তার বয়স যত, তার চেয়ে বেশি জিতেছেন শিরোপা। লিওনেল মেসির প্রাপ্তির গল্পের পাতার পরিধি এমনই বিস্তৃত। ৩৫ বছরে পা রাখার আগে তিনি ক্লাব ফুটবল, জাতীয় দলে মিলিয়ে চুমু একেঁছেন ৪১টি ট্রফিতে। এর মধ্যে আছে বার্সেলোনা ও পিএসজি মিলিয়ে ১১টি লিগ শিরোপা। আছে চারটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের তৃপ্তিও। এ পর্যন্ত সাতবার হয়েছেন বর্ষসেরা। আরও কত কী! তবুও তিনি ‘অমর’ নন। অনেকের দৃষ্টিতে হয়ত সময়ের সেরা, কিন্তু অমর নন কোনোভাবেই! এর জন্য চাই একটি বিশ্বকাপ।
তার দেশ বৈশ্বিক ফুটবলের পরাশক্তিদের মধ্যে একটি। দুটি বিশ্বকাপ ট্রফি আলো ছড়াচ্ছে তাদের অর্জনের শোকেসে। কিন্তু আর্জেন্টিনার তো দুটি বিশ্বকাপ জয়ের গল্পে তৃপ্ত থাকার, থেমে যাবার সুযোগ নেই মোটেও। তাছাড়া বৈশ্বিক ফুটবলের সর্বোচ্চ আসরে তাদের সেরা হওয়ার গল্পতেও জমেছে ৩৬ বছরের ধুলো।
এই পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে আর্জেন্টিনা ও মেসি উভয়ই বিশ্বকাপের জন্য ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত। কাতার বিশ্বকাপে সে ক্ষুধা মিটবে কিনা, সে তৃষ্ণা নিবারণ হবে কিনা, এর উত্তর আপাতত সময়ের হাতে তোলা থাকছে। যার শুরু মঙ্গলবার, লুসাইল স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৬টায় সৌদি আরবের বিপক্ষের ম্যাচ দিয়ে।
এরই মধ্যে কাতারের রাজধানী দোহায় বিশ্বকাপের ২২তম আসরের দামামা বেজেছে অনেক তর্ক-বিতর্কের স্রোত পেরিয়ে। ‘সি’ গ্রুপে আর্জেন্টিনার সঙ্গী সৌদি আরব, মেক্সিকো ও পোল্যান্ড। ১৯৮৬ বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়নরা গ্রুপ পর্বে মোটামুটি পাচ্ছে মসৃণ পথ।
কিন্তু এই সহজ পথে যাত্রা শুরুর আগের ক’দিনের অনুশীলনে আর্জেন্টিনা কোচ লিওলেন স্কলোনির কেন এত রাখঢাক, মেসিরই বা কেন এত লুকোচুরি খেলা?
মেসি অবশ্য নিজেই সৌদি আরব ম্যাচের আগের দিন জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে জানালেন থাকার না কারণ। ফ্রেঞ্চ লিগে খেলার সময় চোট পেয়েছিলেন অ্যাকিলিস টেন্ডনে। শঙ্কার মেঘ জমানো ওই চোটের কারণে প্রস্তুতির সময় গণমাধ্যমের দৃষ্টি থেকে দূরে থাকার ব্যাখ্যা দিলেন। এখন শারীরিক ও মানসিকভাবে খুব ভালো অনুভব করছি বলে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠায় থাকা সমর্থকদের আশ্বস্ত করলেন। প্রত্যাশার পালে দিলেন নতুন হাওয়া।
সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানের পাতায় ভালো আছে আর্জেন্টিনা; আকাশী-নীল জার্সিধারীদের হয়ে আলো ঝলমলে মেসিও। দলের সর্বোচ্চ গোলদাতা তিনি। সবশেষ পাঁচ ম্যাচে করেছেন ১১ গোল। আর্জেন্টিনার পালেও বইছে সুবাতাস। স্কালোনি নামের এক ‘অখ্যাত’ কোচের হাত ধরে টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত আলবিসেলেস্তারা। বিশ্বকাপের আঙিনায় তাদের চলমান খরাও কাকতালয়ীয়ভাবে ৩৬ বছরের! খরা কাটানোর তো এটাই মোক্ষম সুযোগ আর্জেন্টিনার।
মাঝে যে সুযোগ একেবারে দরজায় কড়া নাড়েনি, তা নয়। সবশেষ সুযোগ পেয়েছিল ২০১৪ সালে, ব্রাজিল বিশ্বকাপে। কিন্তু মারিও গোটসের গোলে জার্মানির কাছে হেরে ভেঙেছিল স্বপ্ন। খরা যতই দীর্ঘ হোক, আর্জেন্টিনার জন্য তা কাটানোর সময় সামনে পড়ে আছে ঢের, মেসির সে সময় কোথায়?
শৈশবে রোসারিওর বাড়ির আঙিনায়, অলিতে-গলিতে বল পায়ে আলো ছড়াতে-ছড়াতে, বার্সেলোনার লা মেসাইয়ার সুবজে শৈল্পিক ফুটবলের ছবি আঁকতে-আঁকতে, ক্লাব ফুটবলের সিনিয়র পর্যায়ে সব শিরোপা স্বাদ নিতে-নিতে যে কেটে গেল ৩৫ বছর! একটু একটু করে যে তিনিও এখন পথের শেষে এসে পৌঁছেছেন। শুনতে পাচ্ছেন বিদায়ের রাগিনী।
মেসি অবশ্য সম্ভাবনা-শঙ্কার দোলাচলের মধ্যেও বরাবরের মতো স্থির। সৌদি আরবের বিপক্ষে ম্যাচ সামনে রেখে সংবাদ সম্মেলনে এটাই শেষ বিশ্বকাপ কিনা, এমন প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছেন ঝানু কুটনীতিকের মতো। ‘সম্ভবত শেষ’ বলে ঝুলিয়ে রেখেছেন ভবিষ্যতের জন্য, সেখানে নিরাশার উপস্থিতি যেমন, আশার সুরও আছেও তেমনি। ঠারেঠুরে ঠিকই বুঝিয়ে দিয়েছেন এতসব দোটানা নিয়েই প্রস্তুত তিনি। শিকারের আগে ক্ষুধার্ত সিংহ যেমন প্রস্তুত, শান্ত থাকে, ঠিক তেমন! হয়তো নিজেকে প্রমাণের প্রত্যয়ও আছে সেখানে।
অনেকে বলেন-শ্রেষ্ঠত্বের প্রশ্ন মেসির প্রমাণের কিছু নেই। কিন্তু তিনি তো শৈশবের সেই কঠিন জীবন থেকে জানেন অমরত্মের মুকুট কেবল সর্বজয়ীদের। ১৬৫ ম্যাচে ৯১ গোল করে আর্জেন্টিনার সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় শীর্ষে থাকা, একটি মাত্র কোপা আমেরিকা ট্রফি জেতা যথেষ্ঠ নয়। ১৯৭৮ সালের দানিয়েল পাসারেলা, ১৯৮৬ সালের দিয়েগো মারাদোনার মতো বিশ্বকাপ জিতলে কেবল সর্বজয়ী হবেন তিনি।