খুলনা নগরীর রূপসা বাসস্ট্যান্ড থেকে খানজাহান আলী সড়ক ধরে সামনের দিকে টুটপাড়া কবরস্থানের একটু আগে আনসার ও ভিডিপি কার্যালয়। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
‘ভূতের বাড়ি’ নামে পরিচিত এই বাড়ির দক্ষিণ দিকের দোতলা ভবনটিতে আনসার বাহিনীর খুলনা রেঞ্জের বর্তমান কার্যালয়।
বাড়িটি এখন আনসার ও ভিডিপির তত্ত্বাবধানে আছে। ভবনের প্রবেশ মুখে নিচের একটি কক্ষে রয়েছে তাদের গুদাম।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে ‘প্রথম রাজাকার ক্যাম্প’ হয়েছিল এ বাড়িতেই।
একাত্তরের সেই ভয়াবহ স্মৃতি নিয়ে টিকে থাকা ভগ্ন ও পরিত্যক্ত বাড়িটিতে প্রবেশ করলে এখনও গা ছমছম করে। দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। বন-জঙ্গলে পরিপূর্ণ; অনেকটা ভৌতিক পরিবেশ।
ইট-সুরকির ভবন থেকে খসে পড়ছে পলেস্তারা। কোথাও কোথাও খসে পড়েছে দেয়ালের ইটও। ভবনে বেড়ে উঠেছে বটগাছ। দেয়াল ফেটে বেরিয়ে আছে অসংখ্য বটের শিকড়।
খুলনার ইতিহাস গবেষক অধ্যাপক এ এইচ এম জামাল উদ্দিন জানান, শত বছর আগে এ বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন তৎকালীন জমিদার দীননাথ সিংহ। ওই সময় এ বাড়িতে পরপর কয়েকজনের অপঘাতে মৃত্যু হয়। পরিবারের বাকি সদস্যরা অন্যত্র চলে যাওয়ায় পরিত্যক্ত হয় বাড়িটি। এক পর্যায়ে খুলনা শহরবাসীর কাছে সেটি ‘ভূতের বাড়ি’ নামে পরিচিতি পায়।
জামাল উদ্দিন বলেন, “আবার কারও কারও মতে, নাটোরের দীঘাপতিয়া রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা রাজা দয়ারাম ১৭১৪ সালে খুলনা-যশোরের অনেক জমি দখল করেন। দয়ারামের বোনের মেয়ে শীলা এ বাড়িতেই আত্মহত্যা করেন। একই সময় শীলার স্বামী নিধুরামেরও মৃত্যু হয়। আর এখান থেকেই ভৌতিক গল্পের শুরু। সাধারণ লোকজনের ধারণা, এগুলো সব ভূতের কাজ।
অনেক পরে ওই বাড়ির দক্ষিণ দিকের দোতলা ভবনটিতে আনসার বাহিনীর খুলনা রেঞ্জের অফিস করা হয়। তবে মুক্তিযুদ্ধকালে প্রথম রাজাকার ক্যাম্প গঠন করা হয় এ বাড়িতে।
কথা হয় মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, সাবেক সংসদ সদস্য স ম বাবর আলীর সঙ্গে।
তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধকালে প্রথম রাজাকার ক্যাম্প গঠন করা হয় খুলনা নগরীর ‘ভূতের বাড়ি’তে। বাড়িটি ছিল রাজাকারদের সদরদপ্তর, তাই কৌশলগত কারণে সেখানে নির্যাতন কম হতো।
“মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সহযোগীদের ধরে এনে নির্যাতন করা হতো টর্চার সেলগুলোতে। যাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হতো, তাদের আর খবর মিলত না। নির্যাতনের পর হত্যা করা হতো।”
তিনি আরও জানান, নগরের সার্কিট হাউসের কাছে হেলিপ্যাড, নেভাল বেস, হোটেল শাহীন হয়ে উঠেছিল পাকিস্তানিদের প্রধান নির্যাতন কেন্দ্র।
“এ ছাড়া আরও দুটি বড় নির্যাতন কেন্দ্র ও রাজাকার ক্যাম্প ছিল বর্তমান শিপইয়ার্ড ও খালিশপুরে। আর শহরের বাইরে সবচেয়ে বড় রাজাকার ক্যাম্প ছিল পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনিতে।”
বাবর আলীর ভাষ্য, শুধু খুলনা নয়, বাগেরহাট মহকুমাও ছিল রাজাকার বাহিনী প্রধান ইউসুফের নিয়ন্ত্রণে। ইউসুফের বাড়ি ছিল বাগেরহাটের শরণখোলার রাজৈর গ্রামে।
ইউসুফকে সহায়তা করতেন খুলনা সদরের রাজাকার কমান্ডার হাবিবুল্লাহ, বাগেরহাটের রাজাকার কমান্ডার রজব আলী ও মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুরসহ অনেকে।
মুক্তিযুদ্ধ-সংক্রান্ত বিভিন্ন গবেষণা ও দলিলপত্র, স্মৃতিকথাতেও এসব হত্যা-নির্যাতনের বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ আছে।
এদিকে, ২০১৫ সালের ২৯ অক্টোবর আনসার ও ভিডিপি কমান্ড্যান্টের কার্যালয়ের সীমানার বাইরে ‘একাত্তরের প্রথম রাজাকার ক্যাম্প’ এর পরিচিতিমূলক ফলক স্থাপন করা হয়। ফলকটি স্থাপন করেন ‘১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট’ এর সভাপতি, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক লেখক ও ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন।
তার সঙ্গে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কথা হয়।
তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সহায়তা করার জন্য বাংলাদেশের ভেতরে শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল-বদর এবং আল-শামস বাহিনী গড়ে ওঠে।
“পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহায়তার জন্য একাত্তরের মে মাসে খুলনার খানজাহান আলী রোডের একটি আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জন পাকিস্তানপন্থি ব্যক্তিকে নিয়ে রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়।
“পরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় এ বাহিনীর জন্য সদস্য সংগ্রহ করা হয় এবং তারা প্রত্যন্ত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।”
অধ্যাপক মামুন বলেন, “একাত্তরের ১ জুন জেনারেল টিক্কা খান 'পূর্ব পাকিস্তান রাজাকার অর্ডিন্যান্স-১৯৭১' জারি করে আনসার বাহিনীকে বিলুপ্ত করে রাজাকার বাহিনীতে রূপান্তরিত করেন। তখন পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের পূর্ণাঙ্গ সেনাবাহিনীর সদস্যদের সমান ক্ষমতা অর্পণ করে এক অধ্যাদেশ জারি করা হয়।”
এই রাজাকাররাই মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানী সেনাদের সহযোগী হিসেবে হত্যা-নির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের মতো মানবতাবিরোধী নানা অপরাধ সংগঠিত করেন বলে মুনতাসীর মামুনের ভাষ্য।
তিনি আরও বলেন, রাজাকার বাহিনী গঠনের পেছনে সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন নেতা এ কে এম ইউসুফ, যিনি পরে দলটির নায়েবে আমির হন। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তাকে আটক করা হয় এবং কারাগারেই তার মৃত্যু হয়।
“তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা এবং খুলনায় শান্তি কমিটির প্রধান ছিলেন।”
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি খুলনার সভাপতি ডা. বাহারুল আলমের ভাষ্য, মুক্তিযুদ্ধের সময় এ বাড়িটিতে হানাদারবাহিনীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে জামায়াতে ইসলামী তাদের ছাত্র, যুব ও শ্রমিকফ্রন্টের সদস্যদের নিয়ে রাজাকার ট্রেনিং শুরু করে। পরে জামায়াতে ইসলামী ও পাকিস্তানপন্থিদের ট্রেনিং দেওয়া হয়।
“এরা খুলনা এবং এর আশপাশের হিন্দু ও আওয়ামী লীগ প্রভাবিত গ্রামগুলোতে পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যদের সহযোগিতায় হত্যা, লুট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ এবং মেয়েদের উঠিয়ে নিয়ে যেত। যুবকদের ধরে এনে নির্মম নির্যাতন করত।”
বাহারুল আরও বলেন, রাতে ক্যাম্পের গেটে এসে দাঁড়াত অভিশপ্ত কভার্ডভ্যান। মরদেহ ছাড়াও ধরে আনা আধমরা হতভাগ্যদের বাড়ি পাঠানোর নাম করে উঠানো হতো। পরে গল্লামারী নিয়ে গুলি করে ও গলাকেটে ফেলে দেওয়া হতো নদী, খাল অথবা বিলে।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে তিনি বাড়িটি সংস্কার ও সংরক্ষণের দাবি জানান।
আনসার ও ভিডিপি খুলনা রেঞ্জের উপ-মহাপরিচালক শাহ্ আহমেদ ফজলে রাব্বি বলেন, বাড়িটি সংরক্ষণ বা মেরামতে সরকারিভাবে কোনো দিক-নির্দেশনা পাওয়া যায়নি।