মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের প্রত্যন্ত এলাকা হরিণছড়া চা বাগানের শ্রমিক সবুজ তজু মাটির নড়বড়ে ঘরে কোনো রকমে দিন পার করতেন। দারিদ্র্যের কষাঘাতে জীবন চালানোই যেখানে দায়, সেখানে পাকা বাড়ি তার কাছে কেবলই স্বপ্ন ছিলো। তবে স্বপ্ন বাস্তব হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর পেয়ে।
পাকা ঘর পেয়ে আনন্দে আত্মহারা তজু ইচ্ছা প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রীকে একটি ভাস্কর্য উপহার দেবেন। বন থেকে কাঠ সংগ্রহ করে তৈরি করেন প্রধানমন্ত্রীর একটি ভাস্কর্য। আর সেই নিপুণ হাতের কর্মযজ্ঞ দেখতে প্রতিদিনই তার বাড়িতে ভিড় জমাচ্ছেন দর্শনার্থীরা।
দিনমজুর সবুজ তজুর ভাস্কর্য তৈরিতে হাত পাকিয়েছেন ছোটবেলা থেকেই; পারদর্শী ছবি আঁকাতেও। কিন্তু সংসারের দাঁড় বাইতে গিয়ে এসব কাজ সচারচর করা হয়ে ওঠে না তার।
প্রায় দেড় মাসে একটি গাছ খোদাই করে ৪৩ ইঞ্চি লম্বা প্রধানমন্ত্রীর হাস্যেজ্জ্বল ভাস্কর্যটি তৈরি করেছেন বলে জানালেন তজু। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
তিনি বলেন, এই ভাস্কর্যটির মুখমণ্ডলে ফুটিয়ে তুলেছেন প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বের ছাপ। দেশের মানুষের আস্থার জায়গা। যে চেহারা প্রকাশ করে সকল প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে দিয়েছে স্বস্তি ও শান্তির বারতা।
“আমি মনের আনন্দে শিল্পকর্ম করি। কিন্তু আমার এই শিল্পকর্ম বিক্রি খুব কমই হয়। এসব মানুষকে উপহার দিয়েই বেশি আনন্দ পাই। এখন আমার ইচ্ছা এটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দেওয়া।”
মাটির নড়বড়ে ঘর থেকে পাকা ঘরের যাত্রায় তজুকে সহায়তার হাত বাড়িয়েছেন শ্রীমঙ্গল উপজেলা ক্ষুদ্র-নৃ গোষ্ঠীর সমন্বয়ক তাজুল ইসলাম। তার কাছেই তজুর ব্যাপারে জানতে পেরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে একটি ঘর উপহার দেন।
এদিকে তজুর ভাস্কর্য দেখতে প্রতিদিনই তার বাড়িতে ভিড় করছেন লোকজন।
মো. রিপন আলী নামের একজন বলেন, খবর পেয়ে তিনিও দেখতে এসেছেন। ভাস্কর্যটি হুবহু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।
তজুর স্ত্রী পূরবী রিচিলের কাছে প্রধানমন্ত্রী পাকা ঘর উপহার পাওয়া স্বর্গসুখের মত। ভাঙা ঘর থেকে পাকা ঘরে ওঠার ভাবনাও কোনোদিন ছিলো না তাদের।
এ আনন্দের কথা বলতে গিয়ে গলা ধরে আসে হরিণছড়া চা বাগানের এ শ্রমিকের।
পূরবী রিচিল বলেন, স্বামীর স্থায়ী কোনো কাজ নেই। কখন মানুষের ঘর রংয়ের কাজ করেন। কখনও লেবু বাগানে শ্রমিকের কাজ করেন। কখনও ঘর মেরামতের কাজ করেন। দুই ছেলে ও এক মেয়েকে ঢাকা ও শ্রীমঙ্গলে লেখাপড়া করাচ্ছেন। পরিবার ও সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ যোগান দিতে হিমশিম খেতে হয়। এই অবস্থায় নিজের ঘর পাকা করে তৈরি করা এটি শুধু স্বপ্নই ছিল।
তিনি আরও বলেন, “ঘর পেয়ে আমার স্বামী এতো খুশি হন যে, মনে মনে চিন্তা করেন প্রধানমন্ত্রীকে নিজের হাতে একটি ভাস্কর্য তৈরি করে দেওয়া যায় কি-না। এক সময় ভাবনায় আসে, আমাদের এই ছোট উপহার প্রধানমন্ত্রীকে দিবো কীভাবে?”
সবুজ তজু জানান, ঘর পাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীকে ভাস্কর্য উপহার দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলী রাজিব মাহমুদ মিঠুনের সঙ্গে। পরে তার উৎসাহেই কাজ এগিয়ে নেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর একটি ছবিও উপহার দেন। পরে এই ছবি দেখেই প্রধানমন্ত্রীর চমৎকার একটি ভাস্কর্য তৈরি করেন।
শুধু প্রধানন্ত্রীর ভাস্কর্য নয়, তজু গ্রামীণ ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে কাঠ দিয়ে মাছধরা, চা পাতা তোলা, ঘাসকাটা, পানচাষ, ডিম থেকে পাখির বাচ্চা বের হওয়া, জেবরা, গণ্ডার, হরিণ, চা-কন্যা, বঙ্গবন্ধু, লোকনাথ ব্রহ্মচারী ও মা মারিয়ার মূর্তিসহ বিভিন্ন ছোট ছোট ভাস্কর্য করেছেন। কিন্তু সংসারের চাপে তজু এসব কাজ সবসময় করতে পারেন না। কাজের ফাঁকে ফাঁকে সময় বের করে করেন।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সমন্বয়ক তাজুল ইসলাম জানান, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কাজ করতে গিয়ে তজুর শিল্প তৈরির দক্ষতা তার নজরে আসে। তার তৈরি করা অনেক জিনিস দেখে ভালো লাগায় বিষয়টি তিনি উপজেলা নির্বাহী নির্বাহী কর্মকর্তাকে অবহিত করেন।
“তজুর এ কাজে প্রতিভা থাকলেও তার তৈরি জিনিস বিক্রি হয় খুব কম। বেশিরভাগই তিনি মানুষকে উপহার দিয়ে দেন। ফলে শিল্পকর্ম দিয়ে তার সংসার চলে না। তাই দিনমজুরের কাজ করেন। আর কাজের ফাঁকে মনের আনন্দে এই কাজগুলো করেন।”
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলী রাজিব মাহমুদ মিঠুন বলেন, “তজুর অনন্য প্রতিভা রয়েছে। তার তৈরি চা-কন্যাসহ বিভিন্ন সামগ্রী আমরা সংগ্রহ করেছি। তার হাতের কাজ অসাধারণ। তজুর আর্থিক সঙ্কটের কথা বিবেচনায় আমি তাকে প্রধানমন্ত্রীর একটি ঘর উপহার দেই।”
মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান বলেন, “আমাদের নির্ভরতার প্রতীক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত মানুষ ভালোবাসে, এই ভাস্কর্য তারই নিদর্শন। ভাস্কর্যটিতে ভালোবাসার কোনো ঘাটতি নেই।”
ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে কাঠের এই ভাস্কর্যটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন বলে আশ্বস্ত করেন তিনি।
সবুজের এই শিল্পকর্ম প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছাবে এ প্রত্যাশা হরিণছড়া চা বাগানের বাকি শ্রমিকদেরও।