চলছে দুর্গাপূজার মরসুম। পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার, লক্ষ্মীবাজার, তাঁতিবাজারের মত এলাকাগুলোয় তৈরি হয়েছে দৃষ্টিনন্দন মন্ডপ। মন্ডপে মন্ডপে নেমেছে মানুষের ঢল। গতকাল অষ্টমীর দিন যেমন ছিল উপচে পড়া ভিড়। এই ভিড় যে শুধু মন্ডপ বা বিভিন্ন দোকানে তা নয়, পিছিয়ে নেই মিষ্টির দোকানগুলোও।
৬৫ নং শাঁখারীবাজারের অমূল্য মিষ্টান্ন ভান্ডারে যেমন দেখা গেল দোকানভর্তি মানুষ। একদিকে বড় ডালায় সাজিয়ে রাখা কচুরি, আমিত্তি; বিপরীত দিকে তুমুল বিক্রি-বাট্টা হচ্ছে তিন প্রকারের লাড্ডুর। বাসে করে শাঁখারীবাজারের মুখে ৫১ বছরের পুরনো সংগঠন প্রতিদ্বন্দ্বীর বিশাল প্যান্ডেলের সামনে নেমে প্যান্ডেল ঘুরে আসা যাবে এখানে। অথবা এদিকে না ঢুকে আরো সামনে গিয়ে রিকশায় পাটুয়াটুলী হয়ে যাওয়া যাবে শাঁখারীবাজারের ওদিকটায়।
দোকানটির সাইনবোর্ড থেকে জানা যায় এর বয়স এখন পঞ্চাশ বছর। দোকানের ভেতরে টানানো আছে প্রতিষ্ঠাতা অমূল্য চন্দ্র সাহার ছবি। বাংলা ১৩৯৬ সালের শ্রাবণে তিনি প্রয়াত হয়েছেন। বর্তমানে দোকানটির দায়িত্বে আছেন তার ছেলে রাজীব সাহা।
তবে এদিন রাজীব সাহার অনুপস্থিতিতে দোকানের ক্যাশে বসেছিলেন তার পুত্র রাতুল চন্দ্র সাহা। তিনি বললেন, “এই দোকান তো আজকের না, পঞ্চাশ বছর বয়স। আমার ঠাকুর্দা এটা শুরু করেছিলেন। আমি নিয়মিত বসিনা। বাবা মূলত বসেন। এখন পূজা নিয়ে আরো অনেক ব্যস্ততা যাচ্ছে। তাই আমি বসেছি আজকে।”
প্রাসঙ্গিক তথ্যের জন্য দেখিয়ে দিলেন বিপরীতে থাকা এক ভদ্রলোককে। তার নাম লক্ষ্মণ কুমার সাহা। তিনি এই দোকানের সাথে যুক্ত আছেন পঁচিশ বছর ধরে। তবে এই এলাকার মানুষ হওয়ায় ছোটবেলা থেকেই দেখেছেন দোকানটির সমৃদ্ধি।
তিনি জানালেন, “দোকানটি যখন প্রথম হয়, তখন এত বড় ছিল না। এখন তো ভেতরে ২৪ জন বসা যায় সর্বোচ্চ। তখন হয়ত ৬-৮ জন বসা যেত। দোকানের নাম ছিল সাইনবোর্ডে টানানো। এখন যেমন লাল ব্লক লেটারিং, সেটা ছিল না। কিন্তু তখন জিনিসের দাম ছিল কম। মাল আসতো ভালো।”
“সে সময় মানে সত্তর দশকে লুচি ছিল পঁচিশ পয়সা করে। এই দোকানে যে শুধু মিষ্টি বানানো হয়, তা নয়। সকালে নাস্তাও করা যায়। ডাল, ভাজি, হালুয়া পাওয়া যায়। এখন লুচি ছয় টাকা করে। ডাল, ভাজি, হালুয়া প্রতি প্লেট ১৫ টাকা। তখন ডাল ছিল ১ টাকা প্লেট। ভাজিও তাই। লুচি ভাজতো ঘি দিয়ে। সে কি ঘ্রাণ! আর খাঁটি সরিষার তেল দিয়ে করতো এই তরকারিগুলো। সেই স্বাদ একেবারেই অন্য ব্যাপার, স্বর্গীয় এক স্বাদ ছিল সেটা।'
ন রকমের লাড্ডূ (ডালডা, ঘি ও নরমাল), রকমারি মিষ্টি-সন্দেশ ও কচুরি
তবে আশির দশকের মাঝামাঝির পর থেকে সরিষার তেলের দাম বেড়ে যাওয়া ও সয়াবিনের তেলের প্রচলনের পর থেকে তরকারি-ভাজিতে সয়াবিন ও পরে পাম ওয়েল ব্যবহার শুরু হয় বলে জানান তিনি। লুচি ভাজার ক্ষেত্রেও আশির দশকের পর ঘির পরিবর্তে সয়াবিন আসে।
লক্ষ্মণ আরো জানান, “আমাদের সকাল ছয়টার পর থেকে সকাল দশটা-এগারোটা পর্যন্ত তরকারি-সবজি থাকে। ডাল হিসেবে বুটের ডাল দেয়া হয়। আর সবজি আলাদা। সেটা বিভিন্নরকম সবজি মিক্স করে বানানো হয়, অনেকটা লাবড়ার মত। হালুয়া করা হয় সুজির। হালুয়ায় ঘি মেশানো হয় কিছুটা। আর লুচি সন্ধ্যাতেও পেতে পারেন।”
তিনি দোকানে আছেন পঁচিশ বছর। ১৯৯৭ সালের কথা সেটা। তখনকার অবস্থা বিষয়ে বললেন, “অমূল্য বাবু ততদিনে মারা গেছেন। রাজীব দা তখন দোকানে বসেন, এখনো উনিই মূলত বসছেন। তবে দোকানের একেবারের শুরুর দিকের ময়রা/ কারিগররা অনেকেই তখন ছিলেন। একারণে তখনকার জিনিসপাতি বা কাঁচামালের মান ছিল খুবই সেরা। এখনও মিষ্টি তৈরিতে আমরা যত্নশীল। তবে এখনকার মাল যারা সরবরাহ করে, তারা বয়সে তরুণ, ওদের তুলনায় অভিজ্ঞতা কম।”
একসময় এই এলাকায় এটিই ছিল একমাত্র মিষ্টির দোকান। তাই বিক্রি ছিল খুবই রমরমা। অবশ্য এখনো ঘরভর্তি মানুষ দেখে বোঝা গেল বিক্রি এখনো দারুণ হয়।
লক্ষ্মণবাবু বললেন, “আগে চারপাশে এত মিষ্টির দোকান ছিল না। একারণে যে দুই-একটা দোকান ছিল, তাতেই দারুণ বিক্রি হতো। এখন দোকান বেড়েছে, তবে মিষ্টির ক্রেতা খুব বেশি কমেছে তা নয়। ব্যবসার পরিস্থিতি এখনো ভালো। বিশেষত পূজার সময়ে তো বিক্রি দারুণ হয়।''
সামনে থাকা বিক্রয়কর্মী রতন তখন ব্যস্ত লাড্ডু বিক্রিতে। তিনি দেখিয়ে দিলেন কোনটা কী ধরনের লাড্ডু। কমলাঞলাড্ডুটি ঘিয়ের, হলুদ ডালডার, আরেকটি নরমাল লাড্ডু। ঘিয়েরটা কেজি ৩০০ টাকা, ডালডা ২৮০ টাকা, নরমাল ২৪০ টাকা। জানা গেল, এই লাড্ডুগুলো অন্য সময় বানানো হয়না। এগুলো পূজা উপলক্ষে বিশেষভাবে বানানো।
লক্ষ্মণবাবু পেছন থেকে বললেন, “এগুলো একেবারে টাটকা। প্রতিদিন যা বানানো হয়, দিনেরটা দিনেই শেষ হয়। দশমী পর্যন্ত এভাবে প্রতিদিন বানানো চলতে থাকবে। দোকানতো আমরা ভোর ছটায় খুলি, রাত এগারোটায় বন্ধ করি। পূজার সময় রাত সাড়ে বারোটা-একটা পর্যন্ত বিক্রি চলবে।''
দোকানের ক্যাশ কাউন্টারের কাছে আবার ফিরতেই চোখে পড়লো ঘি আর ডালডার এই লাড্ডুগুলো এদিকেও রাখা আছে। রাতুল চন্দ্র সাহা জানালেন, “ঘিয়ের লাড্ডু মানে যে পুরোটা ঘিয়ে ভাজা তা নয়। তেলের সাথে ঘি মিশিয়ে ভাজা হয়। ''
নিচের তাকে থাকা দুই বয়াম ঘি দেখিয়ে বললেন, “ ঘিয়ের যে দাম, তাতে পুরোটা ঘিয়ে ভাজতে গেলে আমাদের আর ব্যবসা করা সম্ভব হবেনা। সেক্ষেত্রে লাড্ডুর কেজি ৩০০ এর জায়গায় ৬০০ টাকা করতে হবে।”
দোকানের ভেতর ক্যাশ কাউন্টারের পাশ থেকে শুরু করে ডানপাশের পুরোটা জুড়ে তিনসারিতে আছে রকমারি মিষ্টি ও সন্দেশ। মূল্য তালিকা আছে পাশেই।
দোকান তখন লোকে ভর্তি। বেশিরভাগ মানুষই লাড্ডু, ছানার সন্দেশ, কচুরী, কালোজাম, আমৃত্তি নিচ্ছিলেন। ছানার সন্দেশের ভেতর আবার গুড়ের সন্দেশের চাহিদা বেশি। তবে চিনি ও গুড় দুধরণের ছানার দাম সমান। এ বিষয়ে রাতুল বললেন, “ একসময় ছানা শুধু গুড় দিয়েই হতো। চিনিরটা পরে আসছে। গুড়েরটার দাম সেই তুলনায় বাড়ানো হয়নি, এমনিতেও ওটা বেশ ভালো চলে।”
তার প্রমাণ অবশ্য চোখের সামনেই দেখা গেল। প্রৌঢ় এক দম্পতি এককেজি মিষ্টি নিতে এসেছিলেন। তারা সব মিষ্টিতে চোখ বুলিয়ে গুড়ের এই ছানা সন্দেশই পছন্দ করলেন।
তাদের দোকানে অন্য সব প্রচলিত মিষ্টিই আছে। তবে বিশেষ আকর্ষণ হলো ছানার পোলাও ও কচুরি। ছানার পোলাও একসময় পুরান ঢাকার প্রায় সব মিষ্টির দোকানেই ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক দোকান থেকে হারিয়ে গেছে। তবে তারা এখনো ধরে রেখেছেন। তাদের ছানার পোলাওয়ের আলাদাভাবে সুখ্যাতি আছে এই এলাকায়।
দোকানের মূল্যতালিকা (বামে), প্রতিষ্ঠাতা অমূল্য চন্দ্র সাহা ও ম্যানেজার-কর্মচারীবৃন্দ
তবে সবচেয়ে চমকপ্রদ আইটেমটি হলো তাদের কচুরি। এই তেলেভাজা আইটেমটি পশ্চিমবাংলায় ব্যাপক প্রচলিত ও জনপ্রিয় হলেও বাংলাদেশে প্রচলন কম। তবে ব্রিটিশ পিরিয়ডে কিংবা ষাট-সত্তরের দশকেও পুরান ঢাকায় ব্যাপকভাবে কচুরীর প্রচলন ছিল। অমূল্যবাবু জন্মসূত্রে শাঁখারীবাজারেরই মানুষ। তাই প্রতিষ্ঠার সময়ে প্রচলন করা কচুরী আজও তারা নিয়মিত বানান রকমারি মসলা সহযোগে। চাহিদাও রয়েছে বেশ।
পূজার এই মরসুমে দূর-দূরান্ত থেকেও অনেকে এসেছেন তাদের মিষ্টি খেতে। মিরপুর থেকে ছয়জন বন্ধুকে নিয়ে এদিকে ঘুরতে ও পূজা দেখতে এসেছেন অচিন্ত্য রায়। তিনি বললেন, “আমি মিরপুর থাকি। এখানে এসেছি প্রথমবারের মত। পূজার বিভিন্ন প্যান্ডেল দেখতে ও বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘুরতে এদিকে আসা। তারপর এখানে আসলাম। দোকানটাকে এদিকে সবাই একনামে চেনে। আমরাও নাম শুনেছিলাম। সবাই একটা করে ঘি লাড্ডু, আমৃত্তি ও কচুরী নিয়েছি। ভালো লেগেছে। মিষ্টিতে ফ্রেশনেস আছে।''
তিন পুরুষ ধরে চলা এই দোকানটি এখনো তার মান ধরে রাখার বিষয়ে সচেতন। তাদের আছে পণ্য সম্পর্কে ক্রেতাকে সত্য জানানোর মানসিকতা। একারণে, অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে এসেও স্থানীয় মানুষদের কাছে এখনো প্রধান পছন্দ অমূল্য মিষ্টান্ন ভান্ডার। যাদের মিষ্টি ছাড়া অনেকের পূজা পরিপূর্ণতা পায়না।
মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী।