সূর্য ওঠার পর, অগাস্টের শেষদিকে এক সকালে, শ্রীলঙ্কার উত্তরপশ্চিম উপকূলের কাছে ছোট দ্বীপ মান্নারের সৈকতে ডজনখানেক জেলেকে দিনের শুরুর কাজ হিসেবে তাদের জাল বিছিয়ে রাখতে দেখা যায়।
এরা তুলনামূলক ভাগ্যবান, কেননা ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর এখনই সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে ভোগা দেশটিতে মুখ থুবড়ে পড়া এই জেলে সম্প্রদায়ের অনেকেই এখন আর সমুদ্রে যেতে পারছেন না। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
জ্বালানির ঘাটতি আর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়া মূল্যস্ফীতির অর্থ হচ্ছে- তারা কেরোসিন যোগাড় করতে পারছে না, যার কারণে মাছের খোঁজে নৌকা নিয়েও বের হওয়া হচ্ছে না তাদের, জুটছে না খাবারও।
“এই মুহূর্তে সবই কঠিন। কেরোসিন নেই, ঘরে কোনো খাবারও নেই। সমুদ্রে যেতে পারলেই আমাদের কাজ আছে, নাহলে কোনো কাজ নেই। আমরা ক্ষুধার্ত,” বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে এমনটাই বলেছেন ৭৩ বছর বয়সী সুসাইপিল্লাই নিকোলাস, যার ডাকনাম সোরনাম।
বয়সের কারণে এখন এমনিতেই সমুদ্রে যেতে না পারা সোরনামকে অবশ্য অর্থনৈতিক সংকট শুরুর আগে থেকেই খাদ্যের জন্য সংগ্রামে নামতে হয়েছিল। অগাস্টের ওই সকালেও তিনি থালভাপাডু সৈকতে এসেছিলেন শেষ পর্যন্ত সমুদ্রে যেতে পারা জেলেদের মাছ সংগ্রহ ও বাছাইয়ে সাহায্য করতে।
কেরোসিনের ঘাটতির কারণে যারা একসময় নিজেই নৌকা নিয়ে বের হয়ে পড়তে পারতেন, তাদের অনেককেও এখন একইভাবে জীবিকা নির্বাহ করতে হচ্ছে।
সমুদ্রে যাওয়া নৌকাগুলোতে বেড়েছে জেলের সংখ্যা, আগে যেখানে নৌকাপ্রতি ১৫ জেলে থাকতো, এখন হয়েছে ৪০।
লাভ বেশি হাতে চলে যাওয়ায়, সোরনামদের আয়ও দিন দিন কমছে। এখন তিনি কোনো কোনো দিন মোটে আড়াইশ রুপি কামাই করতে পারেন, অথচ সুসময়ে তার পকেটে প্রতিদিন এর দ্বিগুণ ঢুকতো।
অর্ধেক পেলেও তার প্রকৃত আয় আদতে আরও কম, কারণ এখন আগের বছরের তুলনায় মূল্যস্ফীতি ৬৫ শতাংশ, খাদ্যে মূল্যস্ফীতি চলে গেছে ৯৪ শতাংশের কাছাকাছি।
বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ফুরিয়ে যাওয়ায় এবং পরিশোধনাগারের জন্য অপরিশোধিত তেল আমদানি করতে না পারায় কয়েক মাস ধরে মান্নারে কেরোসিন ছিল না। সপ্তাহ আগে সরবরাহ ফের শুরু হলেও শ্রীলঙ্কা জ্বালানিতে ভর্তুকি তুলে নেওয়া শুরু করায় দাম আগের তুলনায় চারগুণ হয়ে গেছে।
“পেট্রল, ডিজেলের মতো দামি দামি জিনিস দরকার নেই আমাদের। অত্যাবশ্যকীয় কাজের জন্য আমাদের শুধু কেরোসিনই দরকার,” বলেছেন সোরনাম যে নৌকার মাঝিদের সহায়তা করতে এসেছেন, সেই নৌকার মালিক রাজা ক্রুজ।
মান্নারের সর্ব উত্তরপ্রান্ত থেকে ভারতের দূরত্ব ৩০ কিলোমিটারেরও কম; অর্থনৈতিক দুর্দশা কাটাতে দ্বীপটির অনেক পরিবার এরই মধ্যে ওই পথ পাড়ি দিয়ে প্রতিবেশী দেশটিতে ঢুকে পড়েছে, জানান ক্রুজ।
দ্বীপটিতে আগে প্রতি লিটার কেরোসিন ভর্তুকি মূল্যে লঙ্কান ৮৭ রুপিতে দেওয়া হতো, এখন এর দাম সরকারি পর্যায়েই ৩৪০ রুপি হয়ে গেছে।
কালোবাজারে কোথাও কোথাও তা এক হাজার ৮০০ রুপি দরেও বিক্রি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ক্রুজ।
“কেরোসিনের মূল্য পুননির্ধারণ অনেক বছর ধরেই বকেয়া ছিল। জিনিসপত্রের দাম পাল্লা দিয়ে বাড়ায়, সরকার নিম্ন আয়ের পরিবার, জেলে ও কৃষি খাত সংশ্লিষ্টদের, যারা কেরোসিনের ওপর নির্ভরশীল, তাদেরকে সরাসরি নগদ অর্থ ভর্তুকি দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে,” গত মাসে এক টুইটে বলেছিলেন লঙ্কান বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রী কাঞ্চনা বীজেসেকারা।
তবে মান্নারের পরিবারগুলো এখনও এ ধরনের কোনো সহায়তা পায়নি, জানিয়েছেন ক্রুজ।
তিনি জানান, থালভাপাডুতে বায়ু বিদ্যুতের টারবাইনগুলোর গুনগুণজাতীয় শব্দে মাছ তীরের কাছ থেকে সরে গেছে বলে বিশ্বাস জেলেদের। এদিকে কেরোসিনের ঘাটতি থাকায় জেলেরা সমুদ্রের বেশি গভীরে যেতেও পারে না, যে কারণে অল্প মাছ ধরেই ফিরতে হয় তাদের।
টারবাইনের কারণে মাছ সরে গেছে, জেলেদের এই অভিযোগ বিষয়ে অবগত আছেন জানিয়ে স্থানীয় মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা শরৎ চন্দ্রনায়েকা বলেন, এই বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে এবং এখন পর্যন্ত কিছুই প্রমাণিত হয়নি।
কেরোসিন সরবরাহ পুনরায় শুরু হওয়ার পর মান্নারের জেলেদের চাহিদার ৬০ শতাংশ পূরণ করা গেলেও বছরের শেষদিকে, মাছ ধরার মৌসুমে চাহিদার তুলনায় ঘাটতি অনেক বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা চন্দ্রনায়েকার।
ক্রুজ বলছেন, অনেক জেলেকেই এখন সৈকতের কাছে কাঁকড়া ধরার মতো ছোটখাট কাজ করে জীবনধারণ করতে হচ্ছে।
“কেরোসিন না থাকলে আপনি সমুদ্রে যেতে পারবেন না, বেশি দূর যেতে পারবেন না। ব্যক্তিগত পর্যায়ে কেরোসিন কিনতে গেলে দাম পড়বে এক হাজার ৮০০ রুপি। কোথায় ৮৭ রুপি আর কোথায় এক হাজার ৮০০, কত বেশি ভাবুন। আমরা বাঁচবো কীভাবে?,” বলেছেন তিনি।
সরবরাহ ফের শুরু হওয়ায় খানিকটা স্বস্তি মিললেও চড়া মূল্যস্ফীতির কারণে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস ও খাবার কিনতে হিমশিম খাওয়া জেলেদেরকে এখন কঠিন সব সিদ্ধান্তও নিতে হচ্ছে, বলেছেন ক্রুজ।
সূর্যাস্তের আগে আগে মাছ ধরার নৌকাগুলো যখন ফিরছিল, তখন একাধিক লোককে দাঁড় টেনে টেনে নৌকাগুলোকে তীরের দিকে নিয়ে আসতে দেখা গেছে।
একসময় অন্যদের মতোই কেরোসিনচালিত নৌকায় মাছ ধরতে যাওয়া পিটার জায়েম অ্যালান এখন এভাবেই জীবিকা নির্বাহ করছেন।
“আগে যখন কেরোসিন ছিল, তখন কোনো সমস্যাই ছিল না, আমরা বেরিয়ে পড়তাম। এখন কেরোসিন পেতে এত ঝক্কি, আমাদেরকে হিমশিম খেতে হচ্ছে, দাঁড় টানতে হচ্ছে,” বলেন অ্যালান।
নৌকা নেই এমন অনেক জেলেকে এখন অন্যদের নৌকায় করে মাছ ধরে লাভ ভাগাভাগি করে নিতে হয়।
এভাবেই দিন কাটছে ৩৫ বছর বয়সী ইবার্ট রাজিভানের; বেঁচে থাকার জন্য কখনো কখনো দিনমজুরিও করতে হয় তাকে।
“ব্যাপারটা হচ্ছে, কেরোসিন থাকলে আমরা প্রতিদিন কাজে যেতে পারবো। কেরোসিন না থাকলে আজ আমি এই দলের সঙ্গে মাঝ ধরতে গিয়েছি, কাল অন্যদেরকে অনুরোধ করতে হবে আমাকে নিতে।
“কখনো কখনো নৌকায় বেশি লোক হয়ে যায়। তখন আমাদেরকে ঘরে থাকতে হয় এবং মজুরিভিত্তিক যে কাজই পাওয়া যায়, তাই করতে হয়,” বলেছেন তিনি।