কত স্বপ্নেই না ঘেরা থাকে শৈশব-কৈশোর। ভবিষ্যতে নিজেকে কোন পেশায় দেখতে চাই সে নিয়ে মনোজগতে চলে নানা জল্পনা-কল্পনা। তবে ক'জনই বা নিজের লালিত স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়ন করার সুযোগ পায়?
জীবনযুদ্ধে নিজের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে কেউ হন সফল, আবার অনেকের হয়তো সেভাবে আলোর মুখ দেখা হয়ে ওঠে না। শুনে আসা যাক তাদের গল্প যারা কৈশোরের লালিত স্বপ্ন সত্যিতে রূপায়ন করতে পেরেছেন কিংবা পারেননি। যারা পারেননি তারা কী থেমে থেকেছেন, নাকি এগিয়ে গেছেন নতুন উদ্দীপনায়?
লক্ষ্মীপুর সদরের একটি প্রাইমারি স্কুল, নাম কালিবৃত্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সে বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সোহেল মাহমুদ। পেশায় বর্তমানে শিক্ষক হলেও শুরুতে স্বপ্ন দেখেছিলেন বিসিএস ক্যাডার হওয়ার।
কৈশোরকাল থেকে যে স্বপ্ন তিনি বুনেছিলেন সেটি পূরণ হওয়ার দ্বারপ্রান্ত থেকে তাকে ফিরে আসতে হয়েছে। ৩৫তম বিসিএস এর প্রিলি, লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও ভাইভা বোর্ড থেকে ফিরে এসেছেন তিনি। ভাগ্যদেবতা এরপর আর সুপ্রসন্ন হননি।
তবে মানুষের জীবন থেমে থাকার নয়। সময় বহমান, তার সাথে সাথেই নিজের জীবনকে আবার ঢেলে সাজিয়েছেন তিনি। নিজেকে সংযুক্ত করেছেন শিক্ষকতার মতো মহান পেশার সাথে।
সোহেল মাহমুদের ভাষ্যে, “যখন বুঝতে পেরেছি নিজের লালিত স্বপ্ন আর পূরণ হওয়ার নয়, ঠিক তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছি অন্যের স্বপ্ন বাস্তবায়নের কারিগর হিসেবে কাজ করার।”
বর্তমানে তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যৎ আলোকিত করার উদ্দেশ্যে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন বটে। তবে কৈশোরের লালিত স্বপ্ন পুরণ না হওয়া উনার কাছে হিমালয়ের চূড়ার দ্বারপ্রান্তে পৌছেও হিমালয় বিজয় করতে না পারার মতোই।
আমাদের পরবর্তী সাক্ষাৎকার দাতার গল্পটা সফলতার। কৈশোর থেকে যে স্বপ্ন মনে লালন করে বড় হয়েছেন সেটিই তার বর্তমান পেশা।
ডা. এইচ এম মাহমুদ মোস্তফা, কর্মরত আছেন ঢাকা বারডেম হাসপাতালের ইউরোলোজি বিভাগে। তার ডাক্তার হতে চাওয়ার পেছনের গল্পটাও অন্যরকম।
শৈশবে বা কৈশোরে নিজেকে নিয়ে দেখা যে স্বপ্ন তার জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুপ্রেরণা জোগায় চারপাশের পরিবেশ। ডা. মাহমুদ নিজের স্বপ্ন বাছাই করার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন নিজের পরিবার থেকেই।
ডা. মাহমুদের নানা মারা যান ধনুষ্টংকার নামক রোগের কারণে। বড় হয়ে যখন মায়ের কাছ থেকে এই সম্পর্কে জানতে পারলেন ঠিক তখনই সিদ্ধান্ত নিলেন বড় হয়ে তিনি ডাক্তার হবেন। যাতে করে নিজেকে মানুষের সেবায় নিয়োজিত করতে পারেন।
যেই ভাবা সেই কাজ। কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে ছুঁয়ে নিয়েছেন নিজের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের চূড়া।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রায় সকল অভিবাবক বা ছাত্র-ছাত্রীরাই চান তাদের সন্তান বা তারা বড় হয়ে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবেন। তবে ক'জনই বা পারেন সে স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখতে? ভর্তিযুদ্ধ ও পারিপার্শ্বিক নানা সমস্যার কারণে সে স্বপ্ন অধরাই থেকে যায় অনেক তরুণ-তরুণীর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে পাশ করা এক তরুণের গল্পটাও কিছুটা এরকম। নাম মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, বর্তমানে কাজ করছেন স্বনামধন্য এক জাতীয় দৈনিকে। পেশায় সাংবাদিক হলেও সাইফুলের স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হবেন।
গল্পের সূত্রপাত ২০১৫ সালে। সেবার মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার কারণে অনেক মেধাবীরাই ঝরে পড়েন। সেই ঝরে পড়ার তালিকায় ছিলেন মোহাম্মদ সাইফুল ইসলামও।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির শুরুর এক বছর কিছুটা হতাশায় কাটে তার। পরিবারের অনুপ্রেরণায় দ্বিতীয়বার মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষাও দিয়েছিলেন, তবে বিধিবাম! দ্বিতীয়বারেও স্বপ্ন ছুঁতে পারেননি তিনি।
তবে না পাওয়ার বেদনা তাকে কখনও গ্রাস করতে পারেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষ থেকে পুরোনো স্বপ্নের পথে ইতি টেনে নতুন স্বপ্নের দিকে যাত্রা শুরু করেন।
সাংবাদিকতাকে অল্প অল্প করে বুঝতে শুরু করার মাধ্যমে সাংবাদিকতার জগতেই নিজের ভবিষ্যৎ বীজ বপন করার উদ্যোগ নেন। শুরুতে সামাজিক বিজ্ঞানের অন্তর্ভূক্ত এই বিষয়টি তেমন ভালো না লাগলেও পরবর্তীতে সাংবাদিকতাই হয়ে ওঠে সাইফুলের ভালো লাগার জায়গা।
সাইফুলের ভাষ্যে, “মেডিকেল সাইয়েন্স পড়ার ইচ্ছা থাকলেও পরবর্তীতে এসে মনে হয়েছে সেই জীবন ব্যবস্থায় নিজেকে মানিয়ে নিতে পারতাম না আমি।”
আমরা নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে কমবেশি সবাই স্বপ্ন দেখি। অনেক সময় কালের পরিক্রমায় সে স্বপ্ন হারিয়ে যায়, জীবনে যুক্ত হয় নতুন স্বপ্নেরা। স্বপ্নের ভাঙা গড়ার খেলায় অতিবাহিত হয় আমাদের জীবন।
তবে কৈশোর থেকে লালিত স্বপ্নটি ভাঙার থেকে পূরণ হওয়ার মুহূর্তটাই বুঝি বেশি আনন্দের। সে আনন্দেরই স্বাদ পেয়েছেন ড. তৌহিদুজ্জামান শুভ।
“আমি ২৪ ঘন্টার মধ্যে ১৬/১৭ ঘন্টা করে পড়াশোনা করেছি। ইঞ্জিনিয়ার হওয়াটা ছিলো আমার কাছে স্বপ্নের চেয়েও বেশি। সেই ১৩-১৪ বছর বয়স থেকে স্বপ্ন দেখেছি বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হবো। আমি অতোটা মেধাবী না, কিন্তু সেটিকে আমি আমার স্বপ্নের পথে বাঁধা হতে দেইনি। অন্যদের থেকে আমি দ্বিগুণ পরিশ্রম করেছি এবং শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছি।”
নিজের স্বপ্ন পূরণের গল্প এভাবেই বর্ণনা করছিলেন ড. তৌহিদুজ্জামান। তিনি খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে অর্জন করেছেন পিএইচডি ডিগ্রী। বর্তমানে সেখানেই কর্মরত আছেন।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির সাপেক্ষে বলা যায় ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে আত্মহত্যার পরিমাণ বেড়েই চলছে। একটুখানি খারাপ রেজাল্ট বা স্বপ্ন ভঙ্গের কারণে জীবন দিচ্ছেন অনেকেই।
যার জন্য এককভাবে কাউকেই দায়ী করা যায় না। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে চাকরী ব্যবস্থা সব কিছুর মধ্যেই সমস্যা বিদ্যমান। যার নবায়নকরণ খুব জরুরী। এর থেকেও বেশি দরকার শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে বিশেষ নজর প্রদান।
মানুষের জীবনের হার-জিত মুদ্রার এপিঠ ওপিঠের মতোই। সেখানে কেউ জয়ী হবেন, কেউ পিছিয়ে পড়বেন - সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই হেরে যাওয়াটি যেন কাউকে কখনও গ্রাস করতে না পারে। স্বপ্ন যাই থাকুক, সেটি নতুন করে দেখার কোনো নির্দিষ্ট বয়স নেই।
ফারজানা জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন।[email protected]