Loading...
The Financial Express

হুমায়ূনের মায়াকানন: কেন এতো জনপ্রিয়তা হুমায়ূনের?

| Updated: November 13, 2022 21:12:45


হুমায়ূনের মায়াকানন: কেন এতো জনপ্রিয়তা হুমায়ূনের?

কথার জাদুকর হুমায়ূনের মুগ্ধ পাঠক যেহেতু কৈশোর-তারুণ্যের সীমা থেকেই শেষ বয়সে নিয়ে চলেছেন প্রবীণ প্রজন্ম, তাই একটি বাস্তব ঘটনার সাথেই শুরুটা করা যাক।

 সদ্য ষোড়শী এক পাঠিকা জীবনের প্রথম হুমায়ূন নিয়ে বসেছিল, কিছুটা যেন হেলা নিয়েই। দিনখানেক পর ঘরে ঢুকতেই দরজা খুলে দিতে আসা কিশোরীর চোখ দেখি ছলছল করছে। অভিমানী গলায় সাথে সাথে প্রশ্ন ছুড়ে দিল, “হাসান ভাই কি আসলেই মারা যাচ্ছে? আমি শেষ পর্যন্ত পড়তে সাহস পাচ্ছি না!” হাতের বইটার মোড়কে ‘মেঘ বলেছে যাব যাব’ লেখা।

এমনই মায়াবী নামের প্রায় শ তিনেক বই লিখে ফেলেছেন কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। কোনো এক তের নভেম্বর জন্মেছিলেন তিনি, চান্নিপসর রাতের অপেক্ষায় চলেও গিয়েছেন পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে। পেছনে রেখে গেছেন অগণিত মুগ্ধ মনন, তৃষিত পাঠক।

বাংলাদেশের পাঠকের মনে হুমায়ূন বই পড়ার প্রতি আগ্রহ ফিরিয়ে এনেছিলেন, কথাসাহিত্যকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন, তার এই বিপুল জনপ্রিয়তাকে বাড়িয়ে বলারও আর প্রয়োজন পড়ে না। মানবজীবনের সবচেয়ে সাধারণ ব্যপারগুলোকে তিনি অসাধারণের কাতারে নিয়ে যেতে পড়েছেন শুধুমাত্র কথা দিয়ে। তার লেখা পড়লে মনে হবে না কোনো উপন্যাস বানান করে পড়তে হচ্ছে, মনে হবে কানের পাশে কেউ অনর্গল গল্প বলে চলছে। হুমায়ূন আহমেদ মুখের ভাষা ও লেখার ভাষার মধ্যকার দূরত্বকে কমিয়ে এনেছেন, লেখাকে করেছেন সুখকর এক আলাপের মতো।

হুমায়ূনের গল্পের চরিত্রগুলো পাঠকের খুব কাছের মানুষজন, সাদামাটা, নিয়মিত দিনের মানুষ - যাদের কল্পনা করে নিতে বেগ পেতে হয় না কোনোদিনও। পাঠক তার চরিত্রগুলোকে নিজেদের জীবনযাপনের অংশে সামিল করে নিতে পেরেছে এতটাই গাঢ়ভাবে, চরিত্রের পরিণতি পাঠককে কল্পিত সাহিত্যের বাইরে নিয়ে এসেছে বাস্তবতার কাতারে। ‘এইসব দিনরাত্রি’র টুনির মৃত্যুতে ক্ষুব্ধ দর্শক যেমন নাট্যকার হুমায়ূনের কুশপুত্তলিতা দাহ করে প্রতিবাদ করেছে, ‘কোথাও কেউ নেই’ - এর বাকের ভাইয়ের ফাঁসি থামানোর দাবিতে মিছিল থেকে শুরু করে দেয়াললিখন, বাদ যায়নি কোনোটাই।

হুমায়ূনের চরিত্রগুলো সমাজের প্রতিটি পর্যায়ে বিস্তৃত, তাদের সমস্যাগুলোও তাই। মধ্যবিত্তের মাসের শেষের ফাঁকা টাকার পুটলি থেকে শুরু করে নায়িকার হঠাৎ বিয়ে হয়ে যাওয়া, শোকাতুর বেকার নায়কের মুখ ঘুরিয়ে এক অনিশ্চিতে জীবন কাটানোর বিষণ্ণ বিদায়, পরিবারের সবচেয়ে আদুরে সদস্যের মৃত্যুতে ভেঙ্গে যাওয়া পরিবার, কোনো এক হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনের জন্য চিরদিনের অপেক্ষায় গেটের দিকে চেয়ে থাকা - হুমায়ূনের গল্পগুলো যেন পাঠকের খুব চেনা কারো ক্লান্ত জীবনের গল্প।

হুমায়ুন তার গল্প বলার ভঙ্গিতে এক নতুনত্ব এনেছিলেন। তিনি গল্প বলার কৌশল জানতেন। তিনি এ-ও জানতেন যে পাঠককে কোথায় থামিয়ে দিতে হয় এবং উৎকণ্ঠায় রেখে কত বিচিত্রভাবে তাদের কৌতূহল বাড়ানো যায়। উপন্যাসের গল্পটিতে তিনি ব্যাখ্যা দেননি, তিনি কেবল ঘটনার নির্মোহ বর্ণনা দিয়েছেন।

ব্যাখ্যা করার এই দায়িত্ব বরং তিনি সর্বদাই দিয়ে রাখেন পাঠকের ওপর। একেই বলে ঘটনার সঙ্গে পাঠকের অন্তর্ভুক্তি। চরিত্রদের দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি ঘটনার বর্ণনা করেছেন, বইয়ের শেষ পাতায় পৌঁছেও পাঠক সুখনিদ্রায় যেতে পারে না। এক ঘোরগ্রস্থতা ভর করে, কিভাবে শেষ হয়ে যায় এতদিনের গল্প - তার মোহ কাটাতে পাঠকের বেগ পেতে হয়। উপন্যাসের শেষে তিনি পাঠকের হাতে তৃপ্তিদায়ক সমাপ্তি ধরিয়ে দিতে আগ্রহী ছিলেন না, পাঠককেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক অলিখিত গুরুদায়িত্ব ধরিয়ে দিতেন।

হুমায়ূন আহমেদ মানুষের চরিত্রের এই খারাপ অংশের অনেকটা বাদ দিয়ে উপস্থাপন করার পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি দেখিয়েছেন প্রত্যেক খারাপ মানুষের মধ্যে একজন ভালো মানুষ থাকে। তারপরও মন্দ বৈশিষ্ট্যের যেটুকু তিনি ধরে রাখেন, তার প্রায় সবটুকু ছাপিয়ে শেষ পর্যন্ত এর মানবিক গুণাবলিই প্রধান হয়ে ওঠে। হুমায়ূন কোনো মহৎ চরিত্রে ইচ্ছা করে হীনতা যেমন আরোপ করেননি, তেমনি কোনো হীন চরিত্রের গায়েও অকারণ মহত্ত্বের আলগা প্রলেপ যুক্ত করতে যাননি।

ইতিহাসনির্ভর লেখনীগুলোতেও তার ব্যতিক্রমী বর্ণনা পাঠককে চোখ সরাতে দেয় না। তিনি আলো ফেলেন ইতিহাসের কিছু এমন অংশে, লোকচক্ষুর আড়ালে যার বর্ণনা ঐতিহাসিক উপন্যাসে ঐতিহাসিক ঘটনার পাশে সমান্তরাল আরেকটি মানবিক ধারার দেখা পায় পাঠক। ‘বাদশাহ নামদার’-এ সম্রাট হুমায়ূনের রাজ্য উদ্ধারের ঘটনার পাশে হরিশঙ্কর ও অম্বার মানবীয় আখ্যান মুখ্য হয়ে ওঠে। একইভাবে ‘মধ্যাহ্ন’তে দেশভাগের মতোই উজ্জ্বল হয় বারবনিতা চানবিবির মানবীয় গল্প এবং ‘মাতাল হাওয়া’তে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক উত্তালতার সঙ্গে যুক্ত হয় ফরিদ ও নাদিয়ার গল্প।

হুমায়ূন ভালোবাসাকে বর্ণনা করেছেন এক পরবাস্তব অলৌকিকতার সাথে, যেখানে যুক্তিকে তিনি ভুলে যাননি। ভালোবাসার প্রগাঢ়তাকেও তিনি বর্ণনা করেছেন বাস্তবতার পাল্লায়। বাঙালি পাঠকের মনে এঁকেছেন বিষন্ন সুন্দরের ছবি, ভালোবাসার বর্ণনায় তিনি পাঠককে তুলে দিয়েছেন নিজের মনের কথা বলার শব্দ। প্রেমিকযুগলের প্রেমের পরিণয় যেমন তিনি  লিখে গেছেন উচ্ছ্বল আনন্দের শব্দে, হৃদয়ভঙ্গের বেদনার দীর্ঘশ্বাস তেমনি শব্দ ছাপিয়ে অসহায় করে তুলেছে পাঠকের অনুভূতিকেও।

হুমায়ূনের জনপ্রিয়তা শুধু এই প্রজন্মে সীমাবদ্ধ থাকবে না, কারণ তার লেখা পাঠক শুধু সাহিত্য হিসেবে পড়েনি, পড়েছে সাহিত্যের মাঝে নিজেদের অনুভূতিগুলোকে উপলব্ধি করতে। তার হাতে বাংলা উপন্যাসের রচনায় কথাসাহিত্যের এমন ধারা তৈরি হয়েছে, যেখানে অনুভূতি বিষণ্ণ সুন্দর বৃষ্টির রাতে ভেজা ছাদে হেঁটে বেড়াবে, জোছনা সাদা রাতে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসেবে আকাশের মাঝে ঘর পেতে চাইবে। কথাকে একেকটি জীবন বানানো হুমায়ূন অম্লান থাকবেন বাংলা সাহিত্যের পাতায়।

Share if you like

Filter By Topic