষ্টা করছি  দেশের ভেতরে যেসব জায়গা নিয়ে ভিডিও করা হচ্ছে/ হবে, সেসবের ছবি ও ভিডিও আমাদের স্বেচ্ছাসেবি দলের মাধ্যমেই করতে। আর বাইরের কোনো কিছু, যেমন- কামরূপ-কামাক্ষ্যা বা এমন কোনো জায়গার ক্ষেত্রে আমরা কপিরাইট ফ্রি/সাধারণভাবে ব্যবহার করা যাবে এমন দেখে ছবি নেবো। আর মূল বিষয়, আমজনতার কাছে সহজভাবে ইতিহাসকে পৌঁছে দেয়া। কঠিনভাবে প্রচুর তথ্য ও বিশ্লেষণ না করে সহজভাবে অল্প কথায় গল্পে, ছবিতে, ভিজুয়ালে আমরা ইতিহাসকে তুলে ধরার কাজ চালিয়ে যাবো। ইতিহাস যেন মানুষের কাছে আগ্রহের ও মজার ব্যাপার বলে মনে হয় সেই ভাবনা থেকেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।"

মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে স্নাতকোত্তর করছেন। 

mahmudnewaz939@gmail.com 

Share if you like