কথায় আছে, মানুষ অভ্যাসের দাস। মানুষ তার অভ্যাস অনুযায়ী কাজ করতে পছন্দ করে। একবার কোনো কিছুর অভ্যাস হয়ে গেলে সেটা সহজে পরিবর্তন করা যায়না। একই ভাবে নতুন অভ্যাস তৈরি করাও বেশ কঠিন কাজ।
বিখ্যাত মার্কিন লেখক জেমস ক্লিয়ার তার এটমিক হ্যাবিটস বইতে ভালো অভ্যাস গড়ার ও খারাপ অভ্যাস ত্যাগ করার বেশ কিছু উপায় বলে দিয়েছেন।
সবার আগে বুঝতে হবে মানুষের অভ্যাস কিভাবে কাজ করে। এটমিক হ্যাবিটস এ অভ্যাসের চারটি উপাদানের কথা বলা হয়েছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রায় সকল অভ্যাস এই চারটি উপাদান দিয়ে তৈরি। উপাদানগুলো হলো
১. কিউ বা সংকেত
২. ক্রেভিং বা আকাঙ্খা
৩. রেস্পন্স বা বাস্তবায়ন
৪. রিওয়ার্ড বা পুরস্কার
অভ্যাসের প্রথম ধাপ হলো ‘কিউ’। কিউ হলো একটি সংকেত যা আমাদের কোনো একটি অভ্যাসের কথা মনে করিয়ে দেয়। যেমন, কারো ধূমপানের অভ্যাস থাকলে তার হয়তো কোথাও ধোঁয়া দেখলে ধূমপানের কথা মনে পরবে। এখানে ধোঁয়া হচ্ছে অভ্যাসের সংকেত বা কিউ।
কিউ এর পরবর্তী ধাপ ‘ক্রেভিং’। ক্রেভিং বলতে বোঝায় কোনো একটি অভ্যাস পালন করার তীব্র ইচ্ছা বা আকাঙ্খা। যেমন, ফেসবুকে আসক্ত একজন ব্যক্তির মোবাইলে ফেসবুকের অ্যাপ (কিউ) দেখা মাত্র তার ফেসবুকে ঢুকতে ইচ্ছা করবে। এই ইচ্ছাটাই হলো অভ্যাসের ক্রেভিং।
আর ‘রেসপন্স’ হলো ক্রেভিং এ সাড়া দিয়ে অভ্যাসটি বাস্তবায়ন করা। যেমন, কোথাও খাবারের ছবি (কিউ) দেখা মাত্রই অর্ডার করতে ইচ্ছা করলো (ক্রেভিং) আর অর্ডার করে ফেললেন (রেসপন্স)। অর্থাৎ কোনো কিছুর জন্য ক্রেভিং হওয়া মাত্র তা পালন করে ফেলার নাম রেসপন্স।
সবশেষে, একটি অভ্যাস পালন করার পর যে অনুভূতি হয় সেটা হলো রিওয়ার্ড বা পুরস্কার। যেমন, ধূমপান করার পর যে অনুভূতি হয়, ফেসবুকে স্ক্রল করার সময় যে নতুন বিষয়ে জানা যায়, খাবার হাতে পাওয়ার পর যে তৃপ্তি আসে এগুলোর সবই হচ্ছে রিওয়ার্ড। =প্রতিটি অভ্যাসেরই একটি রিওয়ার্ড থাকে। যে অভ্যাসের রিওয়ার্ড যত দ্রুত আসে সেই অভ্যাস গড়া তত সহজ হয়।
এবার এই চারটি উপাদান ব্যবহার করে আমরা সহজেই নতুন অভ্যাস গড়তে পারি।
মেইক ইট অভিয়াস (অভ্যাসকে সুস্পষ্ট করুন)
নতুন কোনো অভ্যাস গড়ার ক্ষেত্রে সেই অভ্যাসের কিউ বা সংকেতকে এমন ভাবে সাজাতে হবে যেন সেটা সহজে নজরে আসে। যেমন, বই পড়ার অভ্যাস তৈরির জন্য বালিশের পাশেই বই রাখা যেতে পারে। এতে সহজেই বইটা নজরে পরবে। নামাজের অভ্যাস তৈরির জন্য কাছাকাছি জায়নামাজ বা টুপি রাখা যেতে পারে। এতে নামাজের কথা মনে পরবে।
কিউ এর কাজ হয়ে গেল। এভাবে ক্রেভিং নিয়ে কাজ করা যাক।
মেইক ইট এট্রাকটিভ (অভ্যাসকে আকর্ষণীয় করুন)
আয়ারল্যান্ডের একজন লোকের নেটফ্লিক্সের প্রতি আসক্তি ছিল। নিয়মিত শরীরচর্চা না করার ফলে তার স্বাস্থ্যেরও খারাপ অবস্থা হচ্ছিল। তিনি অনেক ভেবে এমন একটি সাইকেল তৈরি করলেন যেটা তার টিভি স্ক্রিনের সাথে সংযুক্ত থাকতো। এরপর তিনি যতক্ষণ সাইকেলের প্যাডেল ঘোরাতেন ততক্ষণ টিভি চলত আর প্যাডেল দেয়া থামালেই কিছুক্ষণ পর টিভি অফ হয়ে যেত। এভাবে নেটফ্লিক্স দেখার পাশাপাশি তার শরীরচর্চাও হয়ে গেল।
একটি অভ্যাসকে আরেকটি অভ্যাসের সাথে যুক্ত করার এই পদ্ধতিকে বলা হয় ‘হ্যাবিট বাইন্ডিং’। হ্যাবিট বাইন্ডিং পদ্ধতি কিছুটা ব্যবহার করা যায়। বিশেষ করে যদি পুরোনো কোনো অভ্যাস থাকে। যেমন, ঘুম থেকে উঠে চা খাওয়া, ঘুমাতে যাওয়ার আগে ফেসবুকে ঢু মারা ইত্যাদি। চাইলে এই অভ্যাসগুলোকে কাজে লাগানো যায়। যেমন, আজকে যদি এক পেইজ বই না পড়ি অথবা পাঁচটা পুশ-আপ না দেই তাহলে আজকে চা খাবো না, ফেসবুকে ঢুকবো না বা ধূমপান করবো না :D। এভাবে হ্যাবিট বাইন্ডিং করতে পারলে নতুন অভ্যাসের ক্রেভিং বা ইচ্ছা তৈরি হবে।
মেইক ইট ইজি (অভ্যাসকে সহজ করুন)
এবার সবচেয়ে কঠিন কাজ। অভ্যাসটি রেসপন্স বা বাস্তবায়ন করা। কোনো অভ্যাস বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ অভ্যাসটি যতটুকু সম্ভব সহজ হতে হবে। এক্ষেত্রে কাজকে ছোট ছোট ধাপে ভাগ করা যেতে পারে। ঠিক করা যেতে পারে, আজ মাত্র এক পৃষ্ঠা বই পড়তে হবে, আজ সারাদিনে দুইটা পুশ-আপ দিতে হবে, আজ বিকেলে মাত্র পাঁচ মিনিট হাঁটতে হবে। অর্থাৎ কাজকে যতটা সম্ভব ছোট আর সহজ করতে হবে। ছোট কাজের প্রতি আমাদের ক্রেভিং বেড়ে যায় এবং রেসপন্স করতে সুবিধা হয়।
আরেকটি উপায় হলো কাজের ফ্র্যাকশন বা ধাপ দূর করা। কোনো একটি কাজ করার জন্য যদি অনেকগুলো ধাপ নিতে হয় তাহলে স্বাভাবিকভাবে কাজের প্রতি অনীহা তৈরি হয়। যেমন প্রতিদিন বই পড়ার পর বই যদি বুকশেলফের ভেতর সাজিয়ে রাখা হয় তাহলে সম্ভাবনা আছে সেই বইটা আর পড়া হবে না।
কারণ বইটা আবার পড়তে হলে সেটার জন্য বিছানা থেকে উঠে, বুকশেলফের কাছে গিয়ে, গ্লাস খুলে, বই হাতে নিয়ে এরপর পড়তে হবে। অনেকগুলো ধাপ কিন্তু। এটা না করে বইটা যদি বালিশের পাশে রাখা হতো তাহলে শুধু হাতে নিয়েই বইটা পড়া শুরু করা যেত। এভাবে কোনো কাজে ধাপের পরিমাণ কমিয়ে আনলে সে কাজের রেসপন্স করা সহজ হয়ে যায়।
মেইক ইট স্যাটিসফায়িং (অভ্যাসকে মজাদার করুন)
সবশেষে আসে রিওয়ার্ড। প্রতিটা অভ্যাসেরই একটা না একটা রিওয়ার্ড বা পুরস্কার থাকে। যে অভ্যাসের পুরস্কার তাড়াতাড়ি আসে আমরা সে অভ্যাসগুলোতে আসক্ত হয়ে যাই। এর উল্টোটাও সত্যি। যে অভ্যাসের পুরস্কার দেরিতে আসে তার প্রতি আমাদের আসক্ত হতে সময় লাগে। যেমন, বই পড়া, শরীরচর্চা করা, ডায়েট করা এগুলোর পুরস্কার দেরিতে আসে, তাই এই অভ্যাসগুলোর প্রতি সহজে আসক্তি আসে না।
এক্ষেত্রে কোনো একটি কাজের পর নিজেদের পুরস্কার দেওয়া যায়। যেমন আজ এক পৃষ্ঠা বই পড়ার পর বাইরে কফি খেতে যাবো, আজ পাঁচটি পুশ-আপ দিলে ত্রিশ মিনিট গেমস খেলা যাবে, আজ জিম থেকে আসার পর এক গ্লাস লেবুর শরবত খাওয়া যাবে ইত্যাদি। এভাবে কোনো কাজের পর সাথে সাথে কোনো রিওয়ার্ড আসলে সেই কাজের অভ্যাস তৈরি করা সহজ হয়।
অনেকের কাছে মনে হতে পারে এত অল্প সময় পড়ে বা অল্প শরীরচর্চা দিয়ে কি হবে? আসলে এটাই অভ্যাসের মূলমন্ত্র। অভ্যাস সব সময় ছোট দিয়ে শুরু করতে হয়। যে বই নিয়ে আলোচনা - সেটার নামই এটমিক হ্যাবিটস বা অনু পরিমাণ অভ্যাস। তবে শর্ত হলো অভ্যাসটি ছোট হলেও নিয়মিত করতে হবে, তাহলেই এক সময় বড় পরিবর্তন আশা করা যাবে।
সাজিদ আল মাহমুদ বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত।