মহামারী আর যুদ্ধের সঙ্কটে তিনটি বছর পার করা এই পৃথিবীর আগামী বছরটাও যে অর্থনৈতিকভাবে ভালো যাবে না, সেই পূর্বাভাস বিশ্ব সংস্থাগুলো দিয়ে আসছে। খোদ সরকারপ্রধান বার বার দুর্ভিক্ষের শঙ্কার কথা বলে সতর্ক করে আসছেন দেশবাসীকে। সত্যি সত্যি যদি তেমন বিপদ আসন্ন হয়, তা সামাল দিতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত, সেই প্রশ্নও সামনে আসছে। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
এই বিপদের মুখ অনেকগুলো, তার কয়েকটা ইতোমধ্যে বাংলাদেশ দেখতে শুরু করেছে। টানা কয়েক বছর বাড়তে থাকা বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার এখন নিম্নমুখী। বিশ্বের জ্বালানি বাজারের অস্থিরতা ফিরিয়ে এনেছে বিদ্যুতের লোড শেডিং।
সহসা খাদ্য সঙ্কট তৈরি হওয়ার স্পষ্ট কোনো ইংগিত এখনও সরকারের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতির সার্বিক সঙ্কটে মূল্যস্ফীতি বহু বছর পর এখন ৯ শতাংশের উপরে থাকছে।
তাতে নিম্ন আর মধ্যবিত্তের সংসার সামলাতে উঠছে নাভিশ্বাস। আর বিশ্ব খাদ্য সংস্থা খাদ্য সঙ্কটের যে ঝুঁকির কথা বলছে, সেই তালিকায় বাংলাদেশের নামও আছে।
সরকারের হিসাবে, দেশের মানুষকে খাওয়াতে বছরে মোটামুটি তিন কোটি ৫০ লাখ টন চাল এবং ৫০ থেকে ৬০ লাখ টন আটা লাগে। চালের প্রায় শতভাগ এবং গমের ১০ শতাংশের মত দেশীয় জোগান থেকে আসে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য কোনো কারণে ধানের উৎপাদন ব্যাহত হলে তখন চাল আমদানি করতে হয়।
বর্তমানে সরকারি গুদামে প্রায় ১৬ লাখ টন খাদ্যের মজুদ আছে। এর মধ্যে চাল প্রায় ১৪ লাখ টন, গম এক লাখ ৮০ হাজার টন। আর গুদামে ধান আছে ২০ হাজার টন।
চলতি আমন মৌসুমে এক কোটি ৫৯ লাখ টন চাল পাওয়ার আশা সরকার করছিল। এর মধ্যে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং এসে কিছু ক্ষতি করে দিয়ে গেছে, যদিও সেই ক্ষতির পরিমাণ এখনও নিরূপণ হয়নি।
এতসব বিপদের মধ্যে নতুন করে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটলে কিংবা বীজ, সেচ বা সার নিয়ে সংকট তৈরি হলে খাদ্য উৎপাদন ধাক্কা খাবে। তখন খাদ্য আমদানি বাড়াতে হবে।
প্রয়োজনে চাল আমদানির কিছু প্রস্তুতি সরকার ইতোমধ্যে নিয়ে রেখেছে। কিন্তু আমদানি মানেই ডলার খরচ। তাতে আরও চাপ পড়বে রিজার্ভে। সব বিপদ সেই এক জায়গাতেই গিয়ে ঠেকছে।
কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক অবশ্য মনে করেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে দেশে চাল-আটাসহ খাদ্যপণ্যের দাম বাড়লেও সেটা খাদ্যাভাবে গড়ানোর মত পরিস্থিতি এখনও হয়নি।
খাদ্যের উৎপাদন বাড়াতে আগামী বছর থেকে সারাদেশের কৃষিজমিকে ব্লকে ভাগ করে চাষাবাদ তদারকের উদ্যোগের কথাও তিনি বলেছেন।
অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুরও দুর্ভিক্ষের ঝুঁকির বার্তা বাংলাদেশের জন্য ততটা প্রযোজ্য হবে বলে মনে করছেন না।
তবে এ বিপদ কয়েক দিনে বা কয়েক মাসে কাটার নয়। সে কারণে আগামী বোরো মৌসুমের উৎপাদন যেন ব্যাহত না হয়, সেজন্য সরকারকে তিনি এখন থেকেই পরিকল্পনা নিতে পরামর্শ দিচ্ছেন।
ঝুঁকির কথা আসছে কেন
আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আনতে হয়- এমন বেশ কয়েকটি ভোগ্যপণ্যের দাম গত কয়েক মাসে লাগামহীনভাবে বেড়েছে। এর পেছনে রয়েছে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও রিজার্ভ নিয়ে শঙ্কা।
ডাল, ভোজ্যতেল, চিনি, প্রসাধনী, জরুরি জীবনরক্ষাকারী ওষুধের মত পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় জনজীবনে চাপ আরও বেড়েছে।
বিশ্ব খাদ্য সংস্থার নিয়মিত সাময়িকী (প্রান্তিক) ক্রপস প্রসপেক্টস অ্যান্ড ফুড সিচুয়েশনের সেপ্টেম্বর সংখ্যায় বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে বিশ্বের ৪৫টি দেশে বাড়তি খাদ্য আমদানির প্রয়োজন হবে, এসব দেশের মধ্যে ৩৩টিরই অবস্থান আফ্রিকায়। ওই তালিকায় বাংলাদেশসহ এশিয়ার ৯টি দেশেরও নাম রয়েছে।
আফ্রিকায় খরার কারণে খাদ্য উৎপাদন কমে গিয়ে দুর্ভিক্ষের মত পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হয়েছে। আর বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন গত বছরের তুলনায় চলতি বছর চার লাখ টন কম হতে পারে বলে বিশ্ব খাদ্য সংস্থার ধারণা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরে ধানের উৎপাদন হবে পাঁচ কোটি ৬৪ লাখ টন, যা গত বছর ছিল পাঁচ কোটি ৬৮ লাখ টন। তবে গমের উৎপাদন এক লাখ টন বৃদ্ধি পেয়ে ১২ লাখ টনে উন্নীত হতে পারে।
চালসহ মৌলিক খাদ্যের বেশিরভাগই দেশীয় জোগাননির্ভর হওয়ায় সরবরাহ নিয়ে আগামী কিছুদিন বাংলাদেশের খুব বেশি দুশ্চিন্তার কারণ দেখছেন না গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট-পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, স্বাভাবিক সময়ে দেশের চাহিদার ৯৫ শতাংশ ধান-চালের জোগান দেশীয় কৃষিক্ষেত্র থেকেই আসে। আর কিছুটা সংকট দেখা দিলে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ চাল আমদানি করতে হয়।
কৃষিতে গত এক দশকে বাংলাদেশ বেশ উন্নতি করেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সুতরাং মহামারী উত্তর সংকট ও যুদ্ধকালে বিশ্বের অনেক অঞ্চলে খাদ্যের ঘাটতি দেখা দিলেও তা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অতটা প্রযোজ্য হবে না।
“সেক্ষেত্রে ধানের সবচেয়ে বড় যোগান বোরো মৌসুমের উৎপাদন যেন কোনো কারণে বাধাগ্রস্ত না হয়, তার জন্য সরকারকে এখন থেকেই পরিকল্পনা হাতে নিয়ে এগোতে হবে।”
তবে বৈশ্বিক অভিঘাতে বাংলাদেশে ব্যাংকের রিজার্ভ যে হারে কমে যাচ্ছে, তা আর ‘কমতে দেওয়া যাবে না’ বলেও মন্তব্য করেন এই অর্থনীতিবিদ।
তিনি বলেন, “রিজার্ভ এখন যেখানে নেমেছে সেটা অবশ্যই অস্বস্তির। কিন্তু এটা যাতে আর নিচে না নামে, সেজন্য কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। রিজার্ভ ঠিক থাকলে ভবিষ্যতে কিছু চাল ও গম আমদানি করতে হলেও সেটা করা যাবে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের গত ২৬ অক্টোবরের তথ্য অনুযায়ী, বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ৩৫ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলারে, যা ২৮ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।
এক বছর আগে ২০২১ সালের ২৬ অক্টোবর রিজর্ভে ছিল ৪৬ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার। আর সর্বশেষ ২০২০ সালের জুনে রিজার্ভ ৩৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে ছিল।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রার মজুদ থাকতে হয়। বর্তমান রিজার্ভ দিয়ে বাংলাদেশ চার মাসের মত আমদানি বিল পরিশোধ করতে পারবে।
যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশেও তা বাড়িয়েছে সরকার। জ্বালানি সংকট আর ডলার বাঁচাতে গত জুলাই থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনও কমানো হয়েছে। তাতে ঘন ঘন লোড শেডিং হচ্ছে, ভুগতে হচ্ছে শিল্প খাতকে।
খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে গ্যাস-বিদ্যুতেরও যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে, তা মনে করিয়ে দিয়ে আহসান এইচ মনসুর বলেন, “দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রস্তুতি থাকলেও সঞ্চালন লাইনের দুর্বলতার কারণে তা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। ফলে দেশের একাংশ এখনও লোড শেডিংয়ে আক্রান্ত।
“সেচের মৌসুমে এই লোড শেডিং থেকে যাতে বের হওয়া যায়, তার জন্য এখনই কিছু পদক্ষেপ নিয়ে ফেলতে হবে। কিছু সেচ পাম্পে সোলার পাওয়ার যুক্ত করার যে পরিকল্পনা চলছে সেটাকেও ত্বরিত গতিতে আগাতে হবে।”
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান-বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন খাদ্য সংকটের চেয়ে শিল্প কারখানা সচল রাখার দিকে বেশি নজর দিতে বলছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমাদের খাদ্য উৎপাদন চিত্রে এমন কিছু আসেনি যে এখন শঙ্কিত হতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারেও চালের দাম খুব বেশি বাড়েনি। গমের প্রাপ্যতা নিয়ে কিছু সমস্যা আছে।
“আমি খাদ্য সংকট, দুর্ভিক্ষ কিংবা চরম দারিদ্র্য- এমন কিছু দেখছি না। আমরা তো ইউক্রেইন কিংবা রাশিয়ার কাছ থেকে চাল আমদানি করছি না। গম যা লাগে সেটাও ভারত থেকে আসে। ভারত থেকে গম আনতে আমাদের কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।”
সংকটের আলোচনার মধ্যে অসাধু খাদ্য ব্যবসায়ীরা সুযোগ নিতে পারে মন্তব্য করে বিনায়ক সেন বলেন, “গণমাধ্যম এবং দায়িত্বশীল জায়গা থেকে সতর্কতার সাথে কথা বলতে হবে। কারণ এসব খবরে খাদ্য ব্যবসায়ীরা সুযোগ নিতে পারে। আগামী মৌসুমে সেচের জন্য ডিজেল ও সারের সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে আর কোনো আশঙ্কা থাকে না।”
মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে ‘একটু রয়েসয়ে’ খরচ করতে হচ্ছে; সেটা বর্তমান বাস্তবতায় অস্বাভাবিক বলে মনে করছেন না এই অর্থনীতিবিদ।
তিনি বলেন, “দাম একটু বেড়েছে, কিন্তু বাজারে শাক সবজির কোনো ঘাটতি নেই।”
বরং শিল্পাঞ্চলে গ্যাস-বিদ্যুৎ সমস্যার দিকে মনোযোগ দেওয়ার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, “আবাসিক এলাকায় সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে কৃষি ও শিল্পে গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়িয়ে দিতে হবে। কারণ শিল্পের সঙ্গে কর্মসংস্থানের সম্পর্ক রয়েছে।”
বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য চালের ক্ষেত্রে খুব বেশি পরনির্ভরশীলতা না থাকায় খাদ্য ঘাটতির বড় কোনো আশঙ্কা বিনায়ক সেন দেখছেন না।
“আন্তর্জাতিক চালের বাজার স্থিতিশীল। আমাদের অতটা চাল আমদানিও করতে হয় না। বাংলাদেশ আর সেই জায়গায় নেই। ১৯৭৪ সালে কিংবা ২০০৭/২০০৮ সালে যেমনটা হয়েছিল বাংলাদেশ আর সেই পরিস্থিতিতে নেই।”
চাল, আটা কতটা আমদানি নির্ভর?
সামগ্রিক মূল্যস্ফীতির ধাক্কায় গত তিনমাস ধরেই বাংলাদেশে চাল-আটার বাজার ঊর্ধ্বমুখী। অবশ্য এই ঊর্ধমুখী প্রবণতাকে অযৌক্তিক বলেই মনে করছে সরকার। সম্প্রতি চাল-আটার ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে।
সরকারি সংস্থা টিসিবির বাজার মনিটরিং সেলের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে দেশের খুচরা বাজারে প্রতিকেজি আটার প্যাকেট ৬০ টাকা ও ময়দার প্যাকেট ৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এই দাম একবছর আগের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি।
একইভাবে বাজারে সরু চাল প্রতিকেজি ৭৫ টাকা, মাঝারি মানের চাল ৫৬ টাকা এবং মোটা চাল ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চালের দামও এক বছর আগের তুলনায় ১০ শতাংশের মত বেড়েছে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির প্রভাবে দেশের বাজারে চাল ও আটার দাম বাড়ছে। আটা-ময়দা অনেকাংশে আমদানি নির্ভর হওয়ায় তাতে কিছুটা ঘাটতি দেখা যাচ্ছে, তবে চালের সরবরাহে সেরকম ঘাটতি নেই।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বৈদেশিক সংগ্রহ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ বছর আগে ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশকে সরকারি ও বেসরকারিভাবে সর্বোচ্চ ৩৬ লাখ টন চাল আমদানি করতে হয়েছিল। পরের অর্থবছর আমদানির পরিমাণ ১৪ লাখ টন, এর তার পরের অর্থবছরে ৪ হাজার টনে নেমে আসে।
২০২০-২০২১ অর্থবছরে আমদানির পরিমাণ বেড়ে গিয়ে সাড়ে ১৩ লাখ টনে উঠলেও এর পরের বছর তা আবার কমে গিয়ে ৯ লাখ টনে নামে।
দেশে বড় ধরনের বন্যা, ঘূর্ণিঝড় কিংবা অন্য কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এলেই চালের আমদানির প্রয়োজন বাড়ে। ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে হাওরাঞ্চলে আগাম বন্যার কারণে বোরো ধানের বড় ক্ষতি হয়েছিল।
গত পাঁচ বছরের গম আমদানির চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সরকারিভাবে টিআর, কাবিখা ও কর্মসৃজন প্রকল্পেসহ বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী ও রেশনিংয়ের জন্য প্রতিবছর তিন লাখ থেকে সর্বোচ্চ ৫ লাখ টন গম আমদানির প্রয়োজন হয়।
আর খোলবাজারের বিপণনের জন্য বেসরকারিভাবে ৫০ লাখ থেকে ৬০ লাখ টন গম আমদানি করা হয় প্রতিবছর। এর বাইরে দেশে প্রতিবছর গড়ে ১০ লাখ টন গম ও ৩০ লাখ টন ভুট্টা উৎপাদিত হয়।
সবশেষ গত ২০২১-২০২২ অর্থবছরে সরকারি ও বেসরকরিভাবে ৪০ লাখ টন গম আমদানি করা হয়েছিল।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএসের) ২০১৭ সালের জরিপ অনুযায়ী, দেশে আউশ, আমন ও বোরো মৌসুমে ৩৩৮ লাখ টন চাল উৎপাদন হয়। এর সঙ্গে ১৩ লাখ টন গম ও ৩০ লাখ টন ভুট্টাসহ বছরে মোট ৩৮১ লাখ টন খাদ্য শস্য উৎপাদন হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালে চাল আকারে এক কোটি ৫৭ লাখ টন আমন ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। এবছর সারাদেশে ৫৬ লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমিতে আমনের আবাদ হয়েছে, তাতে এক কোটি ৫৯ লাখ টন চাল উৎপাদন হবে বলে সরকারের আশা ছিল।
কিন্তু ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের কারণে এরইমধ্যে ১৯ জেলায় ৩৩ হাজার জমির আমন ধান গাছ হেলে পড়েছে। তবে তাতে উৎপাদন কতটা কমতে পারে, সে বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো হিসাব সরকার এখনও দেয়নি।
বিশ্ববাজারের বর্তমান মূল্য প্রবণতা অনুযায়ী প্রতিকেজি ৪০ টাকা ধরলে প্রতি এক লাখ টন চাল আমদানি করতে খরচ হবে ৪০০ কোটি টাকা। ১০ লাখ টন চালে চার হাজার কোটি টাকা খরচ হবে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, প্রথম পর্যায়ে শুল্ক কমিয়ে ১০ লাখ টনের বেশি চাল আমদানির অনুমোদন দেওয়ার পর ৩৮ হাজার টন চাল আমদানি করেছেন ব্যবসায়ীরা। দ্বিতীয় পর্যায়ে অনুমোদন দেওয়া চার লাখ ৯২ হাজার টনের মধ্যে গত ২ লাখ ৯ হাজার টন চাল দেশে এসেছে।
এর বাইরে চলতি অর্থবছরে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে মোট ৯ লাখ টন চাল আমদানি করতে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি থেকে অনুমোদন নিয়ে রেখেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। অনুমোদন পাওয়া চালের মধ্যে ৫ লাখ টন চাল আমদানির বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে বলে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
জয়পুরহাটের চাল আমদানিকারক হেনা এন্টারপ্রাইজের স্বত্ত্বাধিকারী আব্দুল হাকিম মণ্ডল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকার প্রথমে শুল্ক ৬২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করলেও ভারতের বাজারে দাম বেশি হওয়ায় আমরা আমদানিতে সুবিধা করতে পারছিলাম না। পরে আবার শুল্ক কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়।
"তবে বেসরকারি পর্যায়ে যত চাল এসেছে, তাতে করে ভবিষ্যতে আর সংকট হবে বলে মনে হচ্ছে না। আমন মৌসুমের ধান উঠার আগে আর কোনো প্রাকৃতিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে দেশে চালের সঙ্কট হবে না।
চাল আমদানিতে ভোগান্তি পোহানোর কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, "ব্যাংকে গেলে ডলার নেই; আমরা আমদানি করতে গেলে ভারতে দাম বাড়িয়ে দেয় ইত্যাদি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমার জন্য বরাদ্দ হওয়া চার হাজার টন চাল দেশে আনতে পেরেছি। তবে এখন চালের বাজারটাও পড়তির দিকে।”
সরকার কী বলছে
বিশ্ব আগামী বছর ‘দুর্ভিক্ষের মত খারাপ পরিস্থিতির’ মুখোমুখি হতে পারে বলে সতর্ক করে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলে আসছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
দেশবাসীকে সাশ্রয়ী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেছেন, “বিদ্যুৎ ব্যবহার, পানি ব্যবহার, খাদ্য ব্যবহার প্রত্যেকটা ব্যবহারের ক্ষেত্রে সবাই যেন সীমিত হয়, সাশ্রয়ী হয়। কারণ আগামী সংকটটা যেন আগামীতে সেভাবে না দেখা দেয়।”
তবে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক অতটা শঙ্কিত নন। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “এবার আমনের চাষাবাদ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি হয়েছে। আগামী কার্তিক মাসের শেষ দিকে আমনের নতুন ধান চলে আসবে। এই সময়ের মধ্যে চালের দাম বাড়ার শঙ্কা নেই বলে মিলাররা ধারণা করছেন।”