বায়ু দূষণ কী করে শরীরে ক্যান্সার বাসা বাঁধার কারণ হয়ে উঠতে পারে, এক গবেষণায় সেই রহস্য উন্মোচনের কথা জানিয়েছেন গবেষকরা। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
তারা বলছেন, টিউমার কি করে বেড়ে ওঠে, সে বিষয়ে মানুষের এতদিনের বোঝাপড়া অনেকটাই বদলে যাবে নতুন এই আবিষ্কারের পর।
লন্ডনের ফ্রান্সিস ক্রিক ইনস্টিটিউটের এই গবেষক দলটি দেখতে পেয়েছেন, বায়ু দূষণ কোষে নতুন করে কোনো ক্ষতি করছে না। বরং ক্ষতিগ্রস্ত পুরনো কোষকে সক্রিয় করে তুলছে, যা ক্ষতির কারণ ঘটাচ্ছে।
এ বিষয়ে বিশ্বের সেরা বিশেষজ্ঞদের একজন, অধ্যাপক চার্লস সোয়ানটন বলছেন, এ গবেষণায় পাওয়া তথ্য ‘নতুন যুগের সূচনা’ করবে।
এখন হয়ত এমন ওষুধ তৈরি করাও সম্ভব হবে, যা শরীরে ক্যান্সার তৈরি হওয়া ঠেকিয়ে দিতে পারে।
বিবিসি লিখেছে, ক্যান্সার সৃষ্টিকারী শত শত বস্তুকণা কীভাবে শরীরে প্রভাব ফেলে, তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় নতুন এই গবেষণায়।
এতদিনের ধারণা ছিল, কোনো একটি সুস্থ কোষ থেকেই একসময় ক্যান্সার সৃষ্টি হয়। কোনো কারণে ওই কোষের জেনেটিক কোডে, অর্থাৎ ডিএনএতে বার বার পরিবর্তন বা মিউটেশন ঘটে। এক পর্যায়ে তা শরীরের সাধারণ নিয়মের বাইরে গিয়ে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়তে শুরু করে। তখন তাকে বলে ক্যান্সার।
তবে ওই ধারণা দিয়ে কিছু বিষয় ব্যাখ্যা করা যেত না। অনেক সময় আপাতদৃষ্টিতে সুস্থ্য কলাতেও ক্যান্সারের মিউটেশন দেখা যায়। আবার বায়ু দূষণসহ যেসব বিষয়কে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, সেগুলো সরাসরি মানুষের ডিএনএর ক্ষতি করে না।
তাহলে ক্যান্সারে আসলে কী ঘটে?
গবেষকরা এবার ভিন্ন তত্ত্ব নিয়ে হাজির হয়েছেন প্রমাণসহ। তারা বলছেন, ক্যান্সার যখন হয়, ডিএনএতে ত্রুটি আসলে আগে থেকেই থাকে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটা আরও স্পষ্ট হয়। তবে সেই ত্রুটি বা ক্ষত থেকে ক্যান্সার তৈরি হওয়ার জন্য দরকার হয় কোনো অনুঘটক। বায়ুদূষণ সেই অনুঘটক হিসেবে কাজ করে।
যারা ধূমপানে অভ্যস্ত নন, তারাও কেন ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হন, তা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়েই নতুন এ ধারণার জন্ম। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার কারণ ধূমপান। কিন্তু দেখা গেছে, যুক্তরাজ্যে প্রতি দশ জনে একজন ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন বায়ু দূষণের কারণে।
ক্রিক ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা মূলত মাথা ঘামাচ্ছিলেন প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ভাসমান ২.৫ মাইক্রোমিটার ব্যাসের বস্তুকণার (পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পিএম২.৫) উপস্থিতি নিয়ে। এ ধরনের বস্তুকণা মানুষের চুলের ব্যাসের চেয়েও ক্ষুদ্র হয়।
মানুষ ও প্রাণীর উপর গবেষণা চালানোর পর এক গুচ্ছ তথ্য বের করে আনেন বিজ্ঞানীরা।
-
যেসব এলাকায় বায়ু দূষণের মাত্রা বেশি, সেখানে সেই ধরনের ফুসফুস ক্যান্সারের রোগীর সংখ্যাও বেশি, যাদের ক্যান্সারের কারণ ধূমপান নয়।
-
পিএম২.৫ ভেসে বেড়ানো বাতাসে শ্বাসপ্রশাস নিলে ফুসফুসে ইন্টারলিউকিন-ওয়ান-বেটা নামে একটি রাসায়নিক নিঃসৃত হয়, যা কাজ করে অ্যালার্ম হিসেবে।
-
শরীরের নিজস্ব ব্যবস্থায় ওই অ্যালার্ম ফুসফুসের কিছু কোষকে সক্রিয় করে তোলে, যাতে কোনো ক্ষত হয়ে থাকলে তা সারিয়ে তোলা যায়। তাতে ফুসফুসে প্রদাহ দেখা দেয়।
-
কিন্তু ৫০ বছর বয়সী একজন মানুষের ফুসফুসের প্রতি ছয় লাখ কোষের একটিতে এমন পরিবর্তন এমনিতেই ঘটে, যা ক্যান্সার সৃষ্টির মত মিউটেশনের সম্ভাবনা রাখে।
-
সম্ভাবনা থাকলেও ওই কোষ ক্যান্সারের কারণ ঘটায় না, যতক্ষণ না বাইরের কোনো প্রভাবকের কারণে অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি শুরু হয়।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, বায়ু দূষণের শিকার একটি ইঁদুরের উপর ওষুধ প্রয়োগ করে ওই অ্যালার্ম থামিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে ক্যান্সার তৈরির সম্ভাবনাও থামিয়ে দিতে পেরেছেন গবেষকরা।
ক্রিক ইনস্টিটিউটের গবেষকদের একজন এমিলিয়া লিম বলেন, “জীবনে কখনও ধূমপান না করেও ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্তরা বুঝতে পারেন না কেন তাদের এই রোগ হল। তাদেরকে সেই কারণ বোঝানোর জন্য এই গবেষণা জরুরি ছিল।
“এটি আরও জরুরি এ কারণে যে বিশ্বের ৯৯ শতাংশ মানুষ এমন সব অঞ্চলে বাস করেন, যেখানে বায়ু দূষণের মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বেঁধে দেওয়া সীমা অতিক্রম করে গেছে; যা আমাদের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।”
অবশ্য এ গবেষণার ফল বলছে, কোষের মিউটেশন বা জিন কাঠামোতে পরিবর্তন ঘটলেই সব ক্ষেত্রে তা ক্যান্সারের রূপ নেবে এমন নয়; এ প্রক্রিয়ায় বাড়তি কোনো প্রভাবক কাজ করে, যা ক্যান্সার ত্বরান্বিত করে।
অধ্যাপক সোয়ানটন বলেন, তাদের গবেষণার পর শরীরে টিউমারের বেড়ে ওঠার কারণ নিয়ে নতুন করে ভাববে সবাই। ক্যান্সার প্রতিরোধে এই গবেষণা পথ দেখাবে।
এ বছর জুনে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউটের (ইপিআইসি) গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের ৬৪ জেলার সবক’টিতেই বাতাসে দূষণকারী কণার উপস্থিতি ডব্লিউএইচওর সহনীয় সীমার বেশি।
বায়ুদূষণ এবং বায়ু পরিশোধন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা সুইস সংস্থা আইকিউ এয়ারের বরাতে রয়টার্স জানিয়েছিল, ২০২১ সালে একটি দেশও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রত্যাশিত বায়ুমান বজায় রাখতে পারেনি।
দূষণের মাত্রার বিচারে ওই বছর সবার উপরে ছিল বাংলাদেশের নাম। বাংলাদেশের বাতাসে পিএম২.৫ এর গড় পরিমাণ ছিল ৭৬ দশমিক ৯ মাইক্রোগ্রাম, যা সমীক্ষার ১১৭টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এই হিসেবে গতবছর বিশ্বে বাংলাদেশের বাতাসই ছিল সবচেয়ে দূষিত।
চলতি বছর মার্চে প্রকাশিত স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র-ক্যাপসের এক সমীক্ষায় দেশব্যাপী বায়ুমান পরীক্ষা করে গাজীপুর জেলায় সবচেয়ে বেশি বায়ু দূষণের প্রমাণ পাওয়ার কথা জানানো হয়। বায়ুতে গড়ে অতিক্ষুদ্র কণার দৈনিক গ্রহণযোগ্য মান ৬৫ মাইক্রোগ্রাম; কিন্তু গাজীপুরে এর পরিমাণ ছিল প্রতি ঘনমিটারে ২৬৩ দশমিক ৫১ মাইক্রোগ্রাম। ঢাকায় ২৫২ দশমিক ৯৩ এবং নারায়ণগঞ্জে ২২২ দশমিক ৪৫ মাইক্রোগ্রাম পিএম২.৫ পাওয়া যায়।
বিবিসির প্রতিবেদন বলছে, মাত্রাতিরিক্ত বায়ু দূষণ ঘটছে এমন এলাকায় থাকলে ’ক্যান্সার প্রতিরোধমূলক পিল’ সেবনের ধারণা এখন আর কল্পনা হয়ে থাকবে না।
কার্ডিওভাসকুলার রোগে আক্রান্তের শরীরে এরই মধ্যে ইন্টারলিউকিন-ওয়ান-বেটা ওষুধ পরীক্ষা করে দেখেছেন চিকিৎসকরা; দেখা গেছে এতে ফুসফুস ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে আসছে।
মেডিকেল অনকোলজি নিয়ে ইউরোপিয়ান সোসাইটির একটি সম্মেলনে এ গবেষণা উপস্থাপন করেছেন বিজ্ঞানীরা।
সেখানে বিবিসিকে অধ্যাপক সোয়ানটন বলেন, ক্যান্সারের প্রভাব হিসেবে এখন দূষণের উদাহরণ দেওয়া হয়, তবে আগামী ১০ বছরে আরো দুইশ রকমের উদাহরণ উঠে আসবে।
“ধূমপানের কারণে ফুসফুস ক্যান্সার হওয়ার প্রক্রিয়া নিয়েও আমাদের আবার ভেবে দেখা জরুরি। তামাকের রাসায়নিকের কারণে ডিএনএর ক্ষতি থেকেই কি এটা হচ্ছে, নাকি ধোঁয়ার কারণেও প্রদাহ ঘটছে?”
১৯৪৭ সালে বিজ্ঞানী আইজাক বেরেনব্লাম বলেছিলেন, ডিএনএর পরিবর্তিত হওয়ার কারণে ক্যান্সার হওয়ার তত্ত্ব যথেষ্ট নয়, আরো কোনো অনুঘটক এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।
সে কথার সূত্র ধরে লিম বলেন, “৭৫ বছর আগে এই জীববিজ্ঞানি এমন কথা বলে গিয়েছিলেন, অথচ এতদিন ধরে তা আমলে নেওয়া হয়নি।”
ক্যান্সার রিসার্চ ইউকের প্রধান নির্বাহী মাইকল মিশেল বলেন, ফুসফুস ক্যান্সার হওয়ার বড় একটি কারণ ধূমপানের অভ্যাস।
“তবে ক্যান্সার কী করে শরীরে জন্ম নিচ্ছে তা নিয়ে বছরের পর বছর ধরে করা এসব গবেষণা আমাদের নতুন করে ভাবাচ্ছে। ফুসফুস ক্যান্সার হওয়ার পেছনের কারণগুলো নিয়ে এখন আমাদের আরো ভালো করে জানার সুযোগ হল।”