Loading...
The Financial Express

এক সুতোয় আর্জেন্টিনা-মেসি-মারাদোনা

| Updated: December 19, 2022 19:25:59


এক সুতোয় আর্জেন্টিনা-মেসি-মারাদোনা

যেদিন হয়, সেদিন এমনই হয়। শুরুর দিকে শিল্পীর তুলির আঁচড়ের মতো নির্ভুল, নিখুঁত হয়ে ওঠে লিওনেল মেসি-আনহেল দি মারিয়াদের পাসগুলো। আক্রমণের সুর গুনগুণিয়ে বেজে ওঠে ভ্রমরের গুঞ্জনে, প্রয়োজনের সময় আবার হুল ফুটিয়ে দেয় প্রতিপক্ষের বুকে। দ্বিতীয়ার্ধে আবার পথও হারায় আর্জেন্টিনা। শঙ্কার দোলাচলে দুলতে থাকে কিলিয়ান এমবাপের অবিশ্বাস্য ঝাঁকুনিতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রোমাঞ্চের নানা বাঁক পেরিয়ে টাইব্রেকারে জিতে যায় আলবিসেলেস্তেরা। এক ‍সুতোয় গাঁথা হয়ে যায় আর্জেন্টিনা, দিয়েগো মারাদোনা ও মেসি। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।

লুসাইলের ফাইনালে অবিশ্বাস্য রোমাঞ্চকর ফাইনালে টাইব্রেকারে ৪-২ ব্যবধানে জিতেছে লিওনেল স্কালোনির দল। ১২০ মিনিট দুই পরাশক্তির লড়াইয়ে সমতা ছিল ৩-৩ গোলের। অথচ ৮০ মিনিটে পর্যন্ত ২-০ গোলে এগিয়ে ছিল আর্জেন্টিনা। এরপর শুরু হয় নাটকীয়তা। শেষ পর্যন্ত ম্যাচের ভাগ্য গড়ায় টাইব্রেকারে। 

টাইব্রেকারে কিংসলে কোমানের শট ঝাঁপিয়ে পড়ে আটকে আবারও আর্জেন্টিনার নায়ক গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্তিনেস। অহেলিয়া চুয়ামেনির শট বাইরে গেলে ফ্রান্সের সম্ভাবনা ফিকে হয়ে যায় আরও। মেসি, পাওলো দিবালা, লেয়ান্দ্রো পারেদেস লক্ষ্যভেদের পর গনসালো মনতিয়েলের চতুর্থ শট জালের নাগাল পেতেই জয়ের উৎসবে মেতে ওঠেন মেসি-মার্তিনেসরা। 

এক সুতোয় আর্জেন্টিনা-মেসি-মারাদোনা

দোহায় মেসি-মার্তিনেসদের উৎসবের ঢেউ আটলান্টিক পেরিয়ে, পারস্যসাগর ছুঁয়ে, পৌঁছে যায় বুয়েন্স এইরেসসহ সারা পৃথিবীর অলি-গলিতে। সাফল্য বুভুক্ষ আর্জেন্টাইন সমর্থকদের, মেসি ভক্তদের আনন্দের স্রোতে ভাসিয়ে দিতে। প্রাণের স্ফুরণে নেচে ওঠে মধ্যপ্রাচ্যের এই মরুভূমিও। 

হয়তো এই উচ্ছ্বাস মাটির পৃথিবী ছেড়ে আকাশ ফুঁড়ে পৌঁছে যায় অন্যলোকেও, যেখানে দিয়েগো মারাদোনা অধীর অপেক্ষায় ছিলেন। ২০২০ সালে না ফেরার দেশে চলে যাওয়া এই কিংবদন্তির অতিমানবীয় পারফরম্যান্সে ১৯৮৬ সালে সবশেষ বিশ্বজয়ী হওয়া আর্জেন্টিনার। ৩৬ বছর অপেক্ষার পর মেসি নামের আরেক জাদুকরের হাত ধরে সেই অবিস্মরণীয় প্রাপ্তির চূড়ায় আবারও পা রাখা আলবিসেলেস্তেদের। 

তখনও ফাইনাল শুরুর কিক অফের বাঁশি বাজেনি। স্টেডিয়ামের জায়ান্ট স্ক্রিনে ভেসে উঠল পরপর দুটি মুখ। একটি মারাদোনার। মেক্সিকোর আসরে সোনালি ট্রফিতে চুমু খাওয়ার সেই মোহনীয় ভঙ্গিতে। অন্যটি মেসির। ফুটবলকে মুঠোভরে দেওয়া বাঁ পায়ের এই জাদুকরকে চিন্তিত দেখায় কিছুটা। কিন্তু কিক অফের বাঁশি বাজতেই মেসি হাজির জাদুর কাঠি নিয়ে। শেষ নাচে নিজেকে মেলে ধরলেন দি মারিয়াও। 

বাঁ পায়ের শৈল্পিক আচঁড়ে মেসি আক্রমণের সুর বেঁধে দেন, চকিত চমকে দিদিয়ের দেশমের মুকুট ধরে রাখার ছক ভেদ করে তিনি বেরিয়ে যান আয়েশি ভঙ্গিতে। ফরাসি ডিফেন্ডাররা থৈ খুঁজে পান না। ছয় ফুট তিন ইঞ্চি লম্বা উগো লরিসও পারেন না বিশাল বপু নিয়ে গোলমুখ আগলে রাখতে। 

প্রথমার্ধের ২৩তম মিনিটে তাই বাঁ দিক থেকে আক্রমণে ওঠা দি মারিয়া পেনাল্টি আদায় করে নেন। লরিসকে ছিটকে দিয়ে নিচু শটে জাল খুঁজে নেন মেসি। কাতার বিশ্বকাপে ৬ গোল হয়ে যায় তার।  গোল্ডেন বুট জয়ের দাবিটাও তিনি জানিয়ে রাখেন, যদিও তা পূরণ হয়নি। হ্যাটট্রিকের আলো ছড়ানো এমবাপেই জিতেছেন তা। 

এক সুতোয় আর্জেন্টিনা-মেসি-মারাদোনা

তের মিনিট বাদে ছবির মতো সুন্দর আক্রমণ থেকে ব্যবধান দ্বিগুণ করেন দি মারিয়া। ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলতে না পারার কষ্টে প্রলেপ দেন মেসির মতো বিশ্বকাপের আঙিনা থেকে বিদায়ের রাগিনী বাজিয়ে দেওয়া এই আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার। ম্যাচ হেলে পড়ে আর্জেন্টিনার দিকে। 

দ্বিতীয়ার্ধের চিত্রনাট্যেও দেশমের কৌশল বিকল করে দিয়ে ছড়ি ঘোরাতে থাকে লিওনেল স্কালোনির আর্জেন্টিনা। আলবিসেলেস্তা সমর্থকে কানায় কানায় ভরা গ্যালারি কাঁপতে থাকে ‘ভামোস আর্জেন্টিনা, ভামোস আর্জেন্টিনা’ কোরাসের গর্জনে। 

৬৪তম মিনিটে দি মারিয়া সংকেত দেন তাকে তুলে নেওয়ার, নামেন মার্কোস আকুনিয়া। তুমুল করতালিতে তাকে বিদায় জানায় সমর্থকরা। দলকে ২-০ গোলে এগিয়ে রাখার তৃপ্তি নিয়ে মাঠ ছাড়েন তিনি। কিন্তু তখনও নাটকীয়তার ঢের বাকি! 

দি মারিয়ার অনুপস্থিতিতে আর্জেন্টিনার খেলায় তান কেটে যায় কিছুটা। এতক্ষণের বিবর্ণতা ৮০তম মিনিটে কাটিয়ে ওঠেন এমবাপেও। মলিন অলিভিয়ে জিরুদ ও উসমান দেম্বেলেকে প্রথমার্ধে তুলে নিয়ে নামান রান্দাল কোলো মুয়ানি ও মারকাস থুরামকে। থুরামই আদায় করে নেন পেনাল্টি। বলের লাইনে ঝাঁপিয়ে পড়লেও এমবাপের গতিময় স্পট কিক আটকাতে পারেননি মার্তিনেস। 

পরের মিনিটেই এমবাপে যেন বার্তা দিয়ে দেন মেসি, রোনালদোর উত্তরসূরি হওয়ার পথে প্রবল গতিতে ছুটছেন তিনি। বাঁ দিকের কিছুটা দূরূহ কোণ থেকে দুর্দান্ত সাইড ভলিতে সমতা ফেরান ২৩ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ড। ডুবতে বসা ফরাসি তরি মুকুট ধরে রাখার দুর্বার স্বপ্ন নিয়ে ফের ভেসে ওঠে। আড়মোড় ভেঙে জেগে ওঠে গ্যালারিতে কোণঠাসা ফরাসি সমর্থকরাও। 

সমতায় ফেরার পর আর্জেন্টিনার রক্ষণে প্রচণ্ড চাপ দিলেও নির্ধারিত নব্বই মিনিটে এগিয়ে যেতে পারেনি ফ্রান্স। যোগ করা সময়ে মেসির বাঁ পায়ের দারুণ শট আরও দুর্দান্ত সেভ করে লরিসও ম্যাচ ঠেলে দেন অতিরিক্ত সময়ে। মেসি আবারও এগিয়ে নেন আর্জেন্টিনাকে, স্পট কিক থেকে হ্যাটট্রিক পূরণের আনন্দে ডানা মেলার সঙ্গে পাল্টা জবাবও দিয়ে দেন ফরাসি ফরোয়ার্ড। 

এক সুতোয় আর্জেন্টিনা-মেসি-মারাদোনা

রুদ্ধশ্বাস ম্যাচ শেষ পর্যন্ত টাইব্রেকারে গড়ায় ম্যাচ। প্রথম অধিনায়ক হিসেবে দুটি বিশ্বকাপ উঁচিয়ে ধরার হাতছানি নিয়ে নামেন লরিস। প্রথমের স্বাদ পাওয়ার অপেক্ষায় মার্তিনেস। শেষ পর্যন্ত জিতে যান আর্জেন্টিনা গোলরক্ষকই। জিতে যান মেসি, জিতে যান মারাদোনাও। মেসির শ্রেষ্ঠত্বের মীমাংসাও কি হয়ে যায়? 

তা হোক বা না হোক, ফুটবল ঠিকই তার ঋণ শোধ করে দেয়। রোসারিও সেই ছোট্ট বেলা থেকে বাঁ পায়ের জাদুতে ফুটবল বিশ্বকে মুগ্ধ করে রেখেছেন মেসি। ক্লাব ফুটবলে জিতেছেন ৪১টি শিরোপা। আকাশি নীল-সাদা জার্সিতে গত বছরই পান প্রথম ‘বড়’ শিরোপা কোপা আমেরিকা। কিন্তু বিশ্বকাপ ছিল অধরা সোনার হরিণ। 

মরুভূমির প্রথম বিশ্বকাপে তিনি এসেছিলেন মরু হাহাকার নিয়েই। শুরুটাও হয়েছিল সৌদি আরবের কাছে ধাক্কা খেয়েছে। এরপর দুর্বার গতিতে ছুটে চলা আর্জেন্টিনার। ফাইনালে এসেও শুরুতে জয়টা মুঠোয় পুরে ছুটতে থাকল আলবিসেলেস্তেরা। এরপরই শুরু নাটকীয়তার। তবে শেষ পর্যন্ত রোমাঞ্চ, শঙ্কা, টানাপোড়েনের সবগুলো বাঁক পেরিয়ে, স্নায়ুর চরম পরীক্ষা নিয়ে মেসির হাতেই বিশ্বকাপ তুলে দিল ফুটবল।

Share if you like

Filter By Topic