Loading...

ইচ্ছেঘুড়ির ইচ্ছেরা: রঙতুলিতে বৈচিত্র্যময় কাঠের গহনা


ইচ্ছেঘুড়ির ইচ্ছেরা: রঙতুলিতে বৈচিত্র্যময় কাঠের গহনা

গহনা নারীর সাজসজ্জার অন্যতম অনুষঙ্গ। সেই প্রাচীন কাল থেকে অদ্যাবধি নারীরা সাজে গহনার জন্যে আলাদা একটি জায়গা রেখে দিয়েছে। তবে যুগ যুগ ধরে এই গহনার সৃজনীতে এসেছে নানা পরিবর্তন। কত কত ধাতু রতন মণি মুক্তোর গাঁথুনি পেরিয়ে আধুনিকতার ছোঁয়ায় আজ গহনা তৈরি হচ্ছে নানা রকম সৃজনশীল মাধ্যমে। তেমনি কাঠ মাধ্যমকে গহনা তৈরির কাঠামো করে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ইচ্ছেঘুড়ির নাটাই। ব্যতিক্রমধর্মী চিন্তাধারাকে কাঠের গায়ে ফুটিয়ে তৈরি করা হচ্ছে রকমারি গয়না।

কেন কাঠকে মাধ্যম হিসেবে বেছে নেয়া, এমন প্রশ্নে ইচ্ছেঘুড়ির কর্ণধার ও মূল ভাবক অর্পিতা সাহা সংগীতা বলেন কাঠ অন্য যেকোনো মাধ্যম থেকে সহজলভ্য এবং খুব বেশি ব্যয়বহুল নয়। কাঠের থেকে গহনা বানানো হলে ক্লে বা কাপড়ের গহনার থেকে সেটি বেশি টেকসই হয়।

অর্পিতা জানান তার গহনা তৈরির কাজে ব্যবহার কৃত কাষ্ঠল অংশটি মূলত সামগ্রিক কাঠের কাজের ফেলে দেয়া অংশ। এই অবশেষ অংশ গুলি একত্র করে ছাঁচে ফেলে বোর্ডের আকার দেয়া হয়। আর সেই বোর্ড ওপর আঁকা হয় কম্পিউটারাইজড নকশা। সেই অনুযায়ী কাটিং হয় সি এন সি মেশিন কিংবা বা লেজার বিম দিয়ে।আবার কখনো বা হাতেই হয় কাটাই-ছাটাই। এর পরে সেই খন্ডাংশ গুলি জোড়া হয় আঠায়। তারপরেই নানা আকার দিয়ে গড়া হয় নকশা।

ইচ্ছেঘুড়ির স্বত্বাধিকারী অর্পিতা সাহা সংগীতা

স্নাতক শেষ করার পরে চাকুরি নিয়ে সেভাবে কোনো চিন্তা না করে স্বনিয়োগী হতে চেয়েছিলেন অর্পিতা। তাই নিজের উদ্যোগে শুরু করা হাতের কাজের ছোট্ট বিপণন। কাজ শুরুর পুঁজি তেমন বিশেষ কিছুই না। ছোট থেকেই ছিল ছবি আঁকার ঝোঁক। এককালের ছবি আঁকার নেশাকেই নিয়ে এলেন পেশায়। এবারে কাঠের গায়ে আঁচড় কেটে কেটে ছবি আঁকা। আর সেই ছবিটাই গহনা। এমন ভাবনা থেকে ফেসবুকে একটি পাতা খুলে ফেলা এবং ইচ্ছেঘুড়ির আত্মপ্রকাশ।

ইচ্ছেঘুড়ি নামটা সুন্দর চিন্তার বার্তা দেয়, যেন মুক্তচিন্তার রূপক। ঘুড়ি আকাশে অবাধে উড়ে যায়, তেমনি মনের সুন্দর চিন্তাগুলি উড়ে পৌঁছে যাক মানুষের ঘরে ঘরে কিংবা গ্রাহকের মনের ইচ্ছেরা পাক একটি বাস্তব রূপ - এই প্রত্যয়ে নাটাই হতে ঘুড়ির সুতার মতো এগিয়ে চলা।

হরেকরকম বালা

প্রতিটা কাজ খুব আনন্দ নিয়ে করেন অর্পিতা সাহা। আঁকার প্রতি তার এতোই ভালোবাসা যে তিনি মনেই করেন না যে আলাদা ভাবে তিনি রুটি রুজির জন্যে কোনো কাজ করছেন। নিজের ভালো লাগাটাকে প্রত্যেকটি গহনার কাজে খুব যত্নে মিশিয়ে দেন।

তার গহনার প্রতিটি নকশার উৎস বাংলার সমৃদ্ধ ঐতিহ্য। সংস্কৃতি ও সাহিত্যের ছোঁয়াচ যেমনি আছে তেমনি আছে ষড়ঋতুর বর্ণময় পুষ্পের বঙ্গভূমি। ইচ্ছেঘুড়ির নকশায় বঙ্গনারীর কণ্ঠে শোভা পায় গ্রামের মেঠো পথ ধরে মনের সুখে গেয়ে যাওয়া বাউল , ভাওয়াইয়া গানের সুরে এগিয়ে চলা গরুর গাড়ি কিংবা গ্রামীন বধূর নকশিকাঁথার ফোঁড়। বাংলার প্রকৃতি থেকে কাঠের নকশা কাটা টুকরো গুলিতে রঙের ছোঁয়া লাগিয়ে ইচ্ছেঘুড়ি নিয়ে এসেছে জারুল, সোনালু, জবা, পদ্ম, পলাশ। আছে বনে বনে কূজন তোলা পক্ষীকুল। এসবের পাশাপাশি বাংলার সাহিত্য ও চলচ্চিত্র হতে উঠে এসেছে সবার প্রিয় প্রদোষ মিত্র আর গুপী গাইন বাঘা বাইন। চোখ এড়ায়নি গৃহকোণে দেয়া উৎসব পার্বণে গৃহবধূর সহজ রেখার আল্পনা।

এবার এই কাঠের টুকরো গুলিতে বাহারি টাসেল আর কাঠের পুঁতি জুড়ে তৈরি হয়ে যায় বুক জোড়া কণ্ঠহার অথবা চিক আর তার সাথে আংটি এবং কানের দুল। কাঠের চুড়ি গুলিতে তুলির টানে ফুটিয়ে তোলা হয় নানান নকশা। তবে ইচ্ছেঘুড়ির একটি বিশেষ চুড়ি আছে, সেটি হলো বিশ্বকবির হস্তাক্ষরের ভঙ্গিতে অঙ্কিত 'রবীন্দ্রনাথ স্বাক্ষর বালা'।

শুধু অলংকারে সীমাবদ্ধ নেই, আছে কাঠের নকশি ব্যাগ। গর্জন কাঠের প্লেটে সুতোর শক্ত বাঁধুনি জুড়ে প্রস্তুত ব্যাগে খুব সুন্দর করে আটিয়ে নেয়া যায় নিত্যপ্রয়োজনের ছোট ছোট জিনিস। ব্যাগগুলোর নান্দনিকতা বাড়িয়ে দিয়েছে নজর কারা ওয়ারলী চিত্রকলা, শান্তিনিকেতনী আল্পনা, জামদানি কিংবা শতরঞ্জির মোটিফ। অর্পিতা জানান এই বছরে এই ব্যাগগুলিতে ক্রেতারা বেশি আকৃষ্ট হয়েছে।

ইচ্ছেঘুড়ির শখের ঝুড়িতে কখনোই বাদ পড়ে না উৎসব-পার্বণ। সে হোক ঈদ বা শারদীয় দুর্গোৎসব বা পূর্ণিমা। এই উৎসব-পার্বণ গুলির দিনগুলি রাঙাতে প্রতিবারই ইচ্ছেঘুড়ি নতুন করে ভাবে। নিত্যনতুন কাঁচামাল দিয়ে চলে নতুন ভাবনাচিন্তা। হারের টাসেল হোক বা ব্যাগের হাতে ঝুলিয়ে রাখার অংশের ফিতা গতানুগতিকতা হতে বেরিয়ে হাতের অনন্য বুননে পৌঁছায় গ্রহীতার কাছে। আর প্রতিটি পণ্যের থাকে বাহারি সব নাম।

ইচ্ছেঘুড়ির অনন্য নকশি অলংকার দেশের সীমা পেরিয়ে নজর কেড়েছে ভিনদেশের প্রবাসীদের। ২০১৯ সাল থেকে এই হস্তশিল্পজাত পণ্যগুলি পাড়ি জমিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র , অস্ট্রেলিয়া , সিঙ্গাপুর এবং নিকট প্রতিবেশী ভারতে। সন্তোষজনক সাড়া পেয়ে সম্প্রতি ইচ্ছেঘুড়ি ভারতে শিপিং ব্যবস্থা চালু করেছে ভারতীয় বন্ধুদের জন্যে ।দেশীয় সংস্কৃতিকে এভাবে ভিনদেশে পৌঁছে দিতে পারাকে বড় একটি সাফল্য মনে করেন অর্পিতা সাহা। তিনি বলেন, " আমাদের দেশীয় হস্তশিল্পগুলিতে আমাদের নজর বাড়াতে হবে। প্রজন্মের রুচিবোধ অনুযায়ী নকশা উঠিয়ে আনতে হবে। শিল্পগুলির চর্চা ও বিকাশের পাশাপাশি পণ্যের মান উন্নত করার চেষ্টা করতে হবে, তাতে করে আমরা দেশে ও বিদেশে সমান ভাবে ক্রেতা পাবো।"

অর্পিতা আরো বলেন, "আমাদের মধ্যে বিদেশি পণ্য ঘরে তোলার একটি অন্যরকম ঝোঁক কাজ করে। এর একটি কারণ অবশ্য হতে পারে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী নিম্নমানের পণ্য বাজারে আনেন যার ফলে আমরা বিমুখ হয়ে পড়ি। এটা না করে একটু ভালো জিনিস বাজারে আনলেই দেশীয় পণ্যের প্রতি একটা ভালোবাসা তৈরি হবে। আর সেটা হচ্ছেও বটে। পূর্বের তুলনায় মানুষ এখন হাতের কাজের জিনিসে উৎসাহ দেখাচ্ছে, সেটা হোক অনেকটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণেই। "

তবে ইচ্ছেঘুড়ি অন্তর্জালের জগৎ থেকে বেরিয়ে একটি পৃথক অস্তিত্ব তৈরি করেছে। চট্টগ্রাম শহরে উডপ্রিন্ট নামে ছোট আউটলেটে ইচ্ছেঘুড়ি সাজিয়েছে ছোট একটি কর্ণার। রাজধানীর অনেক ক্রেতার কথা ভেবে অচিরেই ঢাকায় হতে পারে আরেকটি আউটলেট এমন একটি পরিকল্পনা আছে অর্পিতার।

নারী উদ্যোক্তা হিসেবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা জানিয়ে অর্পিতা বলেন নতুন কাজ শুরু করতে গিয়ে অনেক ধরনের বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। সবচেয়ে বড় সংকট লোকবল। এই অভাবটা শুধু প্রশিক্ষিত লোকের নয় লভ্যাংশ কম বলে অভাব রয়েছে মানুষের আগ্রহে। তবে ভালোবেসে এই কাজে আসলে ধৈর্য্য, পরিশ্রম, মেধা এই চাবিকাঠিকে সঙ্গী করে মাটি কামড়ে থাকার মতো পড়ে থাকতে হবে। ভালো খারাপ যেটাই হোক চাই মেনে নেয়ার মানসিকতা। যেকোনো হস্তশিল্প আসলে সেই মানুষটি তার মনের সৌন্দর্য ও আনন্দ দিয়ে তৈরি করেন আর আবেগ দিয়ে গড়া জিনিসের কোনো মূল্য হয় না।

যত্নে গড়া শখের গহনাগুলি যেনো ব্যবহারকারীদের গৃহকোণেও খুব সুন্দরভাবে যত্নে থাকে সেজন্য অর্পিতা পরামর্শ দিয়েছেন যথাযথ সংরক্ষণের। সংগ্রহে থাকা রঙিন কাঠের গয়নাগুলি বহুদিন অক্ষত রাখতে চাইলে রাখতে হবে আর্দ্র আবহাওয়া থেকে দূরে। এজন্য ব্যবহারের পরে ভালো ভাবে মুছে রাখতে হবে বায়ুনিরোধক বাক্সে। গহনাতে থাকা যাবে না কোনো ভেজাভাব, এজন্য রোদে দেয়া যেতেই পারে মাঝেমাঝে।

সুস্মিতা রায় বর্তমানে শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিকেল কলেজে ৪র্থ বর্ষে পড়াশোনা করছেন।

[email protected]

 

Share if you like

Filter By Topic