ক্রোয়েশিয়ার কাছে ব্রাজিলের হার অঘটনের সমানই বলা চলে দুই দলের শক্তিমত্তার বিচারে। তবে অপেক্ষাকৃত কম শক্তির দল নিয়েও নিজেদের সামর্থ্যের সেরাটা ঢেলে দিলে যেকোনো দলকেই হারানো যায়, তা আরো একবার প্রমাণ করে দেখালো ক্রোয়েশিয়া।
এদিকে একইদিনে লাতিন চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনার জয় ব্রাজিল সমর্থকদের গায়ে কাঁটার মতোই বিঁধবে হয়তো। তাই কীভাবে ক্রোয়েশিয়ার কাছে আত্মসমর্পণ করলো বিশ্বকাপের হট ফেভারিটরা, তা নিয়ে কাটাছেড়া চলবে আরো কিছুদিন।
ঠিক কোন কোন কারণে ম্যাচটি হেরে গেল ব্রাজিল? চলুন জানার চেষ্টা করা যাক।
জমাট ডিফেন্সের বিপক্ষে ব্রাজিলের দুর্বলতা স্পষ্ট হয়েছিল গ্রুপ পর্বের খেলাতেই। সার্বিয়া আর সুইজারল্যান্ডের ডিফেন্স ভেদ করতে তিতের দলকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ৭০ মিনিট পর্যন্ত। যদিও সার্বিয়ার বিপক্ষে খেলার শেষ ৩০ মিনিটে ভয়ংকর সুন্দর ফুটবলই খেলেছিল ব্রাজিল, তবে ক্যামেরুনের বিপক্ষে তা আর হয়ে ওঠেনি।
অবশ্য বেঞ্চের শক্তি পরীক্ষার দোহাই দিয়ে ক্যামেরুনের বিপক্ষে হার বড় করে দেখেননি অনেকেই, আর শেষ ১৬’তে দক্ষিণ কোরিয়াকে নিয়ে রীতিমতো ছেলেখেলাই করেছে সাম্বাবাহিনী। কিন্তু ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষেই মূলত বিশ্বকাপের প্রথম শক্ত পরীক্ষার মুখোমুখী হয়েছে ব্রাজিল।
ক্রোয়েশিয়া ৪-৩-৩ ফর্মেশনে দল সাজালেও ডিফেন্ড করেছে ৪-৪-২ আকারে। আর এই ফর্মেশন দেখেই আন্দাজ করা যাচ্ছিল তাদের মূল লক্ষ্য ব্রাজিলকে গোল করতে না দেয়া। সেই সাথে কাউন্টার অ্যাটাকে গোল করে ফেলতে পারলে তা হতো সোনায় সোহাগা। পুরো ম্যাচ জুড়েই ক্রোয়েশিয়ার ডিফেন্স দুই স্তরে অর্গানাইজড থেকে ব্রাজিলের গতিময় ফরোয়ার্ডদের ঠেকিয়ে রেখেছে।
ক্রোয়েশিয়ার দুই ফুলব্যাক পেরিসিচ আর জুরানোভিচের আলাদা করে প্রশংসা না করলেই নয়। নিজেদের রক্ষণ সামলে নেবার পাশাপাশি তারা নিয়মিত বিরতিতে ভয় ধরিয়েছেন ব্রাজিলের রক্ষণেও। যখনই ব্রাজিলের পায়ে বল, ক্রোয়েশিয়ান খেলোয়াড়রা চেষ্টা করেছে সবাই বলের পেছনে থাকতে; এতে করে ১২০ মিনিট জুড়ে ২১টি শট করা ব্রাজিল গোল করতে সক্ষম হয়েছে কেবল একবার।
ব্রাজিলের হারের আরেকটি বড় কারণ মাঝমাঠের দুর্বলতা। মদ্রিচ, কোভাচিচ আর ব্রোজোভিচদের মধ্যমাঠে মোটেই সুবিধা করতে পারছিলেন না ব্রাজিলের দুই পিভট কাসেমিরো আর পাকেতা। পুরো প্রথমার্ধই তারা ছিলেন নিষ্ক্রিয়, সাথে নেইমারও তার জাদু দেখানোর সুযোগ পাননি।
এখানে ব্যর্থতার দায়ভার ব্রাজিল কোচ তিতেকে নিতেই হচ্ছে। এমনিতেই একজন সেন্ট্রাল মিডফিল্ডারের অভাবে থাকা ব্রাজিল মাঝমাঠে এসেই বল হারাচ্ছিল বারবার। এই প্রজন্মের অন্যতম সেরা মিডফিল্ডার লুকা মদ্রিচের কাছেই তো হার মেনেছে কাসেমিরো আর পাকেতারা, সেই সাথে নেইমারও।
মদ্রিচের মতো একজন সৃজনশীল মিডফিল্ডার না থাকায় নেইমারের কাঁধেই দায়িত্ব ছিল ব্রাজিলের ডিফেন্স আর অফেন্সের মাঝে মেলবন্ধন ঠিক করে দেয়ার। কিন্তু প্রথমার্ধে যখন বোঝা গেল তা ঠিক কাজে আসছে না, ব্রাজিল কোচের হাতে ছিল ব্রুনো গুইমারেজের মতো চমৎকার অপশন যে কিনা মধ্যমাঠে ব্রাজিলের বল দখল আরো পোক্ত করে দলকে ৯০ মিনিটেই জয়ের কাছে নিয়ে যেতে পারতো। অবাক করার ব্যাপার হলো ব্রুনোকে অতিরিক্ত ৩০ মিনিটেও মাঠে নামাননি তিতে।
নির্ধারিত ৯০ মিনিট এবং অতিরিক্ত ৩০ মিনিটে খেলা শেষ করে আসাই ছিল ব্রাজিলের লক্ষ্য। শেষ দিকে মুহুর্মুহু আক্রমণ করে সে লক্ষ্যে পৌঁছেও গিয়েছিল ব্রাজিল। লং বল কিংবা শর্ট পাস, ওয়ান-টু-ওয়ান বিল্ডআপ, সবকিছু করেও যখন কাজ হচ্ছিল না, নেইমার তখন তা-ই করেছিলেন যা এসব খেলায় দরকার হয় - একটি জাদুকরী মূহুর্ত।
ম্যাচের ১০৬ মিনিটে নেইমারের গোলটিকে জাদুকরী না বললে কমই বলা হতো। বাকি ১৫ মিনিট অনায়াসে রক্ষণে মনোযোগ দিয়ে সেমিফাইনালের প্রস্তুতির কথা ভাবতে শুরু করতে পারতো ব্রাজিল। কিন্তু একটি গোল পেয়ে খানিকটা আত্মবিশ্বাসের জোয়ার এসেছিল কিনা কে জানে, ব্রাজিলের রক্ষণে ঠিকই চির ধরিয়ে দিলেন ক্রোয়েশিয়ার পেকটোভিচ, যার কারিগর মাঝমাঠের জাদুকর মদ্রিচ।
ব্রাজিল ও পিএসজির ডিফেন্ডার মার্কিনিয়োসের ভুলটাকে কেবল ব্রাজিলের দুর্ভাগ্যের প্রতীক হিসেবেই ধরে নেয়া যেতে পারতো। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, অতিরিক্ত সময়ে গড়ানো খেলায় ১ গোলে এগিয়ে গিয়ে রক্ষণ ওভাবে খালি রেখে দেয় কোন দল?
পেনাল্টি শ্যুটআউটে ব্রাজিলের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকেছেন কোচ নিজেই যখন তিনি ২২ বছর বয়সী অনভিজ্ঞ রদ্রিগোকে পাঠিয়ে দিলেন প্রথম পেনাল্টি শটের জন্য।
স্নায়ুক্ষয়ী মুহুর্তে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা ক্রোয়েট গোলকিপার লিভাকোভিচের হাতে রদ্রিগোর দুর্বল পেনাল্টি শট ধরা দিলে ব্রাজিলের বিদায়ের ঘন্টা সেখানেই বেজে ওঠে। অন্যদিকে টাইব্রেকারে অভিজ্ঞ ক্রোয়েশিয়ানরা নিজেদের শট প্রতিটিই দক্ষভাবে জালে জড়িয়েছেন। মার্কিনিয়োস ব্রাজিলের চতুর্থ পেনাল্টি মিস করলে শেষ শটের আর প্রয়োজনই হয়নি লুকা মদ্রিচের দলের।
কেন নেইমার নিজে প্রথম শট নিয়ে দলের মনোবল চাঙা করলেন না? মার্কিনিয়োসের সে ভুলটা না হলে কি হতো? দ্বিতীয়ার্ধেও কেন মাঝমাঠ নিয়ে নতুন কোনো কৌশলে ছক কষতে পারলেন না কোচ তিতে? এরকম আরো অনেক কেন’র উত্তর না দেয়াই থেকে যাবে।
তবে দিনশেষে ফুটবল খেলা এমনই। এখানে কখনো কখনো ভাগ্যের কাছে পরাজয় স্বীকার করতে হয়। প্রথমার্ধ বাদ দিলে ব্রাজিল তো খেলেছে ক্রোয়েশিয়ার চেয়ে ঢের ভালো, এখানে সেখানে সাম্বার ছন্দ দেখা মিলেছে, নেইমার তার সামর্থ্যের সবটুকুই করেছেন, কিন্তু সুন্দর ফুটবলই কি সবসময়ই জেতে?
ফুটবলের সৌন্দর্যই তো এখানে - অবিশ্বাস্য আর নির্মম। বিশ্বকাপে সবচেয়ে সুন্দর ফুটবল খেলা দলের তাই রিক্ত হাতে ফিরতে হচ্ছে টাইব্রেকার নামক লটারিতে হেরে গিয়ে। ফুটবল খেলাকে পর্তুগীজ ম্যানেজার হোসে মোরিনিওর উক্তির চেয়ে ভালো সংজ্ঞায়িত আর কে কবে করতে পেরেছে?
“ফুটবলে অনেক শিল্পী আছেন, কিন্তু তারা ট্রফি জেতেন না খুব বেশি।”