Loading...
The Financial Express

কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া: ভাটির দেশের কুড়া পক্ষীদের আখ্যান

| Updated: January 18, 2023 20:00:04


ছবি: চ্যানেল আই অনলাইন ছবি: চ্যানেল আই অনলাইন

পথের কেনারে দাঁড়ায়ে রয়েছে আমার ধানের ক্ষেত,

আমার বুকের আশা-নিরাশার বেদনার সঙ্গেত। ’

ধান ক্ষেত

- জসীমউদ্দীন

ধান-‌বুকের ভেতরে কত শত মানুষের আশা, নিরাশা,ভালোবাসা, সংগ্রাম জমিয়ে জন্ম নেয় আমাদের এই খাদ্যশস্য। এই ভাতের কারিগর, ধান রোপনের মহাকাব্যের নেপথ্যে থাকা মানুষগুলোর গল্পকে গরম ভাতের ঘ্রাণের মত আপন করার উদ্দেশ্যেই যেন ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’ চলচ্চিত্রের জন্ম।

সম্প্রতি কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের ‘ইন্টারন্যাশনাল কম্পিটিশন: ইনোভেশন ইন মুভিং ইমেজ’ বিভাগে সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার অর্জন করেছে মুহাম্মদ কাইউম পরিচালিত ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’

‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’ - চলচ্চিত্রের নামকরণের ভেতরেই যেন লুকিয়ে আছে হাজারো গল্প। চলচ্চিত্রের শুরুতেই ছোট্ট রুকু পরিচয় করিয়ে দেয় কুড়া পক্ষীর সাথে। কুড়া পক্ষী জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার জন্য লড়াই করছে, শূন্যে উড়ছে। সমান্তরালভাবে, মানুষও দু'মুঠো ভাতের জন্য বাস্তু ছাড়ছে, অসীমের পানে উড়ে চলেছে হাজারো মানুষ। চলচ্চিত্রের নামের ভেতরে লুকিয়ে থাকা প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্কের গভীর দৃষ্টিকোণকে বারবার এই চলচ্চিত্রে ফ্রেমবন্দী করা হয়েছে। 

‘ভাটির দেশে মাটির গল্প’ বলতে আসা কুড়াপক্ষীর শূন্যে উড়া যেন ভাটি বাংলার কৃষিজীবী মানুষের চিরকালীন জীবন সংগ্রামের আখ্যান। হাওর অঞ্চল ও হাওর অঞ্চলের জনপদের গল্পকে প্রথমবারের মত সেলুলয়েডে অত্যন্ত সততার সাথে এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। 

কুড়া পক্ষীর মতোই ভেসে আসা মানুষ ছিলো সুলতানা। সুদূর নেত্রকোণা থেকে মাতৃহারা, স্নেহহীন সুলতান হাওরে এসেছিলো দু’বেলা দু’ মুঠো ভাতের সন্ধানে। কিন্তু ভাত যে স্নেহময়, এ হাওরের হাওয়ায় বেড়ে ওঠা ছোট্ট রুকু আর তার মায়ের সুলতানের শানকীতে তুলে দেওয়া দু’মুঠো ভাত যেন ভালোবাসার নৈবেদ্য হয়ে সুলতানের জীবনে। সুলতানের সাথে দর্শকও হাওরের ভাসমানতায় নৌকোয় ভেসে ভেসে জীবন ধারণের সৌন্দর্য ও বিষণ্ণতায় আবৃত হতে থাকে। 

জীবনের উত্থান-পতন, আনন্দ-দুঃখ, স্নেহ-মমতা, নিষ্ঠুর বাস্তবতা, জীবন-মৃত্যু, শোক-উৎসব, ঘটন-অঘটন সব বৈপরীত্যময় অনুভূতিকে মিলেমিশে একাকার করে দিয়ে এই চলচ্চিত্র হাওরের মানুষের জীবন সংগ্রামকে প্রকৃত অর্থেই ধারণ করেছে। জোয়ার ভাটার মতো নিরাশা আর আশা যেন পারস্পরিকভাবে পুরো চলচ্চিত্রে দেখা যায়। চিত্রগ্রাহক মাজহারুল রাজুর নৈপুণ্যে যেন সেই সুখ-দুঃখ দর্শকের ভেতরে গিয়ে আঘাত করতে সক্ষম হয়েছেন।

দীর্ঘ আড়াই বছরের শুটিংয়ের সময়কালে হাওরের ঋতু পরিবর্তন, হাওরের মেঘ, জল, প্রকৃতি এমনভাবে জীবন্ত যেন চোখের সামনে হাওরে মেঘ জমে বৃষ্টি নামছে,হাওরের থৈ থৈ জল ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে। সেই থৈ থৈ জল যেন নিরাশার অতল সমুদ্র, সেখানে যখনই একটু করে জ্বলে উঠে আশার প্রদীপ, নিভে যায় পরক্ষণেই। ওই এক মুহূর্তের আশার প্রদীপের আলোর অপেক্ষাতেই যেন গোটা জীবন পেরিয়ে যায় হাওরের মানুষগুলোর।

মানবজীবন ও প্রকৃতির গভীর সম্পর্ক যেন সুতোয় যত্নে বোনা হয়েছে চলচ্চিত্রে। কোমরে ঝুনঝুনি থাকা ছোট্ট আবুর মৃত্যু হলো যে জলে, সে জলে দোদুল্যমান ভেসে বেড়াচ্ছে কিছু ছোট্ট হাঁসের বাচ্চা। মানুষ মৃত্যুতে অভ্যস্ত হয়ে আছে, আচ্ছন্ন হয়ে আছে। কিন্তু তবুও তো বেঁচে আছে, বেঁচে থাকাই বাস্তব। সে বাস্তবে মৃত্যুর শোক কাটিয়ে বেদনার সঙ্গীতের সুরের মাঝে উৎসবও আসে, ধামাইল গানের তালে তালে সুলতান আর রুকুর মায়ের বিয়ে হয়ে। আবার আশার প্রদীপ জ্বলে। কিন্তু মৃত ধানকে জড়িয়ে ধরে মৃত সন্তানের মতো আগলে সুলতানের হাহাকারে আবার সে প্রদীপ নিভে যায়।

নিরাশার পাথারে ভাতের বলকের ঘ্রাণে যেন বাস্তু হারানোর দুঃখ ভর করে। মাকড়সার জালের মত যত্নে বোনা হাওরের সংসার ছেড়ে পুরো পরিবার কুড়া পক্ষীর মত শূন্যে উড়ে যায় অসীমের পানে। একটা ঢেউয়ের ধাক্কায় দুলতে থাকা নৌকায় দাঁড়িয়ে রুকুর মায়ের ফেরার আকাঙ্খা বাস্তুচ্যুত হওয়া সংসারের অনিশ্চিয়তার অনুভূতিকে দর্শকের মননে আরও প্রগাঢ় করে তোলে।

ডকুড্রামা স্টাইলের নির্মিত এই চলচ্চিত্রকে সৎ ও বাস্তবভাবে তুলে ধরা সম্ভব হয়েছে যেমন নির্মাতা ও চিত্রগ্রাহকের নৈপুণ্যে, তেমনিভাবে জয়িতা মহলানবীশ, উজ্জ্বল কবীর হিমুর নিজেদের সবটা উজাড় করে রুকুর মা, সুলতান হয়ে উঠতে পারার কারণেও। ডকুড্রামা স্টাইল আর তথ্যবহুল সংলাপের কারণে কিছুটা সাবলীলতা হারালেও কখনো চলচ্চিত্রটি অসংলগ্ন হয়ে ওঠেনি, পরিমিতিবোধ হারায়নি।

চলচ্চিত্রে নির্মাতা মুহাম্মদ কাইউম খুব সূক্ষ্মভাবে আবেগ এবং বাস্তবতার ভারসাম্য বজায় রেখেছেন।

তেলসন্ধি পূজার মাধ্যমে ধানের জন্য মঙ্গল কামনা করে,‌ ধানক্ষেতে ছাতা মাথায় হাঁটাকে ধানের অপমান মানে, ধানকে ঘিরেই তাদের ধর্মচর্চা, ধর্মীয় সম্প্রীতি এবং জীবনদর্শনকে চিত্রিত করেছেন। সেই সাথে হাওর অঞ্চলকেন্দ্রিক রাজনীতি, ক্ষুদ্রঋণ, ইজারা, বৈশ্বিক আবহাওয়া বিপর্যয়, প্রাকৃতিক দূর্যোগকে হাওর বাস্তবতায় প্রকৃত খলনায়ক হিসেবে তুলে ধরেছেন তিনি।

চলচ্চিত্র নির্মাণের অনুপ্রেরণা হিসেবে মুহাম্মদ কাইউম জানান, “আমার আগ্রহ ছিলো মানুষের জীবন, বিশেষ করে এই দেশের ভিত্তিমূলে চালিকাশক্তি হিসেবে থাকা কৃষক বা শ্রমজীবী মানুষের জীবনের বৈচিত্র্য আমাকে আকৃষ্ট করতো। সে আকর্ষণ থেকেই দেশের প্রান্তিক হাওরের মানুষের কাছে পৌঁছে তাদের জীবনযাপন দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই। দারিদ্র্য আর প্রকৃতির সাথে তাদের দ্বিমুখী লড়াই আমার কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া তৈরির প্রেরণা যোগায়। ”

চলচ্চিত্রটির সিক্যুয়েল নির্মাণ সম্পর্কে তিনি জানান, “এই শ্রমজীবী মানুষদের শহরে প্রাচুর্যতার পৃথিবীতে জীবন সংগ্রামের গল্প নিয়ে এই চলচ্চিত্রের ২য় অংশ নির্মান আমার পরবর্তী প্রজেক্ট।”

‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’ ভাটির দেশের মাটির মানুষদের ঘ্রাণমাখা চলচ্চিত্র হয়ে উঠতে পেরেছে, বাস্তুচ্যুত কুড়া পক্ষীদের প্রতিনিধিত্ব করতে পেরেছে- নির্মানের উদ্দেশ্যের প্রতি সৎ থাকতে পারাই নির্মাতা হিসেবে মুহাম্মদ কাইউমের সার্থকতা।


নওরীন সুলতানা (তমা) বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত।

[email protected]

Share if you like

Filter By Topic