যদি বর্ষে অঘ্রানে, রাজা যান মাগনে
যদি বর্ষে মাঘের শেষ, ধন্য রাজার পূণ্য দেশ
-খনা
কোনো নারী তার বচন বা কথার জন্য বছরের পর বছর ধরে বেঁচে আছে এমন শুনেছেন কখনো? বাঙালি হলে খনার বচনের নাম শুনে থাকবার কথা। হ্যাঁ, সেই খনার কথাই বলা হচ্ছে যিনি ছিলেন জ্যোতিষ ও গণিতশাস্ত্রে পারদর্শী প্রাচীন বাংলার এক কিংবদন্তি নারী। খনার বচন শস্য উৎপাদন থেকে বৃক্ষরোপণ, গৃহনির্মাণ থেকে জীবনদর্শন সম্পর্কে ছড়ার আকারে প্রচলিত, যে বচন বারবার কৃষকদের সহায় হয়ে দাঁড়িয়েছে কৃষিকাজে।
খনা নামের ইতিবৃত্ত
তৎসম বা সংস্কৃত প্রকৃতি √খন্ এর সাথে বাংলা আ প্রত্যয় যোগ করে খনা শব্দটি উৎপত্তি লাভ করে। কেউ কেউ বলেন, শুভক্ষণে জন্ম তাই তার নাম খনা। আবার আরেকটি মত অনুযায়ী প্রকৃতভাবে খনার পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল লীলাবতী। উড়িয়া ভাষায় খোনা মানে হলো বোবা। লীলাবতীর জিভ কেটে দেবার ফলে তিনি বোবা হয়ে যান। সেখান থেকে তার নাম খোনা বা খনা হয়ে থাকতে পারে।
কে এই খনা?
খনার পরিচয় নিয়ে রয়েছে নানা ধরনের ধোঁয়াশা। কিংবদন্তি অনুসারে খনা ছিলেন সিংহলরাজের কন্যা। ভারতের প্রাচীন নগরী উজ্জয়িনীর রাজা বিক্রমাদিত্যের সভার বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ বরাহমিহিরের পু্ত্রের সাথে খনার বিয়ে হয়।
অপর একটি ধারণানুযায়ী ৮০০ থেকে ১২০০ খ্রিষ্টাব্দ সময়কালের মধ্যে খনার জন্ম। তিনি ছিলেন অনাচার্যের কন্যা। খনা বাস করতেন যে জায়গাটিতে সেটি বর্তমানে উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার বারাসাত মহকুমার দেউলিয়া গ্রামের অন্তর্গত। চন্দ্রকেতুগড় প্রত্নস্থল বা খনামিহিরের ঢিবি খনার অস্তিত্বের ইতিহাস বহন করে চলেছে।
কৃষক কন্যা নাকি বিদুষী নারী?
খনার বচনে কৃষিকাজ সম্পর্কে বিশদভাবে যে সতর্কবাণী ও উপদেশবার্তা দেয়া হয়েছে তা পড়লে প্রশ্ন জাগে একজন রাজকন্যা কিংবা রাজবধূর পক্ষে কীভাবে কৃষিসংক্রান্ত এত সঠিক এবং নির্ভুল তথ্য দেয়া সম্ভব?
সে নিয়ে আরেকটি মত এই যে, খনা ছিলেন মা ও মাটির কাছের মানুষ, ছিলেন কৃষক কন্যা। শেকড় থেকে শিখে যিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত। আবার প্রাচীন শাস্ত্রের সাথে খনার বচনের মূল বিষয়বস্তুর অদ্ভুত মিল পাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে এমনও হতে পারে খনা প্রাচীন শাস্ত্রে অগাধ পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন এবং সেই জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে খনার বচন রচনা করেছিলেন।
বিক্রমাদিত্যের দশম রত্ন প্রজ্ঞাময়ী খনা
খনার স্বামী মিহির এবং শ্বশুর বরাহমিহির ছিলেন রাজা বিক্রমাদিত্যের সভার প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ। মিহির ও খনা একই সাথে জ্যোতিষশাস্ত্রে দীক্ষা নিয়েছিলেন।
একবার বরাহমিহির এবং মিহির পিতাপুত্র মিলে একটি গণনা সমস্যার সমাধানে পৌঁছাতে পারছিলেন না। পরবর্তীতে খনা এসে সেই গণনা সম্পন্ন করে দেন। খনার গণনালব্ধ তথ্য প্রয়োগে রাজ্যের কৃষকরা লাভবান হতে শুরু করলেন। এভাবেই খনা রাজা বিক্রমাদিত্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং নিজের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার জন্যে রাজসভার দশম রত্ন হিসেবে নিজের জায়গা তৈরি করে নেন।
কবিত্ব এবং খনা
খনাকে কবি হিসেবে আখ্যায়িত করা হলে বোধ করি তার উপযুক্ত সম্মানখানা দেয়া হয়। খনার বচনের বিশেষত্ব হচ্ছে বচনগুলো যেমন সহজবোধ্য তেমনি ছন্দবদ্ধও বটে। শ্রুতিমধুর অথচ সহজ-সরল ভাষা যা পড়ে বা শুনে বুঝতে পারবে গ্রামের বৃদ্ধ কৃষক থেকে কচি খোকাও। আর সবচেয়ে চমকপ্রদ হচ্ছে ৮০০ বছর পরও খনার বচনের চরণগুলোর সমানভাবে যৌক্তিক। দুই বা চারলাইনের ছন্দবদ্ধ এসব বচন খনার কবিত্বশক্তিকেই তুলে ধরে।
খনার বচন
খনার বচন বাঙালির লৌকিকতার সাথে যুক্ত হয়ে পাঁচশ বছরের বেশি সময় ধরে বেঁচে আছে মুখেমুখে, ঘরেঘরে। খনার বচনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে কৃষি এবং গো-পালনের ওপর। খনার বচনগুলো মূলত চার ভাগে বিভক্ত। কৃষিকাজের প্রথা ও কুসংস্কার, কৃষিকাজ ফলিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান,আবহাওয়া জ্ঞান এবং শস্যের যত্ন সম্পর্কিত উপদেশ।
খনা ডাকিয়া কন
রোদে ধান, ছায়ায় পান
অর্থাৎ রোদ না পেলে ধান ভালো হয় না। অন্যদিকে পানের ক্ষেত্রে উল্টো নিয়ম প্রযোজ্য। পানগাছ ছায়ায় ভালো হয়।
শাওনের পান রাবণে না খায়
অর্থাৎ শ্রাবণ মাসে পান বপন করলে এত বেশি পান হবে যে রাক্ষসেও খেয়ে শেষ করতে পারবে না।
খনার নির্মম পরিণতি ও পুরুষতান্ত্রিকতা
খনার জ্যোতির্বিদ্যা ও গণনায় সুপটুতা একসময়ে খনার স্বামী ও শ্বশুরের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ালো। তারা মনে করতে লাগলো, বিক্রমাদিত্যের রাজসভায় তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি কমবার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে খনা এবং তার পাণ্ডিত্য। সুতরাং যে মুখ দিয়ে এত কথা বের হয়, সেই মুখ বন্ধ করে দেয়া হোক। বরাহমিহিরের আদেশে খনার স্বামী মিহির খনার জিভ কেটে নেন এবং রক্তক্ষরণে খনার মৃত্যু হয়। পুরুষতান্ত্রিকতার যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে প্রতিহিংসাপরায়ণ স্বামী ও শ্বশুরের হাতে এভাবেই খনা হারিয়ে গেলেন।
বটতলার খনা
বাংলাদেশের অন্যতম নাট্যদল বটতলার একটি নন্দিত পরিবেশনা খনা নাটকটি। সামিনা লুৎফা নিত্রার রচনায় ও মোহাম্মদ আলী হায়দারের নির্দেশনায় খনার উপকথাকে নাট্যরূপ দেয়ার মাধ্যমে খনা নাটক ও বটতলা অভিন্নভাবে যে দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করেছিল তা ভোলবার নয়। ২০১০ সালের ৯ মার্চ প্রথমবারের মতো মঞ্চস্থ হওয়া খনা এখনো তার আবেদন হারায় নি। খনা মঞ্চস্থ হয়ে চলেছে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে।
সত্যের প্রতীক খনা
বাকশক্তি থাকা অবস্থায় খনা যেসকল বাণী দিয়েছিলেন, সেগুলোই খনার বচন হিসেবে পরিচিতি পায়। কর্তিত জিভ এবং মৃত্যু দিয়ে জ্ঞান ও সত্যের ধ্বজাধারী খনাকে মেরে ফেলা যায় নি। নাম যাই হোক, লীলাবতী কিংবা খনা কিংবা অন্য কিছু, তিনি বেঁচে থাকলেন ভীষণভাবে, জিভ হারানো খনা বেঁচে রইলেন সত্যের প্রতীক হিসেবে খনার বচন এর মাধ্যমে, তাঁর কর্মের মাধ্যমে।
অনুস্কা ব্যানার্জী (শ্রাবস্তী) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত।