অরোরা বা মেরুপ্রভা: রাতের আকাশে স্বর্গীয় আলোর ঝলকানি


শুভ্র সাইফ | Published: December 01, 2022 19:16:26 | Updated: December 01, 2022 21:56:25


অরোরা বা মেরুপ্রভা: রাতের আকাশে স্বর্গীয় আলোর ঝলকানি

মার্কিন পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গের ‘দ্য বিগ ফ্রেন্ডলি জায়ান্ট’ সিনেমাটি দেখেছেন কি? চমৎকার এই অ্যানিমেটেড সিনেমাতে রয়েছে বেশকিছু চোখ ধাঁধানো গ্রাফিক্স সম্বলিত দৃশ্য। আর সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যটি হলো বিএফজি’র ফিজউইজার্ড ধরার দৃশ্যটি। একটি বড় গাছের সামনে বিএফজি যখন ফিজউইজার্ড ধরায় ব্যস্ত, তখন গাছের পেছনে দুলতে থাকা রহস্যময় আলোর পর্দাটি লক্ষ করেছেন? অদ্ভুত সুন্দর সেই আলোর পর্দাটি কিন্তু মোটেও অবাস্তব নয়। এটিকে আমরা অরোরা হিসেবে জানি।

অরোরা বা মেরুপ্রভা মানুষের নিকট এক চিরন্তন রহস্যের নাম, যা যুগে যুগে মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। এর রহস্য আধুনিক বিজ্ঞান ভেদ করতে সক্ষম হলেও এর আকর্ষণ কমেনি বিন্দুমাত্র। কমবেই বা কেন? শিল্পীর তুলির আঁচরে সৃষ্ট শৈল্পিক সৌন্দের্যের আকর্ষণ কমে নাকি কখনো? আর শিল্পী যখন প্রকৃতি নিজে, তখন তো কথাই নেই! 

দূর আকাশ থেকে ভূপৃষ্ঠ পর্যন্ত অদৃশ্য দড়িতে অদৃশ্য এক ক্যানভাস ঝুলিয়ে তাতে নিজের খেয়ালে আঁকিবুঁকি করে প্রকৃতি নামক অদৃশ্য শিল্পী। তবে, অদৃশ্য শিল্পীর অঙ্কন অদৃশ্য থাকে না। এই অঙ্কন সমুদ্রের তলদেশ থেকে সংগ্রহ করে আনা নীলকান্তমণির মতো চোখ ধাঁধানো আলোয় জ্বলতে থাকে, দেখা যায় দূর দূরান্ত থেকে। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ সহ আরো কত কত বাহারি রঙে রঙিন হয়ে জ্বলজ্বল করতে থাকা বিশাল আলোর পর্দাটি প্রতি মুহূর্তে বদলায় রঙ, বদলে যায় এর আকৃতিও। 

অরোরা নিয়ে মানুষের আগ্রহ প্রাচীনকাল থেকেই। প্রাচীন গ্রীকরা মনে করতো, শেষরাতে এই আলোর ঝলকানি হলো পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়া আত্মাদের ছুটে বেড়ানোর দৃশ্য। আবার চীনারা ভাবতো, স্বর্গে ভালো আর মন্দ ড্রাগনের মাঝে মারামারি থেকে ঠিকরে বেরোয় এ আলো।

১৭ শতকে জ্যোতির্বিদ গ্যালিলিও গ্যালিলি এই আলোর রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করলেও শেষতক বেশিদূর এগোতে পারেননি। তিনিই গ্রীকদের ভোরের দেবী ‘অরোরা’র নামে এর নামকরণ করেন। আর্কটিক সাগরের তীরবর্তী দেশগুলোতে, আলাস্কা, আইসল্যান্ড, গ্রিনল্যান্ড এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে একে বলা হয় ‘অরোরা বোরিয়ালিস’ বা ‘নর্দান লাইটস’। যুক্তরাষ্ট্র এবং দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলোতে এটি ‘অরোরা অস্ট্রালিস’ বা ‘সাউদার্ন লাইটস’ নামে পরিচিত। 

অরোরা বা মেরুপ্রভা সৃষ্টির পেছনে প্রধান নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে সূর্য। আরো নির্দিষ্ট করে বললে, সূর্যে সৃষ্টি হওয়া সৌরবায়ু কোটি কোটি মাইল পথ পাড়ি দিয়ে পৃথিবীতে পৌঁছুলে সৃষ্টি হয় অরোরা। সূর্য থেকেই শুরু করা যাক। সূর্যের সর্ববহিঃস্থ পৃষ্ঠের নাম করোনা। করোনার তাপমাত্রা কয়েক মিলিয়ন ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত হয়, যেখানে খালি চোখে দেখা সৌরপৃষ্ঠের তাপমাত্রা মাত্র ৫ হাজার ডিগ্রী সেলসিয়াস।

এমন প্রচণ্ড তাপমাত্রা আর চরম পরিবেশে পদার্থ এর চতুর্থ অবস্থা তথা প্লাজমায় পরিণত হয়। প্লাজমা হলো পদার্থের এমন রূপ, যেখানে এর ইলেকট্রন, প্রোটন (ইলেকট্রনবিহীন নিউক্লিয়াস) পারমাণবিক বন্ধন ছিন্ন করে মুক্ত অবস্থায় বিচরণ করে। ইলেকট্রন ও প্রোটনের সংখ্যা সমান হওয়ায় করোনা তড়িৎ চার্জ নিরপেক্ষ থাকে। কিন্তু বিপত্তি ঘটে ফিউশন বিক্রিয়ায়। 

একটি ফিউশন বিক্রিয়ায় দুটি প্রোটন (হিলিয়াম+ নিউক্লিয়াস) একত্রিত হয়ে একটি ডিউটেরিয়াম গঠন করে। এ বিক্রিয়ায় প্রচুর পরিমাণ শক্তির সাথে উৎপন্ন হয় একটি পজিট্রন। দুটি প্রোটনের বিপরীতে উদ্বৃত্ত থেকে যাওয়া দুটি ইলেকট্রনের একটি ধ্বংস হয়ে যায় পজিট্রনের সাথে ক্রিয়া করে। কিন্তু অবশিষ্ট একটি ইলেকট্রন সৌরপৃষ্ঠের তড়িৎ নিরপেক্ষতা নষ্ট করে। প্রতি মুহূর্তে ঘটতে থাকা কোটি কোটি ফিউশন বিক্রিয়ায় কোটি কোটি উদ্বৃত্ত ইলেকট্রন থেকে যায়। এতে করে সৌরপৃষ্ঠে বাড়তে থাকে অস্থিরতা।

আবার সময়ের সাথে ইলেকট্রনগুলোও শক্তি সঞ্চয় করে। এক সময় এই অতিপারমাণবিক কণাগুলো পর্যাপ্ত শক্তি সঞ্চয় করে সৌরপৃষ্ঠ থেকে প্রবল বেগে বেরিয়ে যায়। বিপুল পরিমাণ ইলেকট্রন, প্রোটন ও অন্যান্য চার্জিত কণিকার ঘন্টায় প্রায় ১০ লক্ষ মাইল গতিবেগে সৌরপৃষ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসাকেই বলে সৌরবায়ু। 

সৌরবায়ুর একটা ছোট অংশই কেবল সূর্যের প্রবল মহাকর্ষ বল উপেক্ষা করে মহাকাশে ছুটে আসতে পারে। চার্জিত এই অতিপারমাণবিক কণিকাগুলো পৃথিবীর নিকটে এসে পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রে দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে বিচ্ছুরিত হয়। তবে, এদের একাংশ পৃথিবীর দুই মেরু দিয়ে চৌম্বকক্ষেত্রের সমান্তরালে পৃথিবীতে প্রবেশের সুযোগ পেয়ে যায়। বলা বাহুল্য, এই একাংশই কোটি কোটি চার্জিত কণিকা।

এই কণিকাগুলো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের নানা উপাদানের সাথে তীব্র সংঘর্ষে জড়ায়। সংঘর্ষের ফলে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের পরমাণুগুলোর বিভিন্ন কক্ষপথে থাকা ইলেকট্রনগুলো শক্তিপ্রাপ্ত হয় এবং লাফিয়ে লাফিয়ে উপরের কক্ষপথে চলে যায়। তবে প্রায় সাথে সাথেই তারা শক্তি হারিয়ে নিজেদের পূর্বের কক্ষপথে ফিরে আসে। এসময় শক্তিরূপে ফোটন বা আলোর প্যাকেট নির্গত হয়।

প্রতিমুহূর্তে কোটি কোটি সংঘর্ষে কোটি কোটি ফোটন নির্গত হয় যেগুলো একত্রে আমরা মেরুপ্রভা হিসেবে দেখতে পাই। সৌরবায়ুর প্রবেশের উপর নির্ভর করে মেরুপ্রভা দিনের বেলাতেও সৃষ্টি হতে পারে, যদিও সূর্যালোকের তীব্রতায় তা দেখা যায় না। 

মেরুপ্রভার রঙ নির্ভর করে সংঘর্ষের ধরন এবং ভূপৃষ্ঠ থেকে সংঘর্ষের উচ্চতার উপর। অক্সিজেন পরমাণুর সাথে সংঘর্ষ ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৫০ মাইলের অধিক উচ্চতায় লাল, এর কম উচ্চতায় হলুদ ও সবুজ আভা সৃষ্টি করে। আবার, ১০০ মাইল পর্যন্ত উচ্চতায় নাইট্রোজেন পরমাণুর সাথে সংঘর্ষে নীল আলো সৃষ্টি হলেও এর কম উচ্চতায় বেগুনী কিংবা গোলাপী রঙের আলো বিচ্ছুরিত হয়। 

msislam8686@gmail.com

Share if you like