শক্তি চট্টোপাধ্যায় জন্মেছিলেন আজ থেকে উননব্বই বছর আগে, ২৫ নভেম্বর, ১৯৩৩ সালে।
শক্তি চট্টোপাধ্যায় মূলত কবি বলেই আমাদের কাছে পরিচিত। তবে শুরুতে চেষ্টা করেছিলেন উপন্যাস লেখবার। কুয়োতলা নামে সেই উপন্যাসটা বেরিয়েছিলো, যদিও খুব বেশি আলোচনা হয়নি তা নিয়ে।
এরপর সমীর রায়চৌধুরীর সাহচর্যে আস্তে আস্তে কবিতায় ঝুঁকলেন শক্তি। যদিও এরপর হাংরি আন্দোলনে জড়িয়েছেন ও তা থেকে বের হয়েও এসেছেন, পরবর্তীতে জড়িয়েছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়দের কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর সাথে।
ছবি: দেশিব্লিটজ.কম
কবিতা কি আসলে বোঝার বিষয়? নাকি অনুভবের? কবিতা আমাদের কোনোকিছু শেখায় নাকি নিজেদের মতো করে অনুভব করায়? বোধের দিক থেকে মনে হয়, , দ্বিতীয় ব্যাপারটিই সত্য। সেক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী কবিতা আসলে কীভাবে হয় তা নিয়ে জল্পনা কল্পনা আছে বিস্তর। সাধারণভাবে ধরা হয়, ভালো কবিতায় ভালো চিত্রকল্প থাকে। তবে শক্তির লেখা লিরিক্যাল কবিতাগুলো শুধু সে জায়গাতেই না, বরং ভাবনার এক বিশাল অর্গল খুলে দেয় পাঠকের সামনে।
তার বিখ্যাত কবিতা 'অবনী বাড়ি আছো'-তে যেমন লিখছেন - 'আধেক লীন হৃদয় দূরগামী/ ব্যথার মাঝে ঘুমিয়ে পড়ি আমি/ সহসা শুনি রাতের কড়া নাড়া- অবনী বাড়ি আছো?'
আড্ডায় শক্তি, সুনীল ও তাদের আরেক বন্ধু, ছবি: অবজারভারবিডি থেকে সংগৃহিত
কে এই অবনী? এত রাতে কেন তাকে কেউ ডাকতে আসে? এই অবনীকে পাঠক একেকভাবে অনুভব করতে পারেন। অবনী কি নকশাল বা এমন কোনো আন্দোলনে জড়িয়ে যাওয়া কেউ, যাকে কেউ খুঁজে বেড়াচ্ছে? নাকি অবনীর আছে সিজোফ্রেনিয়ার মতো জটিল কোনো রোগের লক্ষ্মণ? হয়তো কেউ বাস্তবে ডাকে না, কিন্তু সে সেই ডাক শুনতে পায়! যদিও শক্তি এতসব কিছু মাথায় রেখেও লেখেননি বলেই ধরা হয়।
শক্তির কবিতাগুলো এভাবে একরকম বিমূর্ত রূপ লাভ করে। যেমন- 'যখন বৃষ্টি নামল' তে তিনি লিখেছেন- ' কূল ছিঁড়ে আজ অকূলে যাই এমন সম্বলও নেই নিকটে/ হয়ত
ছিলো বৃষ্টি আসার আগে/ পোড়োবাড়ির স্মৃতি, আমার স্বপ্নে মেশা দিন/ চলচ্ছক্তিহীন হয়েছি/ চলচ্ছক্তিহীন....'
কেনো এই প্রেমিকের হৃদয়ে হাহাকার? কেন সে আজ আর চলতে ফিরতে পারেনা? স্বপ্নে মেশা দিন কেন পোড়োবাড়ির স্মৃতি হয়ে থাকে আজ? এসব প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তর নেই। কিন্তু পাঠক ভেবে নিতে পারেন তার মতো।
'কিন্তু তুমি নেই বাহিরে/ অন্তরে মেঘ করে/ ভারী ব্যাপক বৃষ্টি আমার বুকের মধ্যে ঝরে।'
এই যে বুকের মধ্যে ঝরতে থাকা বৃষ্টি - এই বৃষ্টি যেন অতীতের ভালোবাসায় ভেজা বৃষ্টিকে ঢেকে দেয়।
আবার, সহজ কথার ভেতর, প্রত্যয়ের ভেতর ধ্বংসের সম্ভাবনাও দেখা যায় তার কবিতায়। যেমন- 'যেতে পারি, কিন্তু কেন যাব' - তে লিখেছেন - 'এত কালো মেখেছি দু হাতে এতকাল ধরে'।
আবার এরপরের প্যারায় বলা হচ্ছে- 'এখন খাদের পাশে রাত্তিরে দাঁড়ালে/ চাঁদ ডাকে, আয় আয় আয় /
এখন গঙ্গার তীরে ঘুমন্ত দাঁড়ালে/ চিতাকাঠ ডাকে, আয় আয়।'
চাঁদের সেই অমোঘ আহ্বান কেন সেই ব্যক্তিকে চিতাকাঠের দিকে নিতে চায়? কী এমন কলঙ্ক করেছে সে যাতে সে নিজেকে শেষ করে দিতে চায়?
'তোমাদেরও সঙ্গে নিয়ে যাব/ একাকী যাবো না অসময়ে।' - এই চরণ যেন ভেতর শিহরণ জাগায়। মনে হতে পারে, হয়ত অপরাধী কলঙ্কিত কোনো মানুষ খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে দুলছে ফেরা আর না ফেরার দ্বন্দ্বে। কিন্তু একেবারে ফেরার উপায় না পেলে তখন সবাইকে নিয়ে সেই করুণ পরিণতির দিকে এগোনো হয়।
শক্তি লিখেছেন- 'প্রভু নষ্ট হয়ে যাই' এর মতো লাইন। মানুষের অমিত সম্ভাবনা, তারপর ভালো থাকার জন্য খাঁচাবন্দি কৃত্রিম সাফল্য সুখ নিয়ে 'নষ্ট' হওয়া থেকে বাঁচতে হবে তো! সমাজের-রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণবাদিতা ও সীমারেখা অতিক্রম করলেই যে সবাইকে নষ্টের কাতারে ফেলে দেয়া হয়!
শক্তির সবচেয়ে প্রচলিত ও পরিচিত ছবি এটি, ছবি: সংগৃহীত
শক্তি তার সুবিখ্যাত কবিতা 'আনন্দভৈরবী' তে লিখেছেন, ' সে কি জানিতো না এমনি দু:সময়, লাফ মেরে ধরে মোরগের লাল ঝুঁটি / সে কি জানিত না হৃদয়ের অপচয়, কৃপণের বাম মুঠি / সে কি জানিত না যতবড় রাজধানী, তত বিখ্যাত নয় এ হৃদয়পুর/ সে কি জানিত না আমি তারে যত জানি আনখ সমুদ্দুর।' - এই কবিতাটি এমন এক বাস্তবতার সামনে দাঁড় করায়, যার মুখোমুখি হতে চাইনা, কিন্তু এড়িয়েও যেতে পারিনা। আমাদের বড় বড় ইমারত হয়, আমাদের বস্তুগত সমৃদ্ধি হয়, কিন্তু আমাদের সেই বৃষ্টি, আষাঢ় বেলার মাটির ঘ্রাণ, উদ্যানে ফুটে থাকা ফুল হারিয়ে যায়। আমাদের সংবেদনশীলতা মরে যায়, নানারকম প্রতিবন্ধকতা আমাদের পিছনে টেনে ধরে।
তবে সবকিছুর পর শক্তির চূড়ান্ত বিশ্বাস ও ভরসা ছিলো মানুষের ওপরই। একদিকে যেমন সন্ত্রাসের সামনে মানুষের অসহায়ত্বকে প্রকাশ করেছেন 'ছেলেটা' কবিতায়- 'ছেলেটা খুব ভুল করেছে শক্ত পাথর ভেঙে/ মানুষ ছিলো নরম, কেটে ছড়িয়ে দিলেই পারত।'
কিন্তু মানুষেরই পাশে মানুষের দাঁড়ানোর কথা বলছেন তিনিই 'মানুষ বড় কাঁদছে' কবিতায়- 'মানুষই ফাঁদ পাতছে , তুমি তাহার পাশে দাঁড়াও/ মানুষ বড় একলা/ তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও।'
শক্তি তার কবিতাকে পদ্য বলতেই পছন্দ করতেন, ছবি: ওয়াল.ইন
শক্তি তার 'একবার তুমি' কবিতাতেই সেই সহানুভূতিশীলতার কথাই বলেছেন। তিনি লিখেছেন, ' বুকের ভেতরে কিছু পাথর থাকা ভালো / ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়। '
আমরা যে ক্রমশ সভ্যতার নামে শুধু হৃদয়বিহীন হচ্ছি, তাও তুলে এনেছেন এ লেখায়- ' মাছের বুকের পাথর এখনই আমাদের বুকে এসে জায়গা করে নিচ্ছে/ আমাদের সবই দরকার/ আমরা ঘরবাড়ি গড়বো- সভ্যতার একটা স্থায়ী স্তম্ভ গড়ে তুলব।'
শক্তি এখানে রূপকের অসাধারণ প্রয়োগ করেছেন। আমাদের হৃদয় যখন অনুভূতিশূণ্য, তখন না হয় পাথরই জমা হতে থাক, তবু প্রতিধ্বনি শুনে আমরা বুঝতে পারবো অন্তত এখানে হৃদয় বলে কিছু তো একটা ছিলো!
শক্তির এমন শক্তিমত্তার প্রয়োগ আরো বহু কবিতাতেই ঘটেছে- ধর্মেও আছো, জিরাফেও আছো; ছিন্নবিচ্ছিন্ন, হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান, ভিতরে-বাইরে বিষম যুদ্ধ, এপিটাফসহ আরো বহু কবিতার কথা উল্লেখ করা যায়।
শেষ করা যাক, শক্তিরই আরেকটি কবিতার অংশ দিয়ে। ' মনে মনে বহুদূর চলে গেছি' কবিতায় তিনি লিখেছেন, ' মনে মনে বহুদূর চলে গেছি/যেখান থেকে ফিরতে হলে আরো একবার জন্মাতে হয়।'
শেকড় থেকে বহুদূর চলে যাওয়া মানুষ চাইলেও সেখানে আর সেভাবে ফিরতে পারেনা। আবার, নানান ঘাত-প্রতিঘাতে মানুষ নিজেকে হারিয়ে ফেলে। শক্তি মানুষের সেই নিজেকে ফিরে পেতে যে প্রচেষ্টা তাতে আস্থা রেখেছেন। হয়ত বিষয়টি কঠিন, কিন্তু পুরোপুরি অসম্ভব বলেও মনে করেননি তিনি। শক্তি লিখেছেন, 'পথ তো একটা নয়/
তবু, সবগুলোই ঘুরে ফিরে ঘুরে ফিরে শুরু আর শেষের কাছে বাঁধা/........ একপ্রান্তে জনপদ অন্যপ্রান্ত জনশূণ্য/ দুদিকেই কূল, দুদিকেই এপার-ওপার, আসা-যাওয়া, টানাপোড়েন/ দুটো জন্মই লাগে / মনে মনে দুটো জন্মই লাগে।'
মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী।