Loading...
The Financial Express

এইচএমভির লোগো ও এক কুকুরের চিরায়ত ভালোবাসার গল্প

| Updated: December 27, 2022 13:20:24


এইচএমভি-র লোগো। ছবি: ডিসকোগস। এইচএমভি-র লোগো। ছবি: ডিসকোগস।

চিত্রশিল্পী ফ্রান্সিস ব্যারড বেশ অবাক হলেন। কারণও আছে বৈকি। তাদের পোষা কুকুর নিপার বারবার বসে পড়ছে ফোনোগ্রাফ রেকর্ডের সামনে। এই রেকর্ডগুলোয় তিনি তার প্রয়াত বড় ভাই মার্ক ব্যারডের কিছু কথা চালিয়ে দেখছিলেন। যখনই মার্কের কথা শোনা যায়, নিপার মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসে পড়ে ফোনোগ্রাফের সামনে। একবার বসলে আর ওঠার নাম নেই। এই ঘটনাটা বেশ অভিনব একটা ব্যাপার বলে মনে হয় তার কাছে। তাই কুকুরটির গ্রামোফোনের সামনে বসে থাকা দেখে সেই মুহূর্তটি আঁকতে শুরু করে দেন তিনি।

এর আগে নিপার ছিলো তার বড় ভাইয়ের কাছেই। নিপারের তখন কেবল তিন বছর বয়স৷ 

১৮৮৭ সালের কথা। মার্ক ব্যারড কাজ করতেন ব্রিস্টলের প্রিন্স'স থিয়েটারে৷ পেশায় তিনি ছিলেন সাইনবোর্ড আর্টিস্ট। পাশাপাশি মঞ্চসজ্জার কাজও করতেন। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন মার্ক, কয়েকদিন জ্বরে ভুগে মাত্র ৩৯ বছর বয়সেই বিদায় জানালেন এ পৃথিবীকে। নিপার তার খুব ভক্ত ছিলো। মার্কের অন্য দুই ভাই ফিলিপ ও ফ্রান্সিস তাকে নিয়ে এলেন তাদের কাছে। ফ্রান্সিসের লিভারপুলের লঙ্কাশায়ারের স্টুডিওতে বসে ফ্রান্সিস ছবি আঁকতেন। সে সময় মার্কের গলার সুর ফোনোগ্রাফে শুনলেই সেখানে বসে থাকতো ছোট্ট নিপার। ওর অভ্যাস ছিলো অচেনা কোনো পর্যটক দেখলে তাদের পায়ে হালকা করে আঁচড় কাটার; সেই 'নিপ' করা থেকেই তার নাম মার্ক দিয়েছিলেন নিপার।

১৮৯৫ সালে ১১ বছর বয়সী নিপার মারা যায় সেখানেই৷ তাদের স্টুডিওর পেছনে একটি মালবেরি (মতান্তরে ম্যাগনোলিয়া) গাছের নিচে তাকে কবরস্থ করা হয় বেশ মমতার সাথেই।

১৮৯৮ সালের কথা৷ কুকুরটির মৃত্যুর পর তিন বছর পেরিয়ে গেছে৷ একদিন সেই মালবেরি গাছের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ফ্রান্সিসের মনে পড়তে থাকে নিপারের কথা৷ তিনি দেখতে থাকেন ক্যানভাসে আঁকতে শুরু করা পিতলের ফোনোগ্রাফ আর তার সামনে বসে কথা শুনতে থাকা  টেরিয়ার জাতের  সাদা কুকুর নিপারকে। এর আগে নিপারের ব্যাপারটা চমকপ্রদ লাগায় ফোনোগ্রাফের সামনে  তার বসে থাকার ছবি তিনি আঁকতে শুরু করেছিলেন। সেটা আরো কয়েকবছর আগের কথা। তবে প্রথম আঁকা ছিলো স্কেচে। এরপর সেটার অনুসরণে ক্যানভাসে কিছুটা এঁকে রেখে দিয়েছেন। আঁকা পরে আর  শেষ করা  হয়নি। এবার ঠিক করেন ছবিটির কাজ তিনি সম্পন্ন করবেন। আরো কয়েকমাস পর  ছবিটির কাজ সম্পন্ন করেন তিনি । ফ্রান্সিস প্রথমে নাম দেন - 'ডগ লুকিং অ্যাট অ্যান্ড লিসেনিং টু এ ফনোগ্রাফ।'  এ নামে তিনি ছবিটি রেজিষ্ট্রেশন করেন।

সে সময় ইংল্যান্ডে বিভিন্ন কোম্পানির সিলিন্ডার রেকর্ড বেশ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। ফ্রান্সিস ভেবেছিলেন এদের কেউ ছবিটি কিনে নেবে। বিক্রির উদ্দেশ্যে  ফ্রান্সিস ছবিটি নিয়ে যান এডিসন-বেল কোম্পানিতে। তারা অবাক হয়ে ও কিছুটা অবজ্ঞার সাথে বলেন, 'কুকুর আবার গান শোনে নাকি?'

কুকুর এভাবে মানুষের কথা শুনতে পারেনা বলেই তারা মত দেন।

সে সময় এক বন্ধুর পরামর্শে তিনি গ্রামোফোন কোম্পানিতে যান। গ্রামোফোন তখন সবে এসেছে। ফোনোগ্রাফের উন্নত সংস্করণ এটি৷ এর চোঙাটা কালো  নয়, বরং সোনালি রঙের।

ফ্রান্সিস তার ছবিটির প্রথমে একটি দীর্ঘ নাম দিয়েছিলেন ।  সেটা ঠিক যুতসই না লাগায় পরে তা পরিবর্তন করে নাম নির্ধারণ করেন- 'হিজ মাস্টার'স ভয়েস।'

নিপারের মালিক মার্ক ও তার প্রতি নিপারের ভালোবাসার কথা মনে করেই ফ্রান্সিস নামটি ঠিক করেন।

গ্রামোফোন কোম্পানির মালিক উইলিয়াম বার ওয়েইন  ছবিটি দেখে চমকিত বোধ করেন। পুরো কাহিনী শুনে শিহরিত হন। তিনি প্রস্তাব করেন, তার কোম্পানি যেহেতু গ্রামোফোনের ; তাই ফোনোগ্রাফের কালো চোঙাটি  মুছে গ্রামোফোনের সোনালি চোঙা এঁকে দিলেই তিনি এই ছবিটি গ্রামোফোন রেকর্ড লেবেলের জন্য নেবেন৷ এজন্য তাকে একশ পাউন্ড সম্মানী দিতে রাজি হন উইলিয়াম বার ওয়েইন।

ফ্রান্সিস তাই করেন। ওয়েইন তার সাথে আনুষ্ঠানিক চুক্তিপত্র সই করেন। । প্রতিটি ছবির জন্য নির্ধারণ করেন ৫০ ডলার । 'হিজ মাস্টার'স  ভয়েস' নামটিও ভীষণ পছন্দ হয় তার৷ সে নামেই  যাত্রা শুরু করে তার কোম্পানি। ১৯০০ সালের জানুয়ারিতে প্রথম এই ছবি ও 'হিজ মাস্টার'স  ভয়েস' ট্যাগলাইনটি ব্যবহার করেন তারা।  তারপর একসময় গ্রামোফোন যুগের সঙ্গীতে মহীরুহ হয়ে ওঠে হিজ মাস্টার'স ভয়েস বা এইচএমভি। সারা বিশ্বে গ্রামোফোন রেকর্ডে শোভা পেতে থাকে নিপারের আদলে আঁকা সাদা টেরিয়ার কুকুরটির ছবি৷  ১৯২৪ সালে ৬৭ বছর বয়সে প্রয়াত হন ফ্রান্সিস ব্যারড। এইচএমভি (হিজ মাস্টার'স ভয়েসের সংক্ষিপ্ত রূপ)  তার অবসরের পরও শেষ কয়েক বছর তাকে পেনশন দিতেন।

সারা পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে গেলো এইচএমভি, লোগোটি দেখা গেলো তাদের সব গানের রেকর্ডে। আর তার সঙ্গে সঙ্গে অমরত্ব পেয়ে যায় নিপার, মার্ক ব্যারড ও তাদের ভালোবাসা। ব্যক্তি মার্ক ও কুকুর নিপার বহু আগে পৃথিবী ছেড়ে গেলেও রেকর্ড লেবেলে থাকা এই ছবিটি গত ১২২ বছর ধরে আমাদের জানিয়ে যাচ্ছে এক কুকুরের শাশ্বত ভালোবাসার কথা। তিন বছর বয়সে মালিক ও প্রিয় বন্ধু মার্ককে  হারিয়ে  যে জীবনের বাকি আটটি বছর বারবার অনুভব করেছে তাকে। প্রতিবার তার কণ্ঠ শুনলেই ছুটে এসে বসেছে ফোনোগ্রাফের সামনে। মার্কের কথাগুলোর ভেতর দিয়েই হয়তো তার শূণ্যতা কাটানোর অনুভূতি পেয়েছে; যেমনটি আমরাও করেছি একশ বছরেরও বেশি সময় ধরে গ্রামোফোনে অজস্র ভালোবাসার গান শুনে।

মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে অধ্যয়নরত।

[email protected]

Share if you like

Filter By Topic