বাংলাদেশে রাজনীতিকে যে ‘ভালো মানুষের জন্য’ আকর্ষণীয় করে তোলা যায়নি, সেই উপলব্ধির কথা জানিয়ে সেই ব্যর্থতা-দায় রাজনীতিবিদদের ওপরই দিলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
তিনি বলেছেন, “আমরা যারা রাজনীতি করি, এই ব্যর্থতাতার দায় আমাদের। এটা স্বীকার করতেই হবে।”
রোববার রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউট মিলনায়তনে জাতীয় পার্টির (জেপি) সম্মেলনে রাজনীতির মাঠে থাকা ৭০এর দশকের নেতাদের সামনে এ কথা বলেন ওবায়দুল কাদের।
তিনি বলেন, “পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশ উল্টো পথে যাত্রা শুরু করল। বিপ্লবের বিরুদ্ধে প্রতি বিপ্লব শুরু হল, গণতন্ত্র শৃঙ্খলিত হল, সঙ্গে সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক সম্পর্কে দেয়াল উঠতে শুরু করল। দেয়াল উঠছে… জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ড, একুশে অগাস্টের হত্যাকাণ্ড… দেয়াল উঁচুতে, উঁচুতে উঠতে থাকল। কিন্তু কোনো ব্রিজ তৈরি হয়নি।
“দেশে শেখ হাসিনা এক দিনে একশ সেতুর উদ্বোধন করেছেন, কিন্তু রাজনীতিতে আমরা কোনো সেতু নির্মাণ করতে পারিনি। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।”
এই আওয়ামী লীগ নেতা সেই ব্স্তবতার সঙ্গে এটাও স্বীকার করলেন: “রাজনৈতিক কর্ম সম্পর্কটা আমাদের থাকা উচিৎ ছিল। এভাবে গণতন্ত্র বাঁচতে পারে না।”
কেন এই সঙ্কট, সে বিষয়ে নিজের ধারণার কথাও বলেছেন ওবায়দুল কাদের। তার ভাষায়, গণতন্তকে বাঁচাতে হলে শক্তিশালী বিরোধী দল প্রয়োজন। আর বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে বড় দুর্বলতা সেখানেই। কারণ, দলগুলো বার বার ‘নষ্ট রাজনীতির কাছে’ আত্মসমর্পণ করেছে।
“নষ্ট রাজনীতি নষ্ট মানুষের জন্ম দেয়, নষ্ট রাজনৈতিকরা নষ্ট রাজনীতিকে বাঁচিয়ে রাখে। বাংলাদেশের অবস্থা হয়েছে ঠিক তাই। এত ডিভাইডেড, এত পোলারাইজড আমাদের রাজনীতি। এর জন্য তো মুক্তিযুদ্ধ করিনি, সেই বাংলাদেশকে কি আমরা রাখতে পেরেছি?
“আজকে রাজনীতিতে ভালো মানুষ আসতে চায় না। আমরা রাজনীতিকরা রাজনীতিকে ভালো মানুষের জন্য আকর্ষণীয় করে তুলতে পারিনি। যে কারণে আজকে ভালো মানুষ, শিক্ষত মানুষ, সৎ মানুষ, যোগ্য মানুষ রাজনীতির ধারে কাছেও নেই।”
সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ওবায়দুল কাদের হতাশার সঙ্গে বলেন, ছাত্র রাজনীতির অতীতের সুনামের ধারা ‘কোথায় যেন’ হারিয়ে গেছে।
“আজকে একই অবস্থা আমাদের ছাত্র রাজনীতিতে। ছাত্র রাজনীতি সুনামের ধারায় নেই। যে সুনামের ধারায় আমরা, এখানে যারা আছেন (৭০ এর দশকের সাবেক ছাত্রনেতা), ছাত্র রাজনীতি করেছেন, সেই ধারাটি আজ কোথায় হারিয়ে গেল।
“আমি মনে করি খারাপ লোকের হাতে রাজনীতি থাকলে দেশটা খারাপ হবে, খারাপ লোকদের হাতে রাজনীতি থাকলে খারাপ লোকরা মন্ত্রী হবে, এমপি হবে, দেশ চালাবে, এতে দেশের ভালো হবে না। ভালো লোকদের রাজনীতিতে আনতে হবে, মেধাবীদের রাজনীতিতে আনতে হবে, সৎ লোকদের রাজনীতিতে নিয়ে আসতে হবে। না হলে রাজনীতি মেধাশূন্য হয়ে যাবে। চরিত্রবানদের রাজনীতিতে নিয়ে আসতে হবে, না হলে রাজনীতি চরিত্রহীন হয়ে যাবে। এটা আমি বিশ্বাস করি মনেপ্রাণে।”
সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, “বাংলাদেশকে বাঁচাতে হলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাঁচাতে হবে। বাংলাদেশকে বাঁচাতে হলে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে বাঁচাতে হবে।”
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু অনুষ্ঠানে অভিযোগ করেন, বিএনপি বিভিন্ন ‘অপতৎপরতার মাধ্যমে বিভ্রান্তি’ সৃষ্টি করছে।
“মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে বিলুপ্ত করে বিএনপি আবার দেশকে পাকিস্তান বানাতে চায়। সংবিধান সংশোধনের নামে আবার তারা এই দেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াতে চায়।
“আজকে স্বাধীনতার স্বপক্ষে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের গণতান্ত্রিক চেতনায় এবং অসাম্প্রদায়িক শক্তি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বড় প্রয়োজন। এই ঐক্যবদ্ধ শক্তির মাধ্যমে বিগত দিনে তারা যেভাবে বার বার পরাজিত হয়েছে, আগামী দিনেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে চৌদ্দ দল এগিয়ে যাবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সবাই ঐক্যবদ্ধ চেষ্টার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতানার মূল্যবোধ অব্যহত, সুসংহত থাকবে। চলমান উন্নয়নের ধারা অব্যহত থাকবে।”
ওয়ার্কাস পাটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, “সংবিধানকে আবারও বিএনপি ক্ষতবিক্ষত করতে চায়। অরাজনৈতিক ধারা অনুসরণ করে, সংবিধানকে আবারও তারা ক্ষতবিক্ষত করতে চায়।”
জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, “বিএনপি অপরাজনীতি করা দল, তারা রাজনৈতিক বেয়াদব, তারা রাষ্ট্রকে কি মেরামত করবে? আগে তাদেরকে মেরামত করতে হবে।”
সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দীলিপ বড়ুয়া বলেন, “বিএনপি অরাজনৈতিক ধারাকে অনুসরণ করে। যারা অরাজনৈতিক ধারা অনুসরণ করে, এদেশে তাদের রাজনীতি করতে দেওয়া উচিত নয়।”
বিএনপির বিভিন্ন ‘অপতৎপরতার’ বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর পাশাপাশি নিজেদের দলের ‘ষড়যন্ত্রকারীদের’ বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য শরিকদের প্রতি আহ্বান জানান জাতীয় পার্টি (জেপি) সভাপতি আনোয়ার হোসেন মঞ্জু।
ত্রি-বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে তিনি বলেন, “আমরা যাদের প্রতিহত করতে চাচ্ছি, তাদের সন্তানরা আমাদের সকল দলের বড় বড় দলের অনেক জায়গায় বসে আছেন। আর আমরা এখানে বসে তাদের প্রতিরোধ করার কথা বলছি। এই আমাদের দ্বন্দ্ব আমাদের উদারপন্থি গণতন্ত্রে কিন্তু চলে না, কিন্তু আছে। এক দিকে আদর্শের কথা বলব, চেতনার কথা বলব, স্বাধীনতা যে কারণে অর্জন করেছিলাম সেই কথা বলব, সবই সত্য। কিন্তু আমাদের নির্ধারণ করতে হবে, অন্যদের প্রতিরোধ করতে চাচ্ছি, কিন্তু ঘরের ভিতরে যারা আছেন, তাদেরকেও প্রতিরোধ করতে হবে।”
ত্রি-বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে জেপির সভাপতি আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর সভাপতিত্বে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকী, জেপির সাধারণ সম্পাদক শেখ শহিদুল ইসলাম, গণতান্ত্রিক পাটির সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসেন, বাসদের আহ্বায়ক রেজাউর রশিদ খানসহ চৌদ্দ দলের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।