এই বছরই হিন্দি সিনেমায় তিন দশক পূর্তি উদযাপন করলেন শাহরুখ খান, বুধবার পূর্ণ করছেন জীবনের ৫৭ বছর। তাকে নিয়ে বই লিখেছেন স্রায়ানা ভট্টাচারিয়া। বলিউড তারকা শাহরুখ কী করে সারাবিশ্বে আইকন হয়ে উঠলেন, সেই রহস্য ভেদের প্রয়াস চালিয়েছেন এই লেখক। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
অবশ্য শাহরুখ কী করে এত দীর্ঘ সময় বলিউডে টিকে গেলেন, তা ব্যাখ্যা করা জটিল কিছু নয়। লাখ লাখ মানুষ তার অন্ধভক্ত। দর্শকরা ভালোবেসে তাকে এতটাই পূজনীয় করে ফেলেছে যে কখনও কখনও বিব্রত হতে হয় খোদ এই অভিনেতাকেই।
কিন্তু দর্শকরা কেন শাহরুখের এত ভক্ত? কীভাবেই তার উত্থান, তা বিশ্লেষণ করেছে বিবিসি।
শাহরুখের সিনেমায় থাকে দারুণ প্রেম ও ভরপুর আবেগ। এ কারণেই দর্শকদের মনে আলাদা জায়গা করে নিয়েছে শাহরুখের সিনেমাগুলো।
ভারত ও দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে জনপ্রিয়তার নিরিখে রোমান্টিকতা ও আবেগ প্রকাশে শাহরুখকেই সেরা মানতে হচ্ছে।
শাহরুখ একটি সমৃদ্ধ, বহুমুখী ও মানবিক জগতের ঝলক এমনভাবে দেখান যে নাক ফোঁস ফোঁস করা আক্রোশ ভুলে যে কেউ হাসতে পারে।
লাখ লাখ ভারতীয়ের কাছে দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গল্পে ‘পোস্টার বালক’ হয়ে রয়েছেন শাহরুখ।
নব্বইয়ের দশকে রুপালি পর্দায় আবির্ভাব ঘটে শাহরুখ খানের। ঠিক ওই সময় ভারতও তাদের অর্থনীতির বাজার উন্মুক্ত করে। শাহরুখ এগিয়ে চলেছিলেন সামনে, সেই সঙ্গে এগিয়ে চলেছিল ভারতের অর্থনীতিও।
ব্যবসা-বাণিজ্যের ধরনে বদল আসার ওই সময়ে টেলিকম খাতে বিদেশি বিনিয়োগের দুয়ার খুলে দিয়েছিল ভারত। টেলিকমের কারণে নিউ মিডিয়া নেটওয়ার্ক যে হালে পানি পেল। এসব চ্যানেলগুলোর দৌলতে এই খানের সিনেমা, গান ও সাক্ষাৎকার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ছিল; তার আগে আর কোনো তারকার বেলায় এমনটা ঘটেনি।
এরমধ্যে নতুন সোডা পানীয়, গাড়ির ব্র্যান্ড আসে বাজারে। এসব প্রতিষ্ঠানগুলো শাহরুখ খানকে তাদের পণ্যের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর করে নেয়।
বলতে গেলে, শাহরুখ খানের দিল্লির সাধারণ এক পরিবার থেকে আন্তর্জাতিক তারকা হয়ে ওঠার মতো নাটকীয় উত্থান যেন ভারতে সফলতার নতুন রূপকথা। চলচ্চিত্র শিল্পকে উপরে তুলে দেওয়ার মতো কোনো পরিচিত যোগাযোগ না থাকার পরও শাহরুখ অসম্ভবকে ‘সম্ভব করার’ একটি দৃষ্টান্ত।
অর্থনীতির বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শাহরুখের ভাবমূর্তিও বেড়ে চলেছিল।
ধর্মভাবের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয়রা ধরে রাখার চেষ্টা করছে এমন ঐতিহ্যময় অতীত, যার মাধ্যম হয়ে উঠলেন শাহরুখ খান।
সমালোচকরা বলেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আমলে অসহিষ্ণুতা বেড়ে গেছে; বেশির ক্ষেত্রে মুসলামানদেরই ভুক্তভোগী হতে হচ্ছে এতে।
শাহরুখ খানের ছেলে আরিয়ান খান গত বছর এক মাদক কাণ্ডে আটক হন এবং পরে ছাড়া পান। অনেকেরই মনে হয়েছে, একজন সফল মুসলমান আইকনকে নাস্তানাবুদ করাটাই এই মামলার উদ্দেশ্য ছিল।
ভারতের বহু সম্প্রদায়ের সহবস্থান প্রসঙ্গে শাহরুখ খান অনেক চিন্তাশীল মন্তব্য করেছেন। তিনি তার সমসাময়িক অনেকের চেয়ে বেশি মুসলমান চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
তবে ধর্মীয় পরিচয়ে শাহরুখ খানকে সীমিত রাখতে চায় না ভক্তরা। বরং ভক্তদের কাছে তিনি জ্ঞানী, দুষ্টু, সফল এবং দারুণ আবেদনময়।
শাহরুখ খানের স্ত্রী একজন হিন্দু। এই মিশ্র ধর্মীয় বিশ্বাসের পরিবারের উপর ডান রাজনৈতিক আক্রমণ নিয়ে এক তরুণ ভক্তের সঙ্গে কথা হয় বিবিসির।
ভক্তটি বলেন, “তিনি অসাম্প্রদায়িক। কিন্তু তিনি দুর্দান্তভাবে আকর্ষণ করেন।”
শাহরুখ খানের বেশির ভাগ চরিত্রই ছিল মানুষের ভাঙা মনকে ঘিরে; ব্যর্থ প্রেমিক, বিষণ্ন নায়ক, ব্যর্থ স্বামী, নাজুক মুসলমান এবং এমনকি অবসাদগ্রস্ত খলনায়ক চরিত্রও।
শাহরুখ যত ধরনের পুরুষ চরিত্র করেছেন, সেই চরিত্ররা আর সবার সামনে সহজ হতে পারেন না সহজে।
চরিত্রের ভেতরের এইসব অনুভূতিতে গত তিন দশক ধরে নানা বিবর্তন এসেছে। তারা কখনও মানসিক ভাবে দুর্বল, কখনও তারা মনে করেন মনের মত করে ভালোবাসা মিলছে না, আবার ভালোবাসার তীব্র ইচ্ছেকেও তারা দমিয়ে রাখতে পারেন না।
দক্ষিণ এশিয়ার সেরা রোমান্টিক নায়ক বলা যেতে পারে শাহরুখ খানকে।আশেপাশে দেখা প্রেমের সঙ্গে মেলানো যায় তার অভিনীত সিনেমাকে।
সিনেমায় তার চরিত্র নারী চরিত্রটির প্রতি আলাদা আবেগ নিয়ে চলে, যা অন্য বলিউড নায়কদের চরিত্রের বেলায় দেখা যায় না।
শাহরুখ খানের সিনেমার চরিত্রগুলো সাধারণভাবে নারীর ভালোবাসা অর্জন করে না; তারা প্রেমিকার বাবার রাজি হওয়ার অপেক্ষায় থাকে, বন্ধু ও পরিবারের মন পাওয়ার চেষ্টা করে।
শাহরুখ যখন যে চরিত্র করেন তারা অনুভব করেন গভীরভাবে, চোখের জল মোছেন বারবার। অন্য কোনো নায়কের চেয়ে শাহরুখ কতটা দারুণ কাঁদতে পারেন, সেসব কথা চিত্রনাট্য লেখকরা তো প্রায়ই বলেন। সিনেমায় শাহরুখ খানের চোখ ভরা জল যেন মন ছুঁয়ে যায় সবার; আর তাই তো দুনিয়া জোড়া ভক্তকূল শাহরুখের।
এই বলিউড বাদশার টেলিভিশন সাক্ষাৎকার ও পাবলিক লেকচার বিশেষভাবে তার হাস্যরস ও সৌজন্যতার দিকটি তুলে ধরেছে সবার কাছে।
বিবিসি বলছে, অনেক শহুরে শিক্ষিত ভক্ত আছেন যারা সিনেমা নয়, বরং শাহরুখের সাক্ষাৎকারেরই ভক্ত।
মিডিয়াতে বলা সেসব কথাই এখন পর্যন্ত শাহরুখের সেরা পারফরম্যান্স বলে মানেন অনেকে; যেখানে তাকে মনে হয় কোনো অনুশোচনাহীন মধ্যবিত্ত সুপারস্টার।
আত্মঅহংকারী ও আকর্ষণীয় এই দুই মিশেলে শাহরুখ খানে ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠেছে ভক্তদের কাছে।
ধূমপায়ী, স্পষ্টভাষী, সচেতন এবং কৌতুকপ্রিয় খান ভক্তদের কাছে কখনই একঘেয়ে হতে দেন না নিজেকে। বিশ্ব হোক অথবা নিজেকে নিয়ে কোনো উক্তি কিংবা কৌতুক- এসব কিছুর পেছনে একজন পরিশ্রমী, সংবেদনশীল এবং নিজের কাজকে ভালোবাসা একজন মানুষ হয়ে ওঠেন শাহরুখ খান।
এই অনিশ্চিত ও রুঢ় বাস্তব বিশ্বে শাহরুখ খান দারুণ প্রভাবক, নিয়ম ভাঙ্গা ও বিনোদনের প্রতীক হয়ে উঠেছেন।
একটু বিরতির পর ২০২৩ সালে এই নায়কের তিনটি বড় সিনেমা আসতে চলেছে পর্দায়। তার ভক্তরা একারণে ভীষণ উচ্ছ্বসিত। যদিও তাদের আশংকা কাজ করছে শাহরুখের মত মুসলমান আইকন ও বলিউড সিনেমা বয়কটে ডান রাজনীতির সোশাল মিডিয়া ক্যাম্পেইন নিয়ে।
রাজনীতির মারপ্যাঁচ তো রয়েছেই, কিন্তু অভিনেতার শক্তি হচ্ছে পর্দায় হাসি ও গল্পে তিনি দর্শককে কতটা বেঁধে রাখতে পারেন।
বিবিসির ভাষ্যে, আরও ত্রিশ বছর অপেক্ষা করা সম্ভব নয়; এই ভঙ্গুর সংস্কৃতিতে শাহরুখ খানের কৌতুক এবং সেই দুই হাত মেলার আহ্বান খুবই জরুরি এখন।