"দ্যা নেম ইজ বন্ড, জেমস বন্ড"- বিখ্যাত এই সংলাপটি কারোর ই অজানা নয়। শৈশবে জেমস বন্ড নামক চরিত্রটি টেলিভিশন এর পর্দায় দেখতে গিয়ে মনে রোমাঞ্চ কাজ করেনি এমন মানুষ খুব কম-ই পাওয়া যাবে৷ তবে পর্দার বাইরেও যে আসল গুপ্তচরদের গল্প তাক লাগিয়ে দেয় মানুষকে সেই সংখ্যাটি কি নেহাতই কম?
রিচার্ড সোর্জ
সময়টা ১৯৪১ সালের আগস্ট মাস। জাপানে অবস্থানরত একজন সোভিয়েত গুপ্তচরের কাছ থেকে স্ট্যালিন এর কাছে একটি বার্তা আসে। সেটি হচ্ছে জাপান সোভিয়েত ইউনিয়নে আক্রমণ করার কোনো পরিকল্পনা-ই করছে না।
এর আগে সেই বছর মে মাসে একই গুপ্তচর স্ট্যালিনকে জানিয়েছিল যে হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু তিনি সেই সতর্কবার্তা উপেক্ষা করেন।
তবে জাপান সম্পর্কে তথ্য জানার পর স্ট্যালিন এই দফা আর সেটি উপেক্ষা করেননি। বরং মাঞ্চুরিয়ান সীমান্ত থেকে নিজেদের সৈন্য সরিয়ে নিয়ে তাদের মস্কো গেটে জার্মানির আক্রমণের বিরুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে নিযুক্ত করে দেন।
যার ফলে জাপান ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এর মধ্যে হতে যাওয়া বিশাল কলহ এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। কিন্তু সেই জাপানিদের হাতেই প্রাণ যায় উক্ত গুপ্তচরের।
বলছিলাম জার্মান বংশোদ্ভূত সোভিয়েত গোয়েন্দা অফিসার রিচার্ড সোর্জ এর কথা। তিনি সোভিয়েতদের কাছে গোপন তথ্য পাঠানোর উদ্দেশ্যে জাপানে একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিলেন। সাংবাদিক হিসেবে তিনি সেখানে যান এবং জীবনের শেষ ১০ বছর তিনি সেখানেই থাকেন।
জাপানের কূটনীতিক সম্প্রদায়ের সাথে সোর্জ নিজেকে এতোটাই সফলভাবে যুক্ত করে ফেলেছিলেন যে, জার্মান দূতাবাসের বাইরে কাজ করার সুযোগ পেয়ে যান। এমনকি বিভিন্ন গোপনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ নথি-পত্রের সন্ধানও তিনি পেতে শুরু করেন।
জাপানের সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে তিনি বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং তাদের সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যুদ্ধ না করার জন্য প্ররোচিত করতে থাকেন।
তবে এতো কিছুর পরেও সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক তাকে কোনো গুরুত্ব প্রদান করা হয় নি। যার ফলে তিনি যখন জাপানিদের হাতে তিনি বন্দী হন তখন তাকে বাঁচানোর জন্য সোভিয়েন ইউনিয়নের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
গ্রেফতার হওয়ার কিছুদিন পরই ১৯৪৪ সালে তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। মৃত্যুর ২০ বছর পর দেশের প্রতি সোর্জের অসামান্য অবদানের বিষয়টি প্রমাণিত হয় এবং রিচার্ড সোর্জকে দেশের ‘নায়ক’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
মাতা হারি
জল্পনা - কল্পনার শেষ নেই যাকে নিয়ে তার নাম মাতা হারি। মাতা হারি কথাটি এসেছে ইন্দোনেশিয়ান ভাষা থেকে যার অর্থ ‘দিনের চোখ’ বা ‘সূর্য’। তবে তার আসল নাম মার্গারেটা গিরট্রুইডা জেল। তিনি ১৮৭৬ সালে নেদারল্যান্ডসে জন্মগ্রহণ করেন।
মার্গারেটা গিরট্রুইডা জেল থেকে মাতা হারি হয়ে যাওয়ার সফরে তার জীবনে ঘটে গেছে অসংখ্য ঘটনা। স্বল্পবসনা হয়ে জনসম্মুখে নৃত্যরত নারীটি কীভাবে পেয়ে গেলেন গুপ্তচরের আখ্যা সেই কাহিনিটি-ই এখন শোনানো যাক।
মার্গারেটার কৈশোর জীবন তেমন সুখের ছিলো না। পনেরো বছর বয়স হওয়ার পূর্বেই মাকে হারান তিনি। এরপর বাবার সাথেও দূরত্ব বেড়ে যায় তার। তারপর তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় হেগ শহরে এক আত্নীয়ের বাড়িতে।
তবে সেখানে গিয়ে পত্রিকার ‘পাত্রী চাই’ বিজ্ঞাপনের জের ধরে ইন্ডিজের এক সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যান। ভেবেছিলেন বিবাহিত জীবনে কিছুটা সুখের দেখা পাবেন হয়তো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাত বছরের সংসার জীবনের ইতি টানতে হয় তাকে।
এরপর তিনি চলে যান প্যারিসে। প্যারিসে শিল্পীদের মডেল হিসেবে নতুন জীবন শুরু করার চেষ্টা করলেও এবারও ব্যর্থ হতে হয় তাকে। তাই ফিরে আসেন হল্যান্ডে।
সেই হল্যান্ডে ফরাসি কূটনীতিক হেনরি দ্যু মার্গুয়েরির সাথে তার আলাপ হয়। সেখান থেকে আবারো ফিরে আসেন প্যারিসে। তবে এবার সেই কূটনীতিকের মিসট্রেস হিসেবে।
মার্গুয়েরি প্যারিসের নানান মহলে মার্গেরেটাকে পরিচয় করাতে থাকেন একজন পূজারী হিসেবে, যার অর্চনার মাধ্যম হচ্ছে নৃত্য। সেই থেকেই মার্গারেটা হয়ে উঠলেন মাতা হারি।
নাচতে নাচতে স্বল্পবসনা হয়ে যাওয়ার বিষয়টি মাতা হারিরই আবিষ্কার। তবে সেটিকে তিনি পূজার মতো পবিত্রতার পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। বলা হয়ে থাকে ফ্রান্সের প্রথম সারির কূটনীতিক থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশের মন্ত্রী, জেনারেল, শিল্পপতিরা তার এই অভিনব নাচ দেখার জন্য মুখিয়ে থাকতেন।
যারাই একবার তার নৃত্য দেখতেন তারাই মাতা হারির সাথে যৌনসম্পর্ক স্থাপনের ইচ্ছা পোষণ করতেন। আর তাদের সেই ইচ্ছাকেই নিজের অস্ত্র বানিয়ে হয়ে উঠেছিলেন দুর্ধর্ষ এক জার্মান গুপ্তচর। বড় বড় কেউকেটাদের এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে জেনে যেতেন গোপনীয় তথ্যসমূহ। আর সেই তথ্য পাচার করতেন জার্মানিতে।
মিত্রবাহিনীর সেনা কর্মকর্তাদের সাথে যৌনসম্পর্কের সুযোগে অনেক গোপনীয় তথ্য প্রতিপক্ষের নিকট পাঠিয়ে দিতেন তিনি। সেই কারণে হাজার হাজার মিত্রবাহিনীর সৈন্যের মৃত্যু হয়। আর এই অভিযোগের জের ধরেই তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তীতে ১৯১৭ সালে গুলি করে তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়।
তবে মাতা হারি সত্যিই গুপ্তচর ছিলেন কি না সেটি নিয়ে অনেকের মধ্যেই মতভেদ দেখা যায়। তারা বলেন ফরাসিরা নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে গিয়ে মাতা হারিকে বলির পাঁঠা হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন।
কিন্তু ধরা পড়ার পর ১৯১৫ সালে নিজের জার্মান গুপ্তচর হওয়ার ব্যপারটি তিনি স্বীকার করেন। তিনি আসলে দুই পক্ষের হয়েই কাজ করতে চেয়েছিলেন।
মৃত্যুর পর মাতা হারির লাশ কেউ নিতে আসেননি। তার সেই লাশ প্রদান করা হয় প্যারিসের মেডিকেল স্কুলে।
জুলিয়াস ও এথেল রোজেনবার্গ
গুপ্তচরদের নিয়ে কথা হবে কিন্তু তাতে রোজেনবার্গ দম্পতিকে স্মরণ করা হবেনা এমনটি হতে পারে না। ‘ইয়ং কমিউনিস্ট লীগ’ এর সদস্য হিসেবে জুলিয়াস রোজেনবার্গ ও এথেল গ্রীনগ্লাস এর সাক্ষাৎ হয় এবং পরবর্তীতে ১৯৩৯ সালে তাদের বিয়ে হয়।
১৯৫০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক বোমা সম্পর্কিত গোপনীয় তথ্য সোভিয়েত ইউনিয়নে পাচার করার অভিযোগে জুলিয়াসকে গ্রেফতার করা হয়। এর দুই মাস পরেই এথেলকে গ্রেফতার করা হয়। যদিও ১৯৫৩ সালে বৈদ্যুতিক চেয়ারে মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত তারা এই দায় অস্বীকার করে যান।
এথেলের ভাই ডেভিড গ্রীনগ্লাস সোভিয়েতদের তথ্য প্রদানে বোন ও ভগ্নীপতির সম্পৃক্ততার বিষয়টি আদালতে স্বীকার করেন। যার ভিত্তিতেই রোজেনবার্গ দম্পতিকে গ্রেফতার ও মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয় এবং তাকেও ১০ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
ফারজানা জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন।