করোনাভাইরাস মহামারী শুরুর তিন বছর পর নতুন এক উপধরন উদ্বেগ ছড়াচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে, এর প্রভাবে দেশটিতে সংক্রমণ বাড়ছে ব্যাপকভাবে।
এক্সবিবি.১.৫ নাম পাওয়া এ ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ যুক্তরাজ্যেও ধরা পড়েছে।
নতুন এই উপধরনের বৈশিষ্ট্য কী? সংক্রমণ কতটা গুরুতর হয়? কোভিডের বিরুদ্ধে গত তিন বছর ধরে নেওয়া প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা এতে কাজে আসবে? এসব প্রশ্নের উত্তর তুলে ধরা হয়েছে বিবিসির এক প্রতিবেদনে।
এক্সবিবি.১.৫ কী
করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে ২০২১ সালের শেষ দিকে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ ছড়িয়েছিল ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট; আর ওমিক্রনেরই তুতো ভাই হল এক্সবিবি.১.৫। ওমিক্রন শনাক্ত হওয়ার পর সেটি সংক্রমণের গতিতে করোনভাইরাসের আলফা, বেটা, গামা এবং ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সেইসঙ্গে অনেক সাব-ভ্যারিয়েন্টেরও জন্ম দিয়েছে ওমিক্রন।
বিবিসি জানিয়েছে, ওমিক্রনের অন্যান্য ধরনে আক্রান্তদের শরীরে যেসব লক্ষণ দেখা গেছে, নতুন এক্সবিবি.১.৫ এর সংক্রমণেও একই উপসর্গ রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর লক্ষণ ঠাণ্ডা জ্বরের মত।
কতোটা ভয়ের?
করোনাভাইরাসের এক্সবিবি ধরন থেকে বিকশিত হয়েছে এক্সবিবি.১.৫। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাজ্যে সংক্রমণ ছড়াচ্ছিল এক্সবিবি।
এক্সবিবির একটি মিউটেশন মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছিল, কিন্তু মানুষের কোষে আক্রমণ করার শক্তি কমে এসেছিল সেই সাব ভ্যারিয়েন্টের।
লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের অধ্যাপক ওয়েন্ডি বারক্লে বলেন, এক্সবিবি.১.৫ উপধরনেরও এফ৪৮৬পি নামে মিউটেশন রয়েছে, যা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে কোষকে আক্রান্ত করার শক্তি ফিরে পায়। ফলে খুব সহজেই এটি ছড়ায়।
তিনি বলেন, মিউটেশনের এই ধারা বা ক্রমবিকাশ ‘স্টেপিং স্টোন’ এর মত, অর্থাৎ শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা উপেক্ষা করার নতুন পথ খুঁজে ধাপে ধাপে এটা বিকাশ লাভ করে।
কেমব্রিজের ওয়েলকাম স্যাঞ্জার ইনস্টিটিউট ভাইরাসের ধরনগুলো শনাক্তের চেষ্টা অংশ হিসেবে সপ্তাহে ৫ হাজার নমুনা থেকে জেনেটিক সিকোয়েন্স তৈরি করছে। ইনস্টিটিউটের ডা. ইওয়ান হ্যারিসন মনে করেন, সম্ভবত ওমিক্রনের দুটি ভিন্ন ধরনে আক্রান্ত কারও শরীর থেকে এক্সবিবি.১.৫ উপধরনের উদ্ভব হয়।
“একটি ভাইরাসের জিনোমের কিছু অংশ এখানে দ্বিতীয় ভাইরাসের জিনোমের কিছু অংশের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। নেতুন ধরনের মধ্যে দুই বৈশিষ্ট্যই মিলে গেছে। এখন এটা ছড়াচ্ছে।”
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নিশ্চিত করেছে, এখন পর্যন্ত দেখা অন্যান্য উপধরনের তুলনায় এক্সবিবি.১.৫ ধরনের ছড়ানোর সুযোগ বেশি। তবে সংস্থাটি এও বলেছে, আগের ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় এটি আরও গুরুতর বা ক্ষতিকর হবে কিনা, সেরকম কোনো ইঙ্গিত এখনও মেলেনি।
এক্সবিবি.১.৫ কোথায় ছড়াচ্ছে?
বিবিসি জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে এখন যত কোভিড সংক্রমণ হচ্ছে, তার ৪০ শতাংশ এক্সবিবি.১.৫ উপধরনের কারণে হচ্ছে। সে হিসেবে এ ধরনটিই এখন সবচেয়ে বেশি দাপট দেখাচ্ছে।
গত ডিসেম্বরের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রে ৪ শতাংশ সংক্রমণের কারণ ছিল এই এক্সবিবি.১.৫। তাতেই বোঝা যাচ্ছে, নতুন এ ধরন খুব দ্রুত ওমিক্রমনের অন্যান্য ধরনকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে গত কয়েক সপ্তাহে কোভিড হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এ পরিস্থিতিতে সরকার ফের গণ কোভিড পরীক্ষা চালু করেছে।
যুক্তরাজ্যে ছড়াতে পারে?
যুক্তরাষ্ট্রে এক্সবিবি.১.৫ উপধরনের প্রভাব বেশি দেখা যাচ্ছে, তবে যুক্তরাজ্যও পরিস্থিতি সেরকম হতে পারে। ২০২২ সালে যুক্তরাজ্য পাঁচ বার ওমিক্রনের সংক্রমণের ঢেউ দেখেছে এবং আরেকটি ঢেউ অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে।
ওয়েলকাম সেঙ্গার বলছে, গত ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত এক সপ্তাহে যুক্তরাজ্যে প্রতি ২৫ জনের একজন এক্সবিবি.১.৫ আক্রান্ত ছিল। তবে এই চিত্র পাওয়া গিয়েছিল মাত্র নয়টি নমুনার পরিসংখ্যান যাচাই করে। পরিস্থিতি আরও স্পষ্ট হতে অপেক্ষা করতে হবে।
ইউকে হেলথ সিকিউরিটি এজেন্সি আগামী সপ্তাহে যুক্তরাজ্যে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের ধরন নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করবে। অধ্যাপক বার্কলে বলেন, যুক্তরাজ্যে এই ধরন ছড়ালে হাসপাতালে আরও বেশি রোগী ভর্তি হতে পারে।
ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস) বলছে, কোভিড ও ফ্লু যে ‘জোড়া মহামারীর’ চেহারা নিতে পারে, সেই আশঙ্কার বিষয়ে তারা অবগত। দুই ভাইরাসই ইতোমধ্যে এনএইচএসকে চাপে ফেলেছে।
বিজ্ঞানীরা কি শঙ্কিত?
অধ্যাপক বারক্লে জানান, যুক্তরাজ্যের সাধারণ জনগণকে নিয়ে তার উদ্বেগ নেই। কারণ কোভিড ভ্যাকসিনের যে সুরক্ষা বলয় রয়েছে তাকে ভাইরাসের নতুন এই ধরন ভাঙতে পারবে– এমন কোনো ইঙ্গিত এখনও নেই। তবে কোভিড টিকার সুবিধা না পাওয়া শারীরিকভাবে দুর্বলদের ব্যাপারে তিনি চিন্তিত।
লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের অধ্যাপক ডেভিড হেম্যান বলেন, নতুন এই ধরন সম্পর্কে এখনও অনেক কিছু জানার আছে। তবে উচ্চ মাত্রায় ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রমের ফলে যুক্তরাজ্যের মত দেশে বড় সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার শঙ্কা নেই বলে মনে করেন তিনি।
হেম্যানের উদ্বেগ চীনকে নিয়ে। কারণে সেখানে ‘টিকা নেওয়ার হার কম’ এবং লকডাউনের কারণে প্রাকৃতিকভাবে মানুষের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।