অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ-এর থেকে যে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছে সেটি চূড়ান্ত করতে আরও কিছু সংস্কার চেয়েছে সংস্থাটি।
ঋণ পাবার জন্য বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে বেশ কিছু শর্ত পূরণ করলেও আইএমএফ আরো কিছু সংস্কার চাইছে।
আইএমএফ চায় বাংলাদেশ সরকার রাজস্ব আদায় আরো বাড়াক এবং খেলাপি ঋণের পরিমাণ ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনা হোক।
বাংলাদেশে সফররত সংস্থাটির উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক অ্যান্টোয়নেট এম সায়েহ সোমবার এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানিয়েছেন।
সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, রোববার অর্থমন্ত্রী আহম মোস্তফা কামাল এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাতে তিনি ৩০শে জানুয়ারি ঋণ চূড়ান্ত করার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে বলে আভাস দিয়েছেন।
সেই সাথে ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশকে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ দেশে উত্তরণে আইএমএফ-এর সহায়তা অব্যাহত রাখার কথাও তিনি জানান।
ঋণ সহায়তা এবং শর্ত
কোন দেশ বৈদেশিক রিজার্ভ নিয়ে সংকটে পড়লে সাধারণত আইএমএফের দ্বারস্থ হয় এবং সংস্থাটি ওই ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে নীতিগত কিছু সংস্কারের শর্ত দেয়।
গত এক বছর যাবত বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমাগত কমছে। একই সাথে শুরু হয় ডলারের সংকট।
ফলে ডলারের বিপরীতে টাকার ব্যাপক দরপতন হয়, যেটি অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়।
সংকট সামলাতে ২০২২ সালের জুলাই মাসে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ সহায়তার জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ-এর দ্বারস্থ হয় বাংলাদেশ।
আইএমএফের একটি প্রতিনিধিদল ২০২২ সালের ২৬শে অক্টোবর থেকে নয়ই নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ সফর করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং অর্থমন্ত্রনালয়ের সাথে বৈঠক করে।
সেখানে আর্থিক খাতে সংস্কারে নানা শর্তের কথা উঠে আসে।
পরে নভেম্বরে ঢাকায় কর্মকর্তা পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশকে এই ঋণ দেয়ার ব্যাপারে প্রাথমিক সমঝোতায় পৌঁছায় আইএমএফ।
সেসময় অর্থ মন্ত্রণালয় জানায়, ঋণ দেওয়ার জন্য মোটাদাগে তিন ধরনের শর্ত দেওয়া হয়েছে।
প্রধান তিন শর্ত হল:
* গুণগত মান উন্নয়ন সংক্রান্ত শর্ত
* অবকাঠামোগত মান উন্নয়ন সংক্রান্ত শর্ত
* সাধারণ শর্ত।
গুণগত মান উন্নয়ন সংক্রান্ত শর্ত হচ্ছে বাধ্যতামূলক শর্ত, যেগুলো মানতেই হবে।
এরমধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী সংশোধন করা।
আরেকটি শর্ত হল, বাজেট ঘাটতি যেন অসহনীয় পর্যায়ে না যায়, যার কারণে সরকারকে চাপে পড়তে হয়।
অবকাঠামোগত মান উন্নয়ন সংক্রান্ত শর্তের মধ্যে রয়েছে - অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায় বাড়ানো, নতুন আয়কর আইন সংসদে পাস করে কার্যকর করা, জ্বালানির দাম নির্ধারণে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী পদ্ধতি কার্যকরসহ আরো বেশ কিছু সংস্কার।
অন্যান্য শর্তের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি কমানো, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো, ব্যাংকের আমানত এবং ঋণের সুদের হার বাজার দরের উপর ছেড়ে দেয়া, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমানো ইত্যাদি।
আসছে ৩০শে জানুয়ারি আইএমএফের পর্ষদ বৈঠকে ঋণ প্রস্তাবের অনুমোদন হওয়ার কথা রয়েছে।
রোববার ১৫ই জানুয়ারি অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ঋণ পেতে ইতোমধ্যে কিছু সংস্কার কাজে হাত দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে সরকার, যা আইএমএফ সমর্থন করেছে।
সব ঠিক থাকলে ৪২ মাসে, মোট সাত কিস্তিতে সংস্থাটি বাংলাদেশকে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ দেবে।
এ ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে সুদ হার নির্ধারিত হবে বাজারদর অনুযায়ী, যা গড়ে দুই দশমিক দুই শতাংশ হতে পারে।
এর মধ্যে বাজেট সহায়তা বাবদ ৩২০ কোটি ডলার। বাকি ১৩০ কোটি ডলার জলবায়ু পরিবর্তন-জনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় ব্যয় করতে হবে।
প্রথম কিস্তি ফেব্রুয়ারি বা মার্চ নাগাদ আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
ঋণ প্রদান চলবে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।
তবে ঋণ পাওয়ার পর সেটির সঠিক ব্যবহারের ওপর জোর দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
তারা বলছেন, “ শুধু আইএমএফ এর শর্ত মানতে নয় বরং দেশের কল্যাণের স্বার্থে এবং আর্থিক খাতের অনিয়ম দুর্নীতি দূর করতে সরকারের উচিত হবে ঋণের টাকার উত্তম ব্যবহার করা।”
শর্ত বাস্তবায়নে কত দূর
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রতিটি কিস্তি দেয়ার আগে শর্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনা করবে আইএমএফ। শর্ত পূরণ না হলে কিস্তি আটকে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
এক্ষেত্রে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে খুব সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বিবিসি বাংলাকে বলেন, ঋণের টাকা বাংলাদেশ কিভাবে ব্যবহার করবে সেটি বিস্তারিত বলা থাকবে এবং সময়সূচী ও লক্ষ্যমাত্রা উল্লেখ থাকবে।
"ফলে সুনির্দিষ্টভাবে কী কী কর্মসূচি কীভাবে বাস্তবায়ন হবে সে সম্পর্কে একটি প্রতিশ্রুতিপত্র সরকারকে দিতে হবে," বলেন মি. ভট্টাচার্য্য।
বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতি সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে।
আইএমএফ বলেছিল, বাংলাদেশ যেভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসেবে করছে সেটি আন্তর্জাতিক মাণদণ্ড অনুযায়ী করা হচ্ছে না।
রিজার্ভ থেকে যেসব অর্থ বিভিন্ন জায়গায় বিনিয়োগ করা হয়েছে সেটি হিসেব থেকে বাদ দিতে হবে। ফলে প্রকৃত রিজার্ভ আরো কমে যাবে।
ভর্তুকি কমাতে জ্বালানি তেলের দাম কয়েকমাস আগে জ্বালানী তেলের দাম ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করেছিল বাংলাদেশ সরকার।
বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হয়েছে। গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করার চিন্তাভাবনাও করা হচ্ছে।
বছরে দু’বার মুদ্রানীতি ঘোষণা শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ভোক্তা ঋণের সুদহার তিন শতাংশ বাড়িয়ে ১২ শতাংশ করা হয়েছে। একইসঙ্গে ব্যাংক আমানতের বেঁধে দেওয়া সুদহার তুলে দেওয়া হয়েছে।
ডলারের সাথে টাকার বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
আর্থিক খাতের সংস্কারে কয়েকটি নতুন আইন প্রণয়নের পাশাপাশি পুরনো আইন সংশোধনে কাজ চলছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গিয়েছে।
সরকার আইএমএফ-এর শর্তগুলো মানার ক্ষেত্রে ইতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের রিজার্ভের যা অবস্থা তাতে আইএমএফ এর এই ঋণ খুব প্রয়োজন। তাই সরকার এই শর্তগুলো মানার ক্ষেত্রে এখনও আন্তরিক রয়েছে।
এসব শর্ত মানলে বিশ্বব্যাংক, এডিবি এবং বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশের ঋণ পাওয়া সহজ হতে পারে বলে তিনি জানান।
তবে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ফেরাতে যে শর্ত দেয়া হয়েছে সেটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের রাজনৈতিক অবস্থান রয়েছে কিনা সেটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মি. মোয়াজ্জেম।
বিদ্যুৎ খাতে অপচয় না কমিয়ে দাম বৃদ্ধি করে ভোক্তাদের উপর চাপিয়ে দেবার বিষয়টিতে আপত্তি তুলেছেন তিনি।
কারণ বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির বড় অংশই খরচ হয় ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ।
মি. মোয়াজ্জেম মনে করেন, “সরকার যদি ক্যাপাসিটি চার্জ থেকে বেরিয়ে আসে সেইসঙ্গে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, কুইক রেন্টাল, অদক্ষ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, আমদানিকৃত জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র থেকে সরে আসে এবং নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দিকে যান তাহলে তাহলে প্রতিযোগিতামূলক বাজার কাঠামোতেও বিদ্যুতের মুল্য কমার কথা, বাড়ার কথা না।”
আরও যে সংস্কার চেয়েছে আইএমএফ
সোমবারের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে মিজ অ্যান্টোয়নেট অর্থনৈতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রশংসা করলেও কয়েকটি ক্ষেত্রে সংস্কারের কথা বলেছেন।
সংস্থাটি চায় মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় রাজস্ব আয় সন্তোষজনক পর্যায়ে বাড়ুক এবং খেলাপি ঋণ কমুক।
বিবৃতিতে বলা হয়, রাজস্ব আহরণ বাড়ানো, শক্তিশালী আর্থিক খাত গড়ে তোলার মতো দীর্ঘস্থায়ী চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে তারা আলোচনা করেছেন। এসব ক্ষেত্রে সংস্কারের কথা বলা হয়েছে।
সেইসাথে, বেসরকারি বিনিয়োগ এবং রপ্তানি বহুমুখীকরণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি সংস্কার আনার কথাও তিনি জানান।
তার মতে, এসব সংস্কারের ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও সহনশীল এবং দীর্ঘমেয়াদে অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়ে উঠবে।
টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনে অনুকূল পরিবেশ তৈরিতেও সক্ষম হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের দীর্ঘমেয়াদী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশের পরিকল্পনা নিয়েও আলোচনা হয়েছে বলে জানান আইএমএফ এর এই কর্মকর্তা।
তার মতে, জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতিকে দীর্ঘমেয়াদে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।
এই হুমকি মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশের যে ধরণের জলবায়ু বিনিয়োগ প্রয়োজন সেজন্য সাশ্রয়ী ও দীর্ঘমেয়াদে অর্থায়ন ত্বরান্বিত করার কথা জানিয়েছে আইএমএফ।
আবার আমদানি নির্ভর জলবায়ু খাতে বিনিয়োগ করতে গিয়ে রিজার্ভের ওপর যেন চাপ না পড়ে সেই লক্ষ্য থাকার কথাও জানিয়েছে আইএমএফ এর আরএসএফ (রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনিবিলিটি ফ্যাসিলিটি)।
প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য বাংলাদেশ যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সেগুলোকে স্বাগত জানিয়েছেন মিস অ্যান্টোয়নেট।
বাংলাদেশ ১৯৭২ সাল থেকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের একটি সদস্য দেশ।
এর আগে একাধিকবার এই প্রতিষ্ঠান থেকে বাংলাদেশ ঋণ নিলেও তা কখনো ১০০ কোটি ডলারের সীমা পার হয়নি। খবর বিবিসি বাংলার।