Loading...
The Financial Express

কীভাবে রাসায়নিকের ব্যবহার ছাড়াই মমি তৈরি করতো মিশরীয়রা?

| Updated: January 18, 2023 17:03:56


কীভাবে রাসায়নিকের ব্যবহার ছাড়াই মমি তৈরি করতো মিশরীয়রা?

জন্ম হলেই যে মৃত্যুর স্বাদ নিতে হবে, এ সত্যকে মেনে নিতে চায়নি হয়তো কেউ কেউ। আর তাই তো যুগে যুগে অমরত্ব লাভের জন্য অদ্ভুতুড়ে সব কাণ্ড করেছে বিশ্বের নানা প্রান্তের নানান মানুষ। আলকেমির কারিকুরি, কালোজাদু আর অপশক্তিতে বিশ্বাস, জড়িবুটির বুজরুকি – কত কি-ই না করেছে মানুষ অমর হতে; বলা বাহুল্য, সাফল্য আসেনি কখনো। 

কিন্তু মরে যাবার পর পচনশীল দেহকে কী বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব যুগ যুগ ধরে? এক্ষেত্রে সাফল্য এসেছে, এবং তা প্রাচীন মিশরীয়রা করেছে ভালোভাবেই। পচন রোধে ফরমালিন আর অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্যাদির ব্যবহার শুরুর কয়েক হাজার বছর আগে মিশরীয়রা কীভাবে করতো এ কাজ? মৃতদেহকে কোনো রাসায়নিক ছাড়াই মমি বানিয়ে কেমন করে সংরক্ষণ করতো তারা যা হাজার বছর পরেও অক্ষত থেকে যায়?

কেন তৈরি করা হতো মমি?

মমিকরণকে যত অদ্ভুত আর ভীতিকরই আখ্যা দেয়া হোক না কেন, প্রাচীনকালে এটি একটি মর্যাদাপূর্ণ ঐতিহ্য ছিল। ধর্ম, মৃত্যু পরবর্তী জীবন আর সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাস থেকেই মানুষ মমি তৈরি করতো। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী এটি একটি পবিত্র প্রক্রিয়া এবং পুরোহিতগণ এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতেন নানান আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। 

প্রাচীন ইনকা সভ্যতা, চীনা সভ্যতাসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে নানান জাতির মাঝেই মমিকরণের রীতি প্রচলিত ছিল। এক্ষেত্রে সবচেয়ে সফল মিশরীয়রা।

মমি তৈরির প্রক্রিয়া

মারা যাবার পর মানুষের শরীরে পচন প্রক্রিয়া শুরু হতে কয়েক মিনিট সময় নেয় কেবল। হৃদযন্ত্র রক্ত সঞ্চালন বন্ধ করলে শরীরের বিভিন্ন কোষে অক্সিজেন প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায় এবং ‘অটোলাইসিস’ নামক পচনপ্রক্রিয়া শুরু হয়। 

মৃতদেহকে মমিতে রূপান্তর করার মূলে আছে মূলত এই প্রক্রিয়া ঠেকানোর প্রচেষ্টা। কোনোরূপ গবেষণা থেকে এরকম প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল কিনা সে সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা যায় না। তবে প্রাচীন মিশরীয়দের মমি তৈরির প্রক্রিয়া ছিল সবচেয়ে উন্নত, টেকসই, এবং সহজও বটে। তাদের প্রক্রিয়ার দুটো প্রধান ধাপ ছিল - দেহের সকল আর্দ্রতা শুকিয়ে ফেলা এবং প্রাকৃতিক প্রিজারভেটিভ (সংরক্ষণকারী দ্রব্য) ব্যবহার করা। 

ইতিহাসবিদ হেরোডোটাসের তথ্য অনুযায়ী মিশরীয়রা মমি তৈরির প্রথম ধাপে মস্তিষ্ক ফেলে দিতো কারণ নিউরনগুলোয় সবচেয়ে দ্রুত পচন ধরে। তবে মস্তিষ্ক ফেলতে গিয়ে মাথাটাকে বিকৃত করে ফেললে তো চলবে না। তাহলে উপায়?

হেরোডোটাসের মতে মৃতদেহের নাক দিয়ে ধাতব বস্তু প্রবেশ করিয়ে মাথার খুলিতে ছিদ্র তৈরি করা হতো এবং নাক দিয়ে মস্তিষ্ক তরল পদার্থের মতো ঝরিয়ে ফেলা হতো! অতঃপর পচন প্রক্রিয়া বন্ধ করতে খুলির ভেতর রেজিন ভর্তি করে দেয়া হতো। 

মস্তিষ্কের পরই দ্রুত পচনশীল অঙ্গ হিসেবে যকৃত আর অন্ত্রকে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হতো কেননা এদের ভেতর পচনক্ষম এনজাইম এবং ব্যাকটেরিয়া থাকে। পুরোহিতগণ তাই ফুসফুস, যকৃত, অন্ত্র সহ পাকস্থলীর সকল অঙ্গ দেহে থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতেন। 

প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় হৃদযন্ত্রের ভেতরে মানুষের আত্মা থাকে বলে বিশ্বাস করা হতো। তাই পাকস্থলী কেটে অন্যান্য অঙ্গ যাচ্ছেতাইভাবে বের করে আনলেও হৃদযন্ত্র অক্ষত রাখবার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হতো। অনেকক্ষেত্রে অন্যান্য অঙ্গ বের করে আনার পর হৃদযন্ত্র পুনঃরায় ভেতরে রেখে দেয়া হতো। 

ফুসফুস, যকৃত আর হৃদযন্ত্র মমির কক্ষেই কাঁচের জারে নেট্রন নামক এক প্রকার লবণের দ্রবণে ডুবিয়ে সংরক্ষণ করে রাখা হতো। নেট্রন হলো একপ্রকার প্রাকৃতিক খনিজ যাতে সোডিয়া কার্বোনেট ডেকাহাইড্রেট, সোডিয়াম বাইকার্বোনেট, সোডিয়া ক্লোরাইড, সোডিয়াম সালফেটসহ কয়েকপ্রকার লবণ বিভিন্ন অনুপাতে থাকে। 

এই ক্ষারীয় প্রকৃতির লবণ মানব অঙ্গের পচনসৃষ্টিকারি ব্যাকটেরিয়া মেরে ফেলে। শুধু তা-ই নয়, দেহের ভেতরে থাকা ফ্যাট এবং অনুরূপ ফ্যাটি পদার্থের সাথে বিক্রিয়া করে তাদেরকে একপ্রকার সাবান সদৃশ কঠিন বস্তুতে পরিণত করতে পারে নেট্রন। ফলে মমির আকৃতি বজায় রাখতেও সহায়তা করে এই লবণ। 

পাকস্থলী খালি হয়ে গেলে মৃতদেহকে ভালো করে ধুয়ে জীবাণুমুক্ত করে পাকস্থলীর ভেতরে শুষ্ক নেট্রন দিয়ে ভরে দেয়া হতো এবং একটি লম্বাকৃতির পাত্রে মৃতদেহটিকে ৩০ থেকে ৪০ দিন নেট্রন দিয়ে ডুবিয়ে রাখা হতো। এই নির্ধারিত সময় পর যখন নেট্রনের স্তূপ থেকে মৃতদেহটি বের করা হতো, ততদিনে এটি সকল আর্দ্রতা হারিয়ে শুষ্ক ও বাদামী রঙ ধারন করতো। একে তখন মমিই বলা চলে। 

অবশ্য নেট্রনে ডুবে থাকায় মমির দেহে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হতো। এই দুর্গন্ধ দূর করতে পুরো দেহে রেজিন, সিডার অয়েল সহ আরো কিছু প্রাকৃতিক প্রিজারভেটিভের ঘন মিশ্রণ ঢালা হতো। মিশ্রণটি দেহে শুকিয়ে গেলেই মমিকে সাদা লিনেন কাপড়ে মুড়িয়ে ফেলা হতো। ব্যস, হয়ে গেলো মমি! 

মিশরীয়দের এই মমিকরণ প্রক্রিয়া ছাড়াও আধুনিককালে অনেক মমি আবিষ্কৃত হয়েছে যেগুলো তৈরি হয়েছিল সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে। প্রচণ্ড ঠান্ডায় জমে গিয়ে কিংবা ভীষণ শুষ্ক আবহাওয়ায় অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদানের ভারসাম্যপূর্ণ পরিস্থিতিতে মৃতদেহ মমিতে রূপান্তরিত হয়েছে যা বহু বছর পর আবিষ্কৃত হয়েছে। 

প্রাচীনতম মমি

এখনো পর্যন্ত আবিষ্কৃত প্রাকৃতিক মমিগুলোর মাঝে প্রাচীনতম মমিটি পাওয়া গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের নেভাডার একটি গুহায় যা রেডিওকার্বন পরীক্ষায় ১০ হাজার বছর পূর্বের বলে প্রতীয়মান হয়েছে। মিশরীয় সভ্যতার প্রাচীনতম মমির বয়স সাড়ে ৫ হাজার বছরের মতো। স্পষ্টতই মিশরীয়দের বহু আগে থেকে মমি তৈরি করতে শিখেছিল মানবজাতি। 

অবশ্য পৃথিবীতে প্রথমবারের মতো মমি তৈরির ঘটনাটি চিলির আতাকামা মরুভূমিতে ঘটেছিল বলে মনে করা হয়, যে অঞ্চলটি পৃথিবীর শুষ্কতম স্থান হিসেবেও পরিচিত। 

ধারণা করা হয়ে থাকে, কেবল মিশরীয়রাই তাদের ৩ হাজার বছরের সভ্যতায় ৭ কোটির অধিক মমি তৈরি করেছে। তুতেনখামুন কিংবা রামেসিসের মতো ফারাওদের মমি এখন জাদুঘরে দেখতে পাওয়া গেলেও অধিকাংশই যথার্থ সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। মিশরে পাওয়া মমিগুলোর একটা বড় অংশ পশুপাখিরও, বিশেষ করে বিড়ালের। 

[email protected]

Share if you like

Filter By Topic