ভূমিকাটা ছোট্ট করে জমিয়ে বলা
শিলাজিৎ মজুমদার - সংক্ষেপে পরিচিত শিলাজিৎ নামেই। জন্মেছিলেন ১৯৬৫ সালের ৯ অক্টোবর। মননে চিরতরুণ শিলাজিৎও দেখতে দেখতে ৫৮ ছুঁয়ে ৫৯ - এ পা দিয়ে ফেললেন।
বিজ্ঞাপনী সংস্থার চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি গান নিয়ে থাকতে চেয়েছিলেন। ১৯৯৪ এ ভূমিকা যখন এল, সে বছরই কবীর সুমন, অঞ্জন দত্ত, নচিকেতা - প্রত্যেকের ক্যাসেট বেরিয়েছে।
নচিকেতার অভিষেকও ওই বছরই। তবে শিলাজিত অন্যদের তুলনায় আলাদা রাস্তায় হাঁটলেন। বাকিদের গানে ব্যাকরণের একটা ব্যাপার ছিলো। শিলাজিৎ সে জায়গায় একেবারে ফ্রি-স্টাইলে, মুক্তভাবে গান করতে থাকলেন।
প্রেম যেন ওয়েসিস তাকলামাকানে
শিলাজিতের গান আরো বাঁধভাঙা প্রকাশভঙ্গিতে তরুণদের ভেতরের সব চিৎকার নিয়ে হাজির হলো। তরুণদের সেই বয়স, প্রথম প্রেম, চারপাশটা দেখে ভেতরটা পুড়ে যাওয়া, মুরুব্বিদের চোখ রাঙানি বনাম তাদের পরিবর্তনকামিতা- এসবকিছুই উঠে আসতে থাকলো শিলাজিতের গানে।
বাবা অরুণ মজুমদারের লেখা পঁয়ত্রিশ বছরের পুরনো গান 'প্রেম যেন ওয়েসিস' কে সুর দিয়ে গান বানালেন।
তাকলামাকানে মরুভূমিতে যেমন একটু শান্তির পরশ এই ওয়েসিস, তেমনি বিক্ষুব্ধ তরুণদের হৃদয়ে একটু শীতল পরশ নিয়ে আসে প্রেম। গানের শুরুটা আবার হয় লাশ বহনের সময় বলা হরিবোল থেকে। এরপর আবার 'জু জু জু জু জু জু জু ' বলে শুরু৷ তিনি গানগুলো করতেন তরুণদের অনুভূতিকে ধারণ করে তাদের মত করেই।
সুরের ব্যাপারি সবজান্তার দল
শিলাজিতের ভূমিকার উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে গিয়েছিল সারা কোলকাতায়। সেলুনে, দোকানে, বাড়িতে বাড়িতে বাজছে। এদিকে অনেকে বলছেন এসব কোনো গান? এতে লয়-সুর-তাল কই?
শিলাজিৎ তার পরের এলবাম 'শোন আমরাও বেঁচে আছি' - তে টাইটেল গানেই বললেন- 'সুরের ব্যাপারি সব জান্তার দল, বসেছে গুছিয়ে সব সাজিয়ে দোকান / চোলি কা পিছে পিছে ছুটে হয়রান, নতুন সংযোজন জীবনের গান - আ রা রা রা রা রা রা রা’’
সেখানে আলাপের মত করে কণ্ঠে বিদ্রুপ নিয়ে বলছেন- 'এ ভোলা, এ বিষ্ণু, আমাদের নাকি কিছু হবে না!'
মনে হয় যেন আড্ডায় বসে এভাবে আলাপ তুলে চলেছেন।
তিনি মনে করতেন গান গানই, গান স্বতঃস্ফূর্ত, গান হৃদয়ের। এত নিয়মের বেড়াজালে তার স্বাভাবিকতা নষ্ট হয়।
তিনি সেই নিয়ন্ত্রণবাদীদের মিলিটারি জান্তার সাথে তুলনা করেছেন 'সুরের ব্যাপারি' বলে। তাদের বলছেন - 'শোন আমরাও বেঁচে আছি, চাঁদা তুলে বর্ষাতি কিনে দেবো সূর্যকে...'
অর্থাৎ, তরুণেরা বর্ষা নামাবে এত উত্তাপের মাঝেও। সেই বর্ষা সূর্যরূপী ওসব কর্তাদের তাপ একদম নিভিয়ে দেবে।
এক্স (চলক) = প্রেম ধরে নিয়ে কষব
শিলাজিৎ এর মাঝে আরো দুই একটা এলবাম করেছেন। তবে ২০০০ সালের 'এক্স = প্রেম' কাটতিতে ঝড় তুলে ফেলে। 'ঝিন্টি তুই বৃষ্টি হতে পারতিস' গানটি শোনেননি এমন মানুষ বোধহয় কমই আছে। এই গানে বলেছেন - ' জীবনের যত জটিল কঠিন চ্যাপ্টার, এক্স = প্রেম ধরে নিয়ে কষব।' কিংবা 'জীবনটাকে নম্বরে কেন মাপছিস?' কত সহজ করে কত কঠিন কথা বলা।
সে সময় অনেক বুঝিয়ে অডিও কোম্পানিকে রাজি করিয়েছিলেন এই নাম দিতে। নামটি নিয়ে প্রযোজকের সংশয় ছিলো, কারণ এটি অনেকের কাছে নেতিবাচক বা অশ্লীল বোধ হতে পারে। কিন্তু সেই এলবাম বারুদের মতো হয়ে পুরো বাংলাকে কাঁপিয়ে দিলো।
আবার যা পাখি উড়তে দিলাম তোকে গানটা বোধহয় কিশোর-তরুণ বয়সের প্রেমের, প্রতারণার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
দোহাই আমায় কেউ পাগল বোলো না
২০০২ সালের 'ফিসফিস' এলবামের পুরোটা জুড়েই সাইকেডেলিক সব গান। এসব গান বাইরের নয়, বরং যেন ভেতরের সত্ত্বার অবর্ণনীয় চিৎকার। এই এলবামের 'ফিসফিস' গানে যেমন বদ্ধ ঘরে অন্ধকারে থাকা লোকটি বলছে 'দোহায় আমায় কেউ পাগল বোলো না।' এই ক্যাসেটের প্রতিটি গানই আমাদের ভেতরে থাকা অপ্রকাশ্য অনুভূতি, অন্তর্দ্বন্দ্ব, সংঘাত, অন্ধকারকে এমনভাবে সামনে নিয়ে আসে যার মুখোমুখি সহজে কেউ হতে চায়না। এ এমন এক অতলস্পর্শী অনুভূতি যা প্রত্যেকেই অনুভব করি।
ধরা দিও দেখো ঠিক নৌকা কিনে দেবো
পরের বছর শিলাজিৎ ফোক গান করলেন। লাল মাটির সরাণে এলবামটি প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা পায়। ফোকের স্বাদ ঠিক রেখে তিনি নিজস্ব ভঙ্গিমায় গানগুলো করেন। ভাদু গানও করেছিলেন। আবার নৌকা কিনে দেবোর মতো ফোক গানকে রকের সাথে করেও গেয়েছেন। লিরিক সাজিয়েছেন নিজের মতো - ' পুরীর পাণ্ডার মতো ঠিক পিছু নেবো, ধরা দিও দেখো ঠিক নৌকা কিনে দেবো, ও গুরু নৌকা কিনে দেবো।'
একমাত্র পুত্র ধী মজুমদারের সাথে শিলাজিতের সম্পর্কটা বন্ধুর মতো, ছবি: শিলাজিতের ফেসবুক পেজ থেকে
সর্বনাশ সু-লিখবো আজ
'সর্বনাশ আমি বলতে চাই / সর্বনাশ আমি বলবো তাই/ সর্বনাশ করলাম আজ/ সর্বনাশ সু-লিখবো আজ/ স্লোগান তোমার সফেদ দেয়ালে'
শিলাজিতের সর্বশেষ তুমুল আলোচিত এলবাম সর্বনাশ। ২০০৮ সালের এই ক্যাসেটের টাইটেল গানটার কথা ও সঙ্গীত ভীষণভাবে সাইকেডেলিক। এই সাইকেডেলিক হার্ড রক গানটি তার সবচেয়ে জনপ্রিয় কাজগুলোর একটি। এলবামটি সে সময় তুমুল জনপ্রিয়তাও পেয়েছিলো। অন্য গানগুলোতেও তিনি নিরীক্ষা করেন। যেমন- একটা ডবকা চাঁদ উঠেছে আকাশে। এখানে যেন একরকম পরাবাস্তবতার স্বাদ মেলে।
স্পাইনাল কর্ড দিন রাত্রির সলতে
শিলাজিতের গানগুলো তরুণদের তারুণ্যের শক্তিরই প্রতীক। সাথে তার গান তুলে এনেছে তাদের ভেতরের ক্ষতকেও। 'বুকে আমার বারুদের বাসা সজনী' গানটিতে যেমন বলছেন - 'বুকে আমার বারুদের বাসা সজনী, স্পাইনাল কর্ড দিন-রাত্রির সলতে/ বিস্ফোরণের ভয় নিয়ে তাই পারিনি, তোমার সঙ্গে পায়ে পায়ে পথ চলতে।'
এমন অনেক তরুণ রয়েছেন যারা গণমানুষের কথা ভাবতে গিয়ে ,রাজনীতির কারণে ভালোবাসাকে হারিয়েছেন। তারপর আবার একসময় সেই রাজনীতিতেও হয়েছেন প্রতারিত।
কমরেড অর্ণব ভট্টাচার্যের আত্মহত্যার পর এই গানটিকে সিপিআই(এম) এর অনেকেই অর্ণবের জীবনের সাথে মিলিয়েছিলেন। এভাবে শিলাজিতের প্রায় বছর বিশেক আগের গানও সময়ে সময়ে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। গানটার শুরুতে থাকা নিজের কণ্ঠে বলা - 'জমাট একটা বুক হয়ে যায় হালকা, ঠাণ্ডা কবিতা' কথাটার মতোই।
শিলাজিৎ টিভি
শিলাজিৎ এখন মূলত গান প্রকাশ করেন তার ইউটিউব চ্যানেল 'শিলাজিৎ টিভি'-তে।
গতবছর র্যাপার রাজকুমারের সাথে 'ভারী মেঘ তবু বৃষ্টি নেই' নামে একটি রূপকধর্মী কাজ করেছেন। প্রতি রবিবার 'সানডে শিলাজিত' নামে সাপ্তাহিক আয়োজনে গান করেন তার চ্যানেলে।
এছাড়া রক সেশন করছেন। 'অন দ্য রক' নামে এই সেশনের একদম শুরুতে তার প্রিয় তরুণদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন- 'ছালারা (ছেলে), মরবি তো একেবারে শেষ দেখে মরবি, না লড়ে মরবিনা। '
লাশ হয়ে আজ মরছি না
শিলাজিতের গানের চূড়ান্ত গন্তব্য তরুণদের কথা বলা, তাদের শক্তিকে জাগানোর কথা বলা। হতাশা, প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে সিনা টান করে বাঁচার কথা বলা।
ব্যক্তি শিলাজিৎ নিজেও সেই জায়গা থেকে সরে যাননি। বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে ২০২১ এ আনন্দবাজারকে দেয়া এক ইন্টারভিউতে বলছেন - 'আমি বিজ্ঞাপনী সংস্থার চাকরিটা ছেড়েছিলাম শিল্পী হতে চাই বলে। রাজনীতিতে এলে আমার সেই শিল্পীর এলেমেলো জীবনটা আর থাকবেনা। যেভাবে কথা বলি সেটা বলতে পারবো না।'
তিনি মনে করেন, শিল্পীদের উচিত নয় একতরফাভাবে কোনো পক্ষে যাওয়া। তার মতে, 'আমার দাদু কংগ্রেস সমর্থন করতেন। বাবা-কাকারা হয়ত বাম সমর্থন করতেন। কিন্তু তাতে তাদের পারিবারিক কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু এখন স্বামী-স্ত্রী আলাদা দল হলে ঘর ভেঙে যায়।'
শিলাজিতের গানে তরুণদের দুর্দমনীয় শক্তিই মুখ্য। তাই কোনোরকম বিভক্তির দিকে তার আগ্রহ নেই। তিনি চান সবকিছুর উর্ধ্বে তরুণেরা সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলুক। মানুষেরা যেন জীবন্ত লাশ না হয়ে মানুষ হয়েই বাঁচে সে কথাই বলেছেন ' কবর' গানে- ' তাই মরছি না ভাই মরছি না/ লাশ হয়ে আর মরছি না।'
এ প্রজন্মের কাছে শিলাজিৎ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন কায়েস মাহমুদ স্নিগ্ধ। শিলাজিতের গান নিয়ে তার আছে আলাদা ভালোলাগার জায়গা। তিবি বললেন, “আমার মনে হয়, কোলকাতার গান বা শিল্প-সাহিত্যে বেশ আরোপিত কিছু ব্যাপার আছে। এই জায়গায় শিলাজিৎ আলাদা। শিলাজিত দেবতা নন, শিলাজিত মানুষ। 'আমি আগুন সেজে পুড়ি বা পোড়াই' কিংবা 'ঝিন্টি তুই বৃষ্টি হতে পারতিস' – এর মতো কথা কোলকাতার প্রগতিশীল মহলও বলতে পারেননি। অন্যান্য শিল্পীরা, যেমন কবীর সুমন ঈশ্বরের মত একটা জায়গা থেকে সবকিছু দেখেছেন, সে জায়গায় শিলাজিত আমার কাছে একজন আধপাগলা-ক্ষ্যাপাটে রকস্টার, যিনি পুরোপুরি সৎ, কোনো দলের কাছে বিক্রি হননি। , নিপাট সূর্যের মত দাঁড়িয়ে বলতে পারেন, 'আমার শরীর আর এ শরীরে মন।''
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরমেন্স স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী রাফায়াতুল্লাহ সোহান শিলাজিতের খুব ভক্ত। তিনি বললেন, ''গান আর কবিতার মাঝের দূরত্ব ঘুচিয়ে দেয় শিলাজিৎ। তার গান কখন কবিতা থেকে গান, বা গান থেকে কবিতা হয়ে ওঠে টের পাওয়া যায় না। মাঝে মাঝে মনে হয় শিলাজিতের পুরো মিউজিক্যাল ইউনিভার্সটা, মফস্বলে বেড়ে ওঠা এক রঙ্গিন মহাকাব্য!''
মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী।