কোভিড: সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতিতে চাপে চীনের হাসপাতাল


এফই অনলাইন ডেস্ক | Published: December 14, 2022 16:27:26 | Updated: December 14, 2022 19:47:23


কোভিড: সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতিতে চাপে চীনের হাসপাতাল

অল্প সময়ের মধ্যে কোভিড মোকাবেলার নীতি ১৮০ ডিগ্রি পালটে ফেলার পর চীনের হাসপাতালগুলো ব্যাপক চাপে পড়েছে।

কোভিড নীতি তড়িঘড়ি করে বদলানোর কারণে এখন সেখানে চিকিৎসক ও নার্সদের মাধ্যমেও রোগীরা প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে বিবিসি।

কর্মী সংকটের কারণে দেশটির হাসপাতালগুলো এমনকী ভাইরাসে আক্রান্ত ফ্রন্টলাইন মেডিকেল কর্মীদেরও ডেকে পাঠাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে, পর্যবেক্ষণ ব্রিটিশ গণমাধ্যমটির। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।

যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য নীতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ চীনা অধ্যাপক চেন শি শুরু থেকেই স্বদেশের কোভিড সংকট পর্যবেক্ষণ করে আসছেন।

তিনি বিবিসিকে জানিয়েছেন, চীনের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এখন যে ব্যাপক চাপে পড়েছে তা নিয়ে দেশটির হাসপাতাল পরিচালক ও অন্যান্য মেডিকেল কর্মীদের সঙ্গে তার কথা হয়েছে।

“আক্রান্ত ব্যক্তিদেরও হাসপাতালগুলোতে কাজ করতে হচ্ছে, যা সেখানে সংক্রমণের একটি পরিবেশ সৃষ্টি করছে,” বলেছেন তিনি।

`শূন্য কোভিড’ নীতিতে বদল আনার পর চীনের হাসপাতালগুলো রোগীর চাপ মোকাবেলায় তড়িঘড়ি করে তাদের জ্বর সংক্রান্ত ওয়ার্ড বাড়ালেও সেগুলো দ্রুতই ভরে যায়; এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও বাড়িতে থাকা যাবে এই বার্তা চীনা নাগরিকরা আমলে নেয়নি।

বিষয়টি জনগণকে বোঝাতে আরও অনেক কিছু করা দরকার বলে মনে করেন অধ্যাপক চেন।

“সামান্য উপসর্গেও বাড়িতে থাকার সংস্কৃতি নেই চীনে। অসুস্থ বোধ করলেই সবাই হাসপাতালে ছুটে যায়, যা সহজেই চীনের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত অবস্থায় ফেলতে পারে,” বলেছেন তিনি।

ফার্মেসিগুলোতে লোকজনের ভিড় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশজুড়ে ঠাণ্ডাজনিত রোগ বা ফ্লুর ওষুধের ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ঘরে বসেই কোভিড-১৯ শনাক্তকরণ পরীক্ষা করা যাবে, এমন কিটও সহজে পাওয়া যাচ্ছে না।

বেইজিংয়ে রেস্তোরাঁগুলো ফের খুললেও সেখানে ক্রেতা যাচ্ছে হাতেগোনা; এমনকী রাজধানীর রাস্তাগুলোও বেশ নীরব।

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের অফিসে ফিরতে বলছে, কিন্তু কর্মীদের অনেকেই তা করতে রাজি হচ্ছে না।

কয়েক সপ্তাহ আগেও, যখন চীনের সরকার ‘শূন্য কোভিড’ নীতিতে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না বলে জানাচ্ছিল, তখন রাস্তাঘাট, রেস্তোরাঁ আর দপ্তরগুলোর এমন চিত্র স্বাভাবিক ছিল। কারণ তখন লকডাউনের পাশাপাশি আক্রান্তদের কেন্দ্রীয় কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থাপনায় যেতে হত।

কিন্তু এখন পরিস্থিতি অগের মতো নয়। বিক্ষোভ ও অসন্তোষের মুখে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি নিজেদের ঝুঁকির মুখে না ফেলে বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার পথে হেঁটেছে।

একের পর এক শহরের বিক্ষোভকারীরা তাদের পুরনো দিন ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানাতে থাকে। তারা আগের মতো অবাধে ঘোরাফেরা করতে চায়। এসব নিয়ে তারা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষেও জড়ায়। শি জিনপিংয়ের পদত্যাগ ও কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েও স্লোগান ওঠে।

এই বিক্ষোভই ‘শূন্য কোভিড নীতির’মেরুদণ্ড গুড়িয়ে দেয়।

এর পর থেকে প্রতিটি প্রাদুর্ভাবে রোগী সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্য পরিত্যাগ করা হয়েছে, আর তাতে কোভিড-১৯ ছড়াচ্ছে দাবানলের মতো। এখন সরকারও এমন লাইন নিয়েছে, যেখানে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া খুব একটা উদ্বেগের নয় বলেই প্রচার করা হচ্ছে।

অথচ চীন তাদের কোভিড বিধিনিষেধগুলো আস্তে ধীরে তুলবে বলেই মনে করা হচ্ছিল।

অধ্যাপক চেন বলছেন, চীন যেসময়ে বিধিনিষেধ তুলেছে তা ‘উপযুক্ত না হলেও’ তাদের তা করতে হয়েছে।

এদিকে বেইজিংয়ের মতো অনেক শহরে প্রাদুর্ভাব মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

সরকার ‘বিক্ষোভকারীদের কথা শুনেছে’, কিন্তু সময় বিবেচনায় এটি বিধিনিষেধ তোলার আদর্শ সময় ছিল না, বলেছেন চেন।

এর মানে দাঁড়াচ্ছে, বিক্ষোভকারীরা হয়তো জিতেছেন, কিন্তু সরকার যে গতিতে বিধিনিষেধ তুলে নিচ্ছে তা বয়স্কদের বাড়ির বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভয়ও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

নাতিকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে বের হওয়া এক নারী বলেছেন, তিনি এখন ভিড় হয় এমন জায়গা থেকে দূরে থাকেন, সারাক্ষণ মাস্ক পরে থাকেন এবং নিয়মিত হাত পরিষ্কার করেন।

সমাজের সব গোষ্ঠীর আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে এমন জায়গাগুলোতে শারীরিক দূরত্ব, মাস্ক পরার নির্দেশনা মানার ক্ষেত্রে গাফিলতি দেখা যাচ্ছে। বেইজিংয়ে এসবের ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাবও পড়েছে।

বেইজিংয়ের রেস্তোঁরাগুলো ফাঁকা থাকার আরেকটি কারণ হচ্ছে, ভেতরে বসে খেতে হলে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে করানো শনাক্তকরণ পরীক্ষার ‘নেগেটিভ’ফল দেখানোর বিধান এখনও বলবৎ আছে। অবশ্য এখন বেশিরভাগ শনাক্তকরণ পরীক্ষার ফলও আর আগের মতো ফোনের অ্যাপে আসছে না।

দ্রুতগতিতে কোভিড ছড়াতে থাকায় ল্যাবগুলোতে এখন ব্যাপক কাজের চাপ সৃষ্টি হওয়ার এমনটা হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ঠাণ্ডা লাগার পর বাড়িতে আইসোলেশনে থাকা ৩৪ বছর বয়সী এক নারী বিবিসিকে বলেছেন, এখন পর্যন্ত তার অভিজ্ঞতা যথেষ্ট ভালো।

উপসর্গ যতটা খারাপ হবে বলে ভেবেছিলেন ততটা হয়নি, প্রয়োজনীয় সবকিছুও তার সঙ্গেই আছে, বলেছেন তিনি।

জনবহুল কোয়ারেন্টিন সেন্টারে না গিয়ে স্বামীর সঙ্গে বাড়িতে থেকে সুস্থ হয়ে উঠার সুযোগ পেয়ে তিনি বেশ খুশি।

অবশ্য তার দুশ্চিন্তাও কম নয়। তার এক বোন আছে, যার ছোট বাচ্চাকাচ্চা আছে, বাবা-মা বাড়িতে একা থাকেন, আছে দাদিও, এদের সবাইকে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই যেতে হবে।

চীনের চিকিৎসকরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোভিড আক্রান্ত হলে বাড়িতে থাকার ব্যাপারে লোকজনকে আশ্বস্ত করছেন।

রোগীর ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে কর্মকর্তারাও এখন কোভিড আইসোলেশন কেন্দ্রগুলোকে অস্থায়ী হাসপাতালে পরিণত করার কাজ শুরু করেছেন।

চলতি সপ্তাহে একদিনেই বেইজিংয়ে ২২ হাজার লোককে জ্বরজনিত কারণে ক্লিনিকে ভর্তি হতে চেষ্টা করতে দেখা গেছে।

এমন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন প্রশ্নও উঠছে।

কেন সরকার আগে থেকে এমন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিল না, কেন হাসপাতালের আইসিইউর পরিমাণ বাড়ানো হয়নি?

কেন বিধিনিষেধ তুলতে দেরি করা হল, যেখানে বিশ্বের বাকি দেশগুলো আগেই তা করে ফেলেছে?

কেন শি জিনপিং প্রশাসন ‘শূন্য কোভিড নীতির’ মাধ্যমে জনগণের জীবনযাত্রা ও অর্থনীতিতে বড় ধরনের ক্ষতির সুযোগ করে দিল?

বিধিনিষেধ তোলার সঙ্গে সঙ্গে চীনে নতুন করে টিকাদানের পরিমাণ বাড়ানোর চেষ্টাও শুরু হয়েছে; কিন্তু এই উদ্যোগ বিধিনিষেধ তোলার অনেক আগেই নেওয়া উচিত ছিল বলে মত বিশ্লেষকদের।

সরকার এখন বলছে, বিধিনিষেধ তোলার পেছনে মূল কারণ ভাইরাসের পরিবর্তন। এখন করোনাভাইরাসের যে ধরনটি ছড়াচ্ছে, তা তুলনামূলক কম বিপজ্জনক, যে কারণে তা মোকাবেলায় নেওয়া ব্যবস্থার পরিবর্তনেরও এটিই সঠিক সময়।

পরিস্থিতি নিয়ে অনেকে বেশ আশাবাদীও।

প্রবাসী চীনাদের একটি দল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম উইচ্যাটে একটি গ্রুপ খুলেছেন, যার মাধ্যমে চীনে বসবাসকারীরা অন্যান্য দেশে কোভিড আক্রান্ত ব্যক্তিদের অভিজ্ঞতা থেকে নিজেদের সমৃদ্ধ করতে পারছেন।

উদ্দেশ্য সরল- উত্তেজনা, আতঙ্ক কমিয়ে আনা। সবাইকে শান্ত রাখা।

এটা নিশ্চিত, আগামী কয়েক মাস চীনকে কঠিন সময় পাড়ি দিতে হবে। লাখ লাখ মানুষ আক্রান্ত হবে, অসংখ্য মৃত্যু দেখা যাবে বলে ধারণা বিবিসির।

তবে এটাও ঠিক, কোভিড মোকাবেলার পুরনো যে রীতি চীন নিয়েছিল, তা যে টেকসই নয় তা স্পষ্ট হয়েছে; অন্তত, মানুষ এখন মহামারী থেকে বের হয়ে আসার একটি পথ দেখতে পাচ্ছে।

Share if you like