Loading...
The Financial Express

অনুপম ঘটক: যার হাত দিয়ে বাংলা গানে এসেছিলো ডিমিনিশিং কর্ড 

| Updated: December 13, 2022 18:44:37


অনুপম ঘটক (১৯১১-১৯৫৬), ফিচার ইমেজ: বেঙ্গল মিউজিশিয়ানস অনুপম ঘটক (১৯১১-১৯৫৬), ফিচার ইমেজ: বেঙ্গল মিউজিশিয়ানস

১৯৫৪ সাল। আজ থেকে আটষট্টি বছর আগের এক দিনে কথা চলছে দুজন ভবিষ্যত  মহারথির ভেতর। একজন চলচ্চিত্র পরিচালক বিভূতি লাহা (১৯১৫-১৯৮৯), অন্যজন সঙ্গীতজ্ঞ অনুপম ঘটক (১৯১১-১৯৫৬)। উপলক্ষ্য নির্মিতব্য সিনেমার একটি গান। গানটি লিখে দিয়েছেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। অনুপম ঘটক তাতে সুর বসিয়েছেন। কিন্তু বিভূতি লাহা মোটেই খুশি হতে পারছেন না। এ ধনের সুর পাশ্চাত্যের ক্লাসিকাল বা অপেরায় শোনা যায়, কিন্তু বাংলা গানে, বিশেষ করে বাংলা সিনেমায় কেমন হবে তা তিনি নিশ্চিত নন। 

গানটি 'গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু।' গাইবেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। লিপ দেবেন সুচিত্রা সেন। বিপরীতে নায়ক উত্তম কুমার। এর আগে এই দুজন একবারই জুটি হয়েছেন নির্মল দে-র সাড়ে চুয়াত্তর (১৯৫২) সিনেমায়। বিভূতি লাহা তখন সন্দিহান, কারণ কেবল জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকা একটি জুটির জন্য গান বেশ বড় ফ্যাক্টর। আবার, সিনেমার কাহিনী আশাপূর্ণা দেবীর গল্প থেকে নেয়া, গভীরতাসম্পন্ন  কাহিনী। 

অনুপম একদিন সময় চাইলেন। তিনি ততদিনে নবীন কোনো সুরকার নন। এর আগে কোলকাতা, বোম্বে, লাহোরে বড় বড় কাজ করেছেন। নিজে চমৎকার ভক্তিগীতি গান। ভজন-কীর্তনে তার সুর প্রসিদ্ধ। আগমনী কিংবা শ্যামাসংগীতেও তিনি কম নন। 

তৎকালীন ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল মহকুমার পাথরাইল গ্রামের সন্তান ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে গান শিখেছেন। গানকে প্রথম ভালোবেসেছেন মাঝিদের ভাটিয়ালি গান শুনে। হীরেন বসুর মতো 'প্রডিজি' র হাত ধরে তার সঙ্গীতজগতে আসা। মাত্র ১৯ বছর বয়সে ১৯৩০ সালে প্রথম রেকর্ড বেরোয়। ১৯৩২ সালে প্রতিষ্ঠিত 'হিন্দুস্থান রেকর্ডস'-এ প্রথম রেকর্ডটি ছিলো স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। দ্বিতীয় ও তৃতীয়টি অতুলপ্রসাদ সেন ও রেণুকা দাসগুপ্তের। মাত্র ২১ বছর বয়সের অনুপম করলেন তাদের চতুর্থ রেকর্ড। তারাপদ রাহার কথায়- 'আজি সখি ঝর ঝর'। 

বাংলা সিনেমাতে অগ্নিপরীক্ষা (১৯৫৪) যে তার প্রথম কাজ- এমনটি নয়। ১৯৩৫ সালে পায়ের ধুলো সিনেমায় সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন। ১৯৩৭-৩৯ এ বোম্বেতে (বর্তমান মুম্বাই) কাজ করলেন উসকি তামান্না, সাধনা, লেডিস অনলি-র মতো ছবিতে। বাবার অসুস্থতার কারণে আবারো কোলকাতা ফেরেন। উত্তমপূর্ব বাংলা সিনেমার প্রধান নায়ক, প্রযোজক ও পরিচালক প্রমথেশ বড়ুয়া তাকে শাপমুক্তি সিনেমার সঙ্গীতের দায়িত্ব দেন। অজয় ভট্টাচার্যের কথায়- 'বাঙালি বধূ বুকে তার ', 'একটি পয়সা দাও গো বাবু' গানগুলো জনপ্রিয় হয়।  এরপর কর্ণাজুন, মায়ের প্রাণ, পাষাণ দেবতা সিনেমাগুলোর গানে সুরারোপ করেন। ১৯৪৪-৪৬ এ তিনি আবার গেলেন লাহোরে। কাজ করলেন শালিমার, আয়া বাহার, বদনামি, চম্পা, খুশনসিব, অ্যায়সা কিউ ও ফয়সালা ছবিতে৷ ভারতের বিশিষ্ট সুরকার নওশাদ তার সহকারী ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আই ওয়াজ দ্য অ্যাসিস্ট্যান্ট অভ এ মিউজিকাল জিনিয়াস নেমড অনুপম ঘটক অ্যাট লাহোর। 

১৯৪৬ এর দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে অনুপম আবারো কোলকাতায় ফেরেন। হীরেন বসু তাকে প্রস্তাব করলেন শ্রী তুলসীদাস (১৯৫০) সিনেমার গানে সুর করতে। ৩৩ টি দোঁহা ও গান মিলিয়ে রাজকীয় আয়োজন!  লিখিনু যে লিপিখানি কিংবা আমি তনু চন্দনবাটি। প্রথম গানটি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে অন্যরকম জনপ্রিয়তা দিলো। 

তবে সে সময়ে এত বড় ও অসামান্য কাজ করার পরও তার হাতে খুব একটা কাজ ছিলো না। বিভূতি লাহা তার কাজ বিষয়ে জানতেন। তাই তাকেই অগ্নিপরীক্ষা সিনেমার দায়িত্ব দেন। এই সিনেমায় নির্মাণের ধরনে তিনি নিয়ে আসেন হলিউডি ছাপ। 

পরদিন অনুপম ঘটক আবারো এলেন। বিভূতি লাহাকে খুব স্থির ও দৃঢ়ভাবে বললেন তিনি সুরটা বদলাবেন না। সোজাসুজি বললেন, ''বিভূতি বাবু, আপনাদের অগ্রদূতের হাতে আরো কয়েকটি সিনেমা আছে, আমার জন্য এটাই অগ্নিপরীক্ষা, এই কাজটি ব্যর্থ হলে বাংলা ছবিকে আমার বিদায় জানাতে হবে। '' 

তিনি বেশ প্রত্যয় নিয়েই বলেছিলেন, " ছবিতে গানটা যে পরিস্থিতিতে, সেখানে কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশে নায়ক-নায়িকা বসে আছেন৷ তারা একে অপরের সঙ্গে তেমন পরিচিত নন। তাদের মনের কুয়াশা তখনো কাটেনি। এই পরিস্থিতিতে এর চেয়ে ভালো কোন সুর হতে পারে আমার জানা নেই।" 

বিভূতি লাহা সম্মতি দেন। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত হয় গানটির পর। উপরের এই ঘটনা তার মুখে ও শিল্পী অরুণ দত্তের লেখাতেও বিভিন্ন সময় এসেছে। 

পরিবারের সদস্যদের সাথে ঘরোয়া পরিবেশে অনুপম ঘটক (খালি গায়ে, পৈতাধারি অবস্থায়), বামে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও ডানে আলপনা বন্দ্যেপাধ্যায়, ছবি: বাংলা লাইভ 

অরুণ দত্ত তার এক লেখায় লিখেছেন-

" সেই ১১/বি, কাঁকুলিয়া রোডের বাড়িতে পৌঁছে ঘরে ঢুকতেই দেখি, এক বিশাল চেহারার মানুষ আদুল গায়ে, ধুতিপরিহিত― চেয়ারে উপবিষ্ট। ফরসা রঙের সঙ্গে গায়ের ওপর বেছানো পৈতেতে যেন চোখজুড়োনো দৃশ্য। প্রথম দর্শনেই ভক্তি আসে। যাইহোক, গিয়ে বসতেই শুনি, তাঁর সামনে বসা এক বয়স্ক ছাত্রীকে উনি বলছেন― ‘তুমি যে এতদিন গানের চর্চা করছ, কোনোদিন রেওয়াজ বা গান গাইবার সময় তোমার মনে কি কোনও শিহরণ এসেছে?’ ছাত্রীটি বলল― ‘না তো!’ উনি বললেন― ‘এই শিহরণ আসে কাব‍্য ও সুরের সমন্বয়ে তৈরি গানের অনুভব ও উপলব্ধি থেকে। গভীর বোধ থেকে যখনই সেই অনুভূতির স্তরে পৌঁছবে, দেখবে তোমার মনে একটা শিহরণ জেগেছে।’ কথাগুলো শুনে আশ্চর্য হয়ে গেলাম! ধীরে ধীরে চোখ তুলে ওঁর মুখের দিকে তাকাতেই দেখি, উনি বসে আছেন স্থির হয়ে আর ওনার দৃষ্টি দূরে কোথাও হারিয়ে গেছে।”

এমনই সাধনার জায়গা থেকে গানকে দেখতেন অনুপম ঘটক। এই সিনেমার অবিস্মরণীয় সাফল্যের পর অগ্রদূত তাদের পরবর্তী ছবিগুলোতেও তাকে নিযুক্ত করছিলেন। এ সময়ে আবারো বাংলা চলচ্চিত্রে তার কাজের পসার ঘটতে থাকে৷ এ সময়ে তার প্রধান সহকারী ছিলেন আরেক গুণি সঙ্গীত পরিচালক রবীন চট্টোপাধ্যায় (১৯১৮-৭৬)। 

সে সময়ের উদীয়মান ও পরে কিংবদন্তী সঙ্গীতজ্ঞ নচিকেতা ঘোষ (১৯২৫-৭৬) ও সলিল চৌধুরী (১৯২৩-৯৫) তার গুণমুগ্ধ ছিলেন। 

নচিকেতা ঘোষ তখন ডাক্তারি চর্চা ছেড়ে সঙ্গীতকেই করেছেন ধ্যান-জ্ঞ্যান। তিনি প্রায়ই অনুপম ঘটকের বাড়িতে আসতেন। কীভাবে 'গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু' গানে তিনি ডিমিনিশিং কর্ড প্রয়োগ করলেন, 'কে তুমি আমারে ডাকো' গানে কীভাবে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের রাগের সাথে পাশ্চাত্যের ক্লাসিকালের সংমিশ্রণ ঘটালেন, ফুলের কানে ভ্রমর আনে, জীবননদীর জোয়ারভাটায়- গানগুলোর পরতে পরতে এত বৈচিত্র‍্য কীভাবে এলো তা নিয়ে দিনের পর দিন তার সাথে কথা বলতেন। রসলিল চৌধুরী বলেছিলেন, " অনুপম দা নিশ্চয়ই আগের জন্মে পিয়ানো টিউনার ছিলেন, নইলে এমন অসামান্য সৃষ্টি করলেন কী করে!" 

অনুপম ঘটক শিল্পীদের গান দিতেন গলা বুঝে। তবে হেমন্তের  সাথে তিনি আনুপাতিকভাবে বেশি কাজ করেছেন। হেমন্তের জন্য করা 'প্রিয়ার প্রেমের লিপিখানি' ছিলো পাঞ্জাবি 'হির' ঘরানার গানের সুরে৷ এ ধাঁচে রবীন্দ্রগান থাকলেও সচেতনভানে 'হির' বাংলা গানে নিয়ে আসেন তিনি। এছাড়া হেমন্তের জন্য 'আকাশ মাটি ওই ঘুমোলো, শুকনো শাখার পাতা ঝরে যায় সহ আরো কিছু গান সুর করেন। 

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গীত গুরু ছিলেন তিনি। তার কণ্ঠের প্রতি অনুপম বাবুর ছিলো আলাদা মুগ্ধতা। গায়ের রংয়ের কারণে সন্ধ্যার বিয়ে নিয়ে অনিশ্চিত থাকা পরিবারকে অভয় দিয়েছিলেন। বলেছিলেন এত সুন্দর কণ্ঠের মেয়ের গায়ের রং কোনো ব্যাপার নয়। ও নিয়ে ভাবতে হবে না। 

বেসিক গ্রামোফোন রেকর্ডে 'গানে তোমায় আজ ভোলাবো (সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়), কাঙালের অশ্রুতে যে (সাবিত্রী ঘোষ), সারারাত জ্বলে সন্ধ্যাপ্রদীপ (শচীন গুপ্ত) ও 'এই তুমি আমি ' (মাধুরী চট্টোপাধ্যায়), 'চৈতি গোধূলি যায় ফিরে যায়'  (অখিলবন্ধু ঘোষ), 'এই হাসি এই বাঁশি'(কৃষ্ণা বন্দ্যেপাধ্যায়), 'পাখি বলে কারে দেবো (তরুণ বন্দ্যেপাধ্যায়), 'চম্পাবনে চৈতি হাওয়া' (হৈমন্তী শুক্লা) ও 'পায়ে চলা পথ' (অরুণ দত্ত) প্রভৃতি গান আছে। 

এভাবে যখন সুরে সুরে করে চলছিলেন অসামান্য সব কাজ, তখন হঠৎ শরীর খারাপ হলো। হীরেন বসুর সিনেমা একতারা-র কাজ শেষ করলেন। ১০ এরও অধিক শিল্পী, যার ভেতর কৃষ্ণচন্দ্র দে-র মতো কিংবদন্তিও ছিলেন। কিন্তু গানগুলোর  কাজ শেষ করার পর জানলেন তার শরীরে বাসা বেঁধেছে মারণঘাতী ব্লাড ক্যান্সার। আর মাত্র কয়েকমাস! 

সে বছরটিও পেরোয়নি। ১৯৫৬ সালের আজকের দিনে (১২ ডিসেম্বর) দেহ রাখলেন অসামান্য সুরকার অনুপম ঘটক। দীর্ঘদেহী সুঠাম দেহটি তখন অনেকটাই অস্থিচর্মসার।  গীতিকার শ্যামল গুপ্তের সাথে কন্যাসম সন্ধ্যার বিয়েও দেখে যেতে পারেননি। 

তবে তার হাত ধরে বাংলা গানে প্রবর্তিত ডিমেনশন কর্ড তার মৃত্যুতে মরে যায়নি। পরবর্তীতে নচিকেতা ঘোষ, সলিল চৌধুরী, সুধীন দাশগুপ্তদের মতো সঙ্গীতজ্ঞদের হাত দিয়ে আরো বহু গানে এই কর্ডের প্রয়োগ ঘটেছে৷ 

অনুপম ঘটক বিশ্বাস করতেন সঙ্গীত হলো আত্মিক সংযোগের ব্যাপার। এ নিয়ে নিজেরই এক লেখায় তার মত ছিলো, ‘অন্তর জানতে পারে সংগীত আন্তরিক হলো কিনা? আন্তরিক সংগীতে আত্মসমর্পণের বীজ থাকে। এই বীজ হতে সৃষ্টি হয় তিনটি বিশিষ্ট ধারা। প্রথম হৃদয় থেকে উঠে সে হয় ঊর্ধ্বমুখী― যায় সে আত্মার অন্বেষণে, দ্বিতীয় ধারা সুন্দর পৃথিবীকে সুন্দরতর করে, তৃতীয় ধারা― হৃদয় থেকে উঠে আবার হৃদয়ে ফিরে আসে।”

মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে চতুর্থ বর্ষে অধ্যয়নরত। 

[email protected] 

 

Share if you like

Filter By Topic