হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর চাপ, কষ্টে শিশুরা


বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম | Published: October 11, 2022 08:53:19 | Updated: October 11, 2022 16:09:50


হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর চাপ, কষ্টে শিশুরা

ডেঙ্গু ওয়ার্ডের ফটকে পৌঁছার আগেই শিশুদের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছিল, ভেতরে যেতেই অভিভাবকদের চোখেমুখে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার ছাপ চোখে পড়ল।

সামনে এগোতেই আব্দুল সাহাল নামের এক শিশুকে কান্না করতে দেখা গেল। শারীরিক দুর্বলতার পাশাপাশি ব্যাথায় কাতরাচ্ছিল সে। শিশুটির বাবা মশিউর রহমান বললেন, “যেদিন সারাদেশে বিদ্যুৎ ছিল না, সেদিন গরম আর অন্ধকারে অনেক মশা কামড়েছে। এরপর থেকেই ডেঙ্গু। ৪ দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি আছি। দুশ্চিন্তায় কিছু ভাল লাগছে না।”

বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইন্সটিটিউটের দুইটি ওয়ার্ডে সাহালের সঙ্গে ডেঙ্গু আক্রান্ত আরও ৫৮ শিশু ভর্তি আছে। সেখানেই চিকিৎসা চলছে আগারগাঁওয়ের মুনতাহার। তৃতীয় শ্রেণির এ শিক্ষার্থী আর হাসপাতালে থাকতে চাইছে না; মাঝে মাঝে বমি করছে, প্ল্যাটিলেট নেমেছে ৫০ হাজারে।

পাঁচ দিন ধরে মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে থাকা বাবা আহমেদ আসিফ জিয়া বললেন, “মেয়ের অনেক কষ্ট হচ্ছে। পাশে নির্মাণাধীন ভবনের হাউজে পানি জমে ছিল, সেখানেই মশা জন্মে কামড়েছে। এখন এই অবস্থা। আগের বছর উত্তর সিটিকে মশা নিধনে যতটা মাঠে দেখা গেছে, এবার তা মনে হচ্ছে না।”

তিন দিন আগে কড়াইল থেকে আড়াই বছরের মেয়ে সুরাইয়া আক্তারকে নিয়ে এ হাসপাতালে এসেছেন গৃহবধূ রাইসা আক্তার। উদ্বেগ নিয়ে বললেন, “মেয়ের জ্বর ১০০ এর নিচে নামছেই না। কিছু খায় না। কান্নাকাটি করে। কী কষ্ট তা বুঝতেও পারি না।”

হাসপাতালের দুই নম্বর ওয়ার্ডে দায়িত্বরত নার্স রোকসানা খাতুন জানালেন, ডেঙ্গু নিয়ে এখানে যারা আসছেন, তারা শুরুতে আসছেন না।

“শুরুতে ডেঙ্গু হয়েছে কি না বুঝতে না পেরে, জ্বরের নানা চিকিৎসা নিতে থাকে। ফলে অবস্থা সিরিয়াস হয়ে যায়, এরপর তারা হাসপাতালে আসে। যে কারণে শারীরিক অবস্থা অনেক খারাপ থাকে। সুস্থ হতে বেশিরভাগ শিশুর ৫-৬ দিন থাকতে হচ্ছে। কারও কারও ১০ দিনও লেগে যাচ্ছে।”

বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইন্সটিটিউটের এপিডেমিওলজিস্ট ডা. এ বি এম মাহফুজ হাসান আল মামুন জানান, তাদের হাসপাতালে বর্তমানে ডেঙ্গু আক্রান্ত ৫৯ শিশু ভর্তি আছে, যাদের মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টাতেই ভর্তি হয়েছে ১৭ জন। আইসিইউতে আছে ৫ জন।

“পূর্বে যেখানে ৩০-৪০ জন রোগী ভর্তি থাকতো, সেখানে এখন ৫৫-৬০ জন ভর্তি থাকছে। বাড়তি রোগীর চাপ সামলাতে একটি ওয়ার্ড বাড়াতে হয়েছে।”

শুধু ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের পর্যবেক্ষণে আলাদাভাবে অতিরিক্ত চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগ করতে হয়েছে বলে জানান তিনি।

বর্তমানে ডেঙ্গু রোগীর চাপের কথা জানালেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চিকিৎসক হাসিবুর রহমানও। বললেন, “রোগী অনেক বেশি আসছে। আমাদের যে বেড আছে সেগুলো সব ভর্তি, খালি নেই। আমরা ফ্লোরে রোগী ভর্তি নিই না। ফলে অনেক রোগীকে ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে।”

মিরপুর দুই নম্বর থেকে ডেঙ্গু নিয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলে আসা শাওন মাহমুদ (৪৭) বলেন, “আমি আরও আগে সুস্থ হয়ে যেতাম। কিন্তু আগে থেকে শারীরিক অন্য জটিলতা থাকায় আমার পেট ব্যথা শুরু হয়। সেই থেকে ডায়রিয়া। শেষ পর্যন্ত আমাকে প্লাটিলেট নিতে হয়েছে।“

ঢাকার বাইরে থেকেও আসছে রোগী

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য বলছে, সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ঢাকার ৫০টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ছিল ১৮৩৪ জন; আর ঢাকার বাইরে এ সংখ্যা ছিল ৬০৫ জন ডেঙ্গু রোগী।

মাগুরা থেকে ডেঙ্গু নিয়ে ঢাকার বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইন্সটিটিউটে ৯ দিন ধরে চিকিৎসাধীন তামিম মোল্লা। ক্যানুলায় এক হাত ফুলে গেছে, সেই কারণে এখন ক্যানুলা দিতে হয়েছে আরেক হাতে। বাবা জাফর মোল্লা বললেন, “জ্বর ছিল, আগে বুঝতে পারি নাই, বাসায় ছিল। ডাক্তার দেখানোর পর বলল অবস্থা ভাল না, ঢাকায় নিতে। এখানে এসে ডেঙ্গু ধরা পড়ে। জ্বর ১০২ এর নিচে নামছে না। ইনজেকশন দিলে কিছুটা কমে। খুব চিন্তা হচ্ছে।”

একই হাসপাতালে ভর্তি নরসিংদী ও কুমিল্লা থেকে আসা দুই শিশুর অভিভাবকই জানান, ডেঙ্গু কীভাবে হয়েছে তা তারা বুঝতে পারছেন না। শুরুতে শুধু জ্বর আসে। ঢাকায় নিয়ে আসার পর ডেঙ্গু ধরা পড়ছে।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ইউনিট-৩ এর ৬৩৪ নম্বর ওয়ার্ডে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিচ্ছে মাদারীপুর থেকে আসা এসএসসি পরীক্ষার্থী সাব্বির হাওলাদার। তার বাবা কলিম হাওলাদার বলেন, “ছেলের অনেক খারাপ অবস্থা ছিল, এখন একটু ভাল। শুরুতে একটা প্রাইভেটে ডেঙ্গু ধরা পড়ে। সেখানে খরচ বেশি তাই এখানে নিয়ে এসেছি। কপাল ভালো একটা সিট পেয়েছি।”

সেখানকার সিনিয়র নার্স মোছা. নাছিমা খাতুন বললেন, “মাঝে আমাদের এখানে ডেঙ্গু রোগী আসার পরিমাণ একটু কম ছিল। এমনিতে ভর্তি রোগী তো আছেই। তার ওপর প্রতিদিন ৮-১০ জন নতুন রোগী আসছে। ওয়ার্ড পুরো ফিলাপ। কাউকে ছাড়পত্র দিলে হয়তো আমরা নতুন রোগী নিতে পারছি।”

বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইন্সটিটিউটের এপিডেমিওলজিস্ট ডা. এ বি এম মাহফুজ হাসান আল মামুন বলেন, “আগের বছরের থেকে এবার একটা ব্যাপার লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে রোগীদের প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। তারা নানা জায়গা থেকে অবস্থা খারাপ হয়ে এখানে আসছে। ফলে তাদের সুস্থ করাটা জটিল হচ্ছে। যারা আগে আসছে তারা দেখা যাচ্ছে স্বাভাবিক চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে যাচ্ছে।”

এই রোগ প্রতিরোধে সতর্ক থাকা, মশারি টানানো, স্কুলে বা কর্মক্ষেত্রে ফুল হাতা কাপড় ও ফুল প্যান্ট পরা, বাসার আশপাশে মশা হয় এমন জায়গা না রাখা ও মশার আবাস দেখলে সিটি করপোরেশনে জানানোর পরামর্শও দেন তিনি।

নগর সংস্থা কী করছে?

উত্তর বাড্ডা থেকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আসা রোগী মো. শাহীন বলেন, “জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। গরমে একদিন মশারি না টানিয়ে ঘুমিয়েছিলাম। এতেই এই অবস্থা। সিটি করপোরেশন নিয়মিত মশা নিধন করলে এমন হতো না।”

তার মতো হাসপাতালে ভর্তি বেশ কয়েকজন ঢাকার বাসিন্দা সিটি কর্পোরেশনকে দূষছিলেন।

তবে তা মানতে রাজি নয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জোবায়দুর রহমান। তিনি বলেন, “ডেঙ্গু প্রতিরোধে যতো প্রচলিত পদ্ধতি আছে, তার সবই আমরা অনুসরণ করছি। যেসব এলাকায় প্রকোপ বেশি, সেখানে আমাদের অভিযান হচ্ছে।

“ছাদবাগান, জমাটি পানি এসব ব্যাপারে আমরা সচেতন করছি। সকাল-বিকাল আমাদের মশা নিরোধক কার্যক্রমগুলো চালানো হচ্ছে, বাড়িগুলোতেও আমরা নানা উপকরণ দিচ্ছি।‘

আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্বে) ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, “সারাদেশে ডেঙ্গু বাড়লে, দক্ষিণ সিটিতেও আনুপাতিক হারে বাড়ে। তবে পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণেই আছে।

“এইডিস মশার আবাস মানুষের ঘরের ভেতর। আমরা তো ঘরে ঢুকতে পারব না। যারা ছাদবাগান করে, তারা এই মশার চাষ করছে। মানুষ সচেতন হলে ডেঙ্গু কমবে। শুধু আমাদের চেষ্টায় হবে না।”

Share if you like