এক নারী প্রতিমা শিল্পীর হাতে গড়া দুর্গা প্রতিমা


সুস্মিতা রায় | Published: October 01, 2022 16:28:03 | Updated: October 01, 2022 18:58:02


ছবি: শুভেচ্ছা বিশ্বাস

বছর ঘুরে শরৎ এলো, পূজার সময় চলে এসেছে। এই শেষ সময়টায় ব্যস্ত সময় পার করেন প্রতিমশিল্পীরা। কেউ টানছেন শেষ তুলি, কেউ পরাচ্ছেন সাজ। শাঁখারিবাজারের যেই গলিটা ধরলে একেক পর এক গুণীন শিল্পীর আড্ডাখানা, তারই এক ছোট ছিমছাম ঘরে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে এক নারী শিল্পী। প্রথম মাটির কাজেই বিস্মিত করছেন অনেককে, যাতে মিশে আছে একটা সংগ্রামী জীবনের ছাপ। সত্যিকার এক নব শক্তির উদ্বোধন।

প্রতিমার সাথে তার সন্ধি যেন ছোটবেলা হতেই। বাবা নিজে ছিলেন প্রতিমাশিল্পী। ছোট্টবেলার বাবার পাশে বসে গড়তে দেখতেন যত্নে ভরা প্রতিমা। যখন একটু বুঝে ফেললেন, বাবাকে একটু - আধটু সাহায্য এগিয়ে দিতেন। 

বাবা রাত জেগে কাজ করতেন, ঘুমোতে যাবার সময় বাবাকে পেতেন না কোলের কাছে, সকালে চোখ খুলেও বাবা নেই, পড়ে আছেন কারখানা ঘরে। তখন মনে হতো মেয়েটার, একটুখানি হাত লাগলে বুঝি বাবার কষ্ট কমে। এমন না যে বাবার কোনো সাগরেদ ছিল না, কিন্তু তিনি মন থেকে এগিয়ে যেতেন। কারিগরের সংখ্যা তখন পাঁচ থেকে সাত। শাঁখারীপট্টির বাগানবাড়ি এলাকায় প্রচুর প্রতিমা গড়া হতো তখন।

অনামিকা স্মৃতিচারণ করে বলেন, "আমি নিজের মন থেকেই বাবার কাজে হাত দিতাম। বাবা কখনো আমায় সেভাবে বলেনি।" আগে বাবা একশো থেকে দেড়শো ছোট ছোট লক্ষ্মী গড়তেন। অনামিকা কাঁচা হাতে তাদের শাড়ি পড়াতে যেতেন। ভুল করে ভেঙে যেতো পা। লুকিয়ে আস্তে করে বের হয়ে আসতো ছোট্ট অনামিকা। বাবা ঠিকই বুঝে যেতেন। একটু ধমকে দিতেন। আবার নিজেই যত্ন করে শিখিয়ে দিতেন, কী করে শুধরে নেয়া যায়- এ ভুলখানি।

এভাবে এই শাড়ি পরানো দিয়ে শুরু। তখন সবে ক্লাস সিক্সে। বাবা দেখলো মেয়ে শাড়ি পড়ানোর কাজ রীতিমতো শিখে গেছে। কোথায় পিনটা জুড়তে হবে, কোথায় আঁচলটা পড়বে, পাড়ের আঠা কোথায় জুড়তে হবে সব তখন মোটামুটি শেখা।

বাবার আদরের কন্যা ছিল তার গড়া মাতৃ প্রতিমার নিজস্ব সাজের শিল্পী। ঠান্ডা লেগে যাবে বলে বাবা কোনোদিনও মাটি ছানতে দেয়নি। তখন শুধু মায়ের গায়ে রং আর সাজের টুকটাক হতো।

শাঁখারিবাজার কালাচাঁন মার্কেটের পিছনে, ২০ নং কৈলাস লেনের পয়লা দোকান। অনামিকার বর্তমান দোকানঘরটি সাত বছরের উপর, এর আগে ছিল আরেকটু সামনে। এই বুড়িবাগানে বাবা যুবা সময় থেকেই কাজ করেন। সবাই চিনতেন ভালো করে প্রতিমশিল্পী সুশীল নন্দী।

নববর্ষ আসার আগেই হঠাৎ করে না ফেরার দেশে চলে যান সুশীল নন্দী। পূর্ব কোনো অসুস্থ্তা ছিল না। সেদিন দোকানে পরে ছিল কাজ, গ্রাহকের বায়না যা তখনও পৌঁছনি তার গন্তব্যে। বাবা, মা, মেয়ে- এই তিনের পরিবারের আকাশ ভেঙে এলো। অনামিকা ধরলেন সংসারের হাল।

অনামিকা নন্দীর প্রতিমা গড়া শুরু হলো গেলো আষাঢ়ে। দোকানে ছিল আধগড়া শিব। বাবার ফেলে যাওয়া স্মৃতিচিহ্ন। মনে হলো ওকে এমনি রাখা যায় না। যার অর্ডার তার অনুমতি জুটে গেলো। প্রথম বারের মতো খড়ের কাঠামোতে মাটি ছোঁয়ালেন অনামিকা। যেমন যেমন করে বাবাকে দেখতেন। কিন্তু মূর্তির আঙ্গুল লাগাতে গিয়ে আঙ্গুল গেলো ভেঙে। দ্বিতীয় চেষ্টাও ভেস্তে গেলো।  হলো ধৈর্যের চ্যুতি। কিন্তু অনামিকা দমলেন না। এবার আগেই গড়ে নিলেন আঙুলের তিনখানা সেট। তৃতীয়বারের মতো যখন জুড়তে গেলেন, তখন আঙ্গুলটা বাবার বসানোর মতো হয়ে এলো। তড়িৎ গতিতে ফিরে এলো হারানো আত্মবিশ্বাস। অনামিকা বুঝলেন তিনি পারবেন।

মাটি হলো সেই জিনিস, যাতে আকৃতি দেয়া যায় ইচ্ছেমতো। যখন পুরো প্রতিমা গড়া হলো, সকলে বললে , না কাজটা একেবারে বাবার জায়গায় গিয়েছে। ওই কথাটি তখন ছিল অনেক বড় পাওয়া। অনামিকা প্রথম গড়া ঠাকুর নিয়ে বললেন, "সবাই ছিল বিস্মিত। সবাই ভাবছিল আমি পারবো না। এই হতাশাটা বায়নাদারেরও ছিল। তিনি ভেবেছিলেন, মেয়েটা মাটির কাজ জানে না, ও শুধু রং করে।"

এরপর হলো বিপদনাশিনীর পূজা। পূজাটা তাদের নিজস্ব ছিল। আশা নিয়ে খড় বাঁধলেন দোকান ঘরে। একরাশ মন খারাপ নিয়ে কাজের শুরু তখন। প্রথমে মাপমতো হয়ে উঠছিল না কাজটা। ধীরে ধীরে ধৈর্য্য নিয়ে গড়তে থাকলেন প্রতিমা। হয়ে গেলো জমজমাট। সবাই বললো, খুব সুন্দর। একদম তোমার বাবার মতো। এই ঠাকুর দেখেই, লোকে সাহস করে দিয়ে গেল দুর্গা প্রতিমার বায়না।

প্রথমটায় ঘাবড়ে যাচ্ছিলেন এই নবীন শিল্পী। কারণ এটা মোটেই চাট্টিখানি কথা নয়। দেবী দুর্গা, সে তো বিশাল, দশটি হাত, তাতে আবার দশ অস্ত্র। লক্ষ্মী-সরস্বতী, গণেশ-কার্ত্তিক। আবার সিংহের উপর চড়া দেবী, এক কাঠামোতে পুরো ঠাকুর!

কি বিরাট ব্যাপার! ভাবনাগুলোকে এক পাশে রাখলেন। বুকে আনলেন প্রচুর সাহস- আমি চেষ্টা করলেই পারবো। হয়তো লাগবে একটু বেশি সময়। মাকে জানালেন ব্যাপারটা। মা বলে দিলো, যদি পারিস, তবেই নিস। জানিস তো পালেদের কথা! দুর্গা এই শিল্পে বড় দেবী। যে এটা গড়তে পারে, ধরে নেয়া যায়, সে সব করতে পারে।

অনামিকা কাজে হাত দিলেন। আকার, নকশা, ধরন বুঝে একেক প্রতিমায় লাগে একেক রকম সময়। ছবি দিয়ে যায় বায়নাদার। তার থেকে নিজের স্বকীয়তা বজায় অনামিকা গড়তে শুরু করেন।

শুরু হলো ভাদ্রের ২০ হতে। এবার কাজে পাশে পেলেন মাকে আর কাছেপিঠের দাদাদের। মা জল এনে দিতেন। অনামিকা আনতেন প্রতিমায় ফিনিশিং। টুকটাক জিনিস আনা নেয়া দাদা করতেন। কাঠ কেটে কেটে কাঠামোর গায়ে পেরেক ঠুকে দিতেন। এভাবেই চলেছে অনামিকার দুর্গা গড়া।

মায়ের গায়ে রং চড়েছে মহালয়া হতে। অনামিকা জানালেন আসন্ন পূজা গুলির জন্যে লক্ষ্মী আর কালী প্রতিমা বানাবেন কারিগর আনিয়ে।

অনামিকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, পড়ছেন হিসাববিজ্ঞান নিয়ে। শুধু নিজের পড়াশুনা নয়। ঘর চালাতে আরো ছটা জায়গায় ছোটেন ছেলে মেয়ে পড়াতে। তারপরে রাত জেগে জেগে কাজ। তার আয়েই পুরো সংসার। 

নিজের সংসারের দশভূজাটি আসলে তিনি। যেটুকু অবসর সেটিও প্রতিমা বানাবার কাজে দেন। ভাবলেন আরেকটু কাজ করলে আরেকটু শেখা হবে, থাকবে তার চর্চা। কাজের মাঝে আসে অলঙ্ঘনীয় ক্লান্তি। তারমাঝে আবার একটা সময় উঁকি দেয় ইচ্ছাশক্তি - কাজ শেষ করতে হবে, করে যেতে হবে, আরো এগিয়ে নিতে হবে।

বর্তমানে নিজেকে বাঁচাতে বাঁচিয়ে রেখেছেন বাবার পেশা। অসম্ভব জীবন সংগ্রামী মানুষটি তার কাজটি সামনে আরো এগিয়ে চান, কিন্তু সূক্ষ্ম হিসেব-নিকেশ কষে।

শিব গড়া থেকে শুরু হয়ে ছোট বড় অনেক প্রতিমা গড়ছেন অনামিকা। কিন্তু মা দুর্গাকে প্রথমবার। তাই এইবারে অনামিকার হাতে তিনি অনন্যা। দ্বিতীয় কোনো বায়না হাতে নেননি এই বারে। বাবা থাকতে ছোট ছোট লক্ষ্মী ঠাকুরের চোখ বসিয়েছেন। কিন্তু এইবারে অনামিকার তুলির টানেই প্রথম চোখ খুলছেন দশভূজা দেবী। à¦à¦‡à¦Ÿà¦¿ তার বারোয়ারী পূজায় প্রথম চক্ষুদান।

 

সুস্মিতা রায় বর্তমানে শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিকেল কলেজে ৪র্থ বর্ষে পড়াশোনা করছেন।

Share if you like