লন্ডন তথা সমগ্র ইউরোপে আরব সাহিত্যকে পরিচিত করে তোলার জন্য গত ৪৪ বছর ধরে এক অনন্য নজির স্থাপন করে এসেছে ‘আল সাকি বুকস’ নামে একটি বুকশপ। গত ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ সালের পর্দা নামার সাথে সাথে এই বুকশপটিও চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়।
যুদ্ধবিদ্ধস্ত লেবাননের রাজধানী বৈরুত থেকে আগত আন্দ্রে ও সালওয়া গ্যাসপার্ড দম্পতি এবং তাদের বন্ধু মেই ঘৌসব - এই তিনজন মিলে ১৯৭৮ সালে লন্ডনের বেইসওয়াটারে ছোট্ট একটি বুকশপ চালু করেন। এই বুকশপের নাম ‘সাকি’ এবং সুন্দর লোগোটি তারা জাওয়াদ সেলিম নামের এক ইরাকি চিত্রশিল্পীর চিত্রকর্ম (ওয়াটার সেলার) থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নির্বাচন করেছিলেন।
লন্ডনে বসবাস শুরু করার পর তারা সে দেশে আরবীয় সংস্কৃতির অনুপস্থিতি অনুভব করেন এবং এই চিন্তা চেতনা থেকেই আরব সাহিত্য সমৃদ্ধ একটি বইয়ের দোকান চালু করার সিদ্ধান্ত নেন। শুরুতে তারা নিজ দেশ লেবানন ও ইউরোপের নানা প্রকাশনী সংস্থা থেকে বই সংগ্রহ করতেন।
ধীরে ধীরে তা জনপ্রিয় হয়ে উঠে, যদিও গত ৪৪ বছরে নানা চড়াই উৎরাই এর মধ্য দিয়ে পথ চলতে হয়েছে। ৮০ এর দশকে এসে আরবদের জ্ঞান পিপাসা নিবারণের এক অন্যতম স্থান হয়ে উঠেছিল এই বুকশপটি। প্রথমদিকে সেখানে কেবলমাত্র আরবি ভাষায় লেখা বইগুলোই লভ্য ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে পশ্চিমাদের আগ্রহের কারণে সেই বইগুলো ইংরেজীতে অনুবাদের ব্যবস্থা করা হয়। ফলে সেখানে একই বই আরবি ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই পাওয়া যেত। আরবের অনেক বইপ্রেমীই লন্ডনে আসতেন তাদের পছন্দের বইগুলো কিনতে যেগুলো তাদের দেশে লভ্যতার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা ছিল।
দোকানটির অন্যতম বিক্রয় প্রতিনিধি, বদর আল মোদাইরস (২৮ বছর বয়সী এই যুবক গত দুই বছর যাবত এই বুকশপের সাথে জড়িত) এক সাক্ষাৎকারে বলেন, আরব পর্যটকদের কাছে এই বুকশপটি ছিল অনেকটা ‘মাস্ট-সি প্লেসে’র মতো। কুয়েতের ৬০ বছর বয়সী একজন লেখক প্রতি বছর চারবার করে এই বুকশপে আসতেন।
সাধারণ মানুষ, পর্যটকসহ আকালা, ব্রায়ান এনো, ড্যামোন অ্যালবার্ন, ক্রিস মার্টিনের মতো বিভিন্ন সেলিব্রেটিদের আনাগোনা ছিল এই বুকশপে।
মূলত আর্থিক সংকটের কারণেই বন্ধ হয়ে গেল এমন একটি বইবিতান। এই দীর্ঘ ৪৪ বছরে জনপ্রিয়তার পাশাপাশি নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল এই বুকশপটি। একসময় সেন্সরশিপ ইস্যু ছিল। ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধ চলাকালীন সালমান রুশদির অ্যাফেয়ারের সময় হামলার কারণে এই দোকানের জানালা একদম ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়। ২০০৬ সালে লেবানন যুদ্ধের সময় আবারো ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই বুকশপটি। সবশেষ ২০২১ সালে এক বন্যায় বেজমেন্ট পুরোটা বন্যার পানিতে ভেসে যায় এবং শত শত বই নষ্ট হয়ে যায়।
এছাড়াও করোনা ভাইরাসের প্রভাব, শিপিং খরচ বেড়ে যাওয়া, বইয়ের মূল্য বৃদ্ধি, অতিরিক্ত ট্যাক্স-এ সবকিছুরই মারাত্মক প্রভাব পড়েছিল এই বুকশপের উপর। যার ফলে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে নিয়ে যাওয়া আর সম্ভবপর হয়ে উঠছিল না।
এক সাক্ষাৎকারে সালওয়া গ্যাসপার্ড বলেন, আমার নিজের সন্তানের চেয়ে অধিক যত্ন ও দীর্ঘ সময় ধরে এই বুকশপের পেছনে আমার সবটা উজার করে দিয়েছি। আমার স্বামীও একজন সহ-প্রতিষ্ঠাতা। তারও মনে হচ্ছে যে তিনি তার এক সন্তানকে হারাতে চলেছেন।”
“মানুষ এখন আর বই পড়তে চায় না, বরং এর পরিবর্তে তারা ট্যাবলেট ও ল্যাপটপে তাদের সময় ব্যয় করতেই অধিক পছন্দ করে। মানুষের এটি খুবই দুঃখজনক একটি প্রবণতা।” চিরতরে বন্ধ হতে চলা এই বুকশপের ক্যাশ কাউন্টারের পাশে দাঁড়িয়ে অনেকটা দুঃখবোধ নিয়ে এক প্রৌঢ় ব্যক্তি আপনমনে এই কথাগুলো বলছিলেন।
তবে আল সাকি বুকশপ বন্ধ হয়ে গেলেও ১৯৮৩ ও ১৯৯১ সালে শাখা প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত সাকি বুকস ও দার আল সাকি নামের দুইটি স্বতন্ত্র প্রকাশনা সংস্থা এই বুকশপের কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাবে।
শবনম জাবীন জেবা ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক থেকে ফার্মেসি বিষয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন।