লস্ট এন্ড রেয়ার রেসিপির হেঁশেলে ঢুকে ত্রিভুজাকৃর্তির বোতামটা টিপলেই শুনতে পাবেন হারিয়ে যাওয়া কোনো রান্নার গল্প। এই রান্না এককালে কাদের হেঁশেলে রোজ হতো,কেমন ছিল তাদের জীবন যাপন, কেমন করে তারা জোগাড় করতেন এইসব রান্নার উপকরণ এই সব নিয়ে রান্না দেখানোর সাথেসাথে স্ক্রিনের ওপাশ থেকে বলে যাবেন হাসিমাখা চেহারার এক রসনাবিদ, শ্রী শুভজিৎ ভট্টাচার্য।
শুভজিৎ ভট্টাচার্য নিজের ইউটিউব চ্যানেলে ফিরিয়ে এসেছেন বাংলার রসনা ভান্ডারের লুপ্তপ্রায় রান্নাগুলিকে। তিনি সেই রান্নাগুলিকে যুগোপযোগী করে তুলে আনার চেষ্টা করেছেন। চ্যানেলের রান্না গুলি প্রায়শই আজকের দিনে পাওয়া দুষ্কর, তাই প্রস্তুত প্রণালীর হদিস তো আরো দুষ্কর। তিনি নিরলস চেষ্টা করেছেন সেগুলির স্বাদ হবহু না হোক, অন্তত কাছাকাছি পর্যায়ে নিয়ে যাবার। রান্নার সাথে সব খানদানি তৈজসের ব্যবহার, যেনো কতকটা সময়ের জন্য ওই হারানো সময়টাকেই ফিরে পাওয়া।
কেমন করে কি দিতে হবে তা একে বারে সহজ সরল করে ঘরের লোকের মতো শিখিয়ে যাচ্ছেন চমৎকার ভাষ্যে। প্রতিটি রান্নার সাথে শুনতে পাওয়া যায় তাদের অতীত কালের কথা।
প্রখ্যাত রন্ধনশিল্পী শুভজিৎ ভট্টাচার্য
শুভজিৎ বাবুর খাবার-দাবার নিয়ে বরাবরই খুব উৎসাহ। খেতে যেমন ভালোবাসেন, তেমনি ভালোবাসেন খাওয়াতেও। পারিবারিক বৃত্তিটি অবশ্য ভিন্ন- ইভেন্ট ব্যবস্থাপনা, বন্ধু অমিত দস্তিদারের সাথে। অমিতের আগ্রহের জগতটি আবার একটু আলাদা। তার মাতামাতি শ্যুটিং, এডিটিং আর আবহ সঙ্গীত নিয়ে। নিজে আবার খুব ভালো গান করেন।
শুভজিৎ পৃথিবীর যে কোণেই বেড়াতে গিয়েছেন, কুড়িয়ে এনেছেন রান্নার বই, নিজের বাড়িতে গড়েছেন রান্নার পাঠাগার। বইয়ের নেশায় পড়ে কখনো ফেলে এসেছেন জামা কাপড়। তার বাড়িতে অস্ট্রেলিয়ার জুনিয়র মাস্টারশেফের রেসিপি ডাইজেস্ট যেমন আছে, তেমনি আছে দেড়শো বছর পুরানো উঁইয়ে খাওয়া বইয়ের অতি যত্নে করা জেরক্স, যেটি আবার ভারিক্কি সব নামের মুখরোচক মিষ্টান্নে ঠাসা - ছানার রসমাধুরী, মদনদীপক, মাধুপুরী, ব্রহ্মানন্দপুরী।
এইসব পুরানো বইটই সংগ্রহ থেকে আগ্রহের শুরু। এরপরে এলো দুহাজার কুঁড়ি আর পড়লো লকডাউন। ইভেন্ট ব্যবস্থাপনা হলো বাঁধাপ্রাপ্ত। নতুন ভাবনা শুরু। বাড়িতে বন্দি লোকের মনোরঞ্জনে হবে রান্না, তাই খোলা হলো চ্যানেল।
শুভজিৎ বাবু এই নিয়ে বলেন, "লোকে এই কোরমা, সেই কোরমা আর রোগানজস নিয়ে বসে, তো আমার কাছে যেই সোনার খনি আছে তা কেনো লোককে দেখাবো না।" সেই দিয়ে শুরু। গেলো পয়লা সেপ্টেম্বর লস্ট এন্ড রেয়ার রেসিপি পার করলো তার দুইবছর।
লস্ট এন্ড রেয়ার রেসিপির প্লেলিস্টে বাঙালি -অবাঙালি হরেক রকম রান্নার পদ। তার মাঝে আলাদা করে আছে বাংলাদেশের রান্না নিয়ে সিরিজ, যার রেসিপি গুলি শুভজিৎ বাবু সংগ্রহ করেছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন বন্ধু, কারো পারিবারিক সূত্র আর পুরানো বই থেকে। যেমন একটি রান্না ছিল ইলিশের ননীবাহার, যেটি এই চ্যানেল দেখে উৎসাহিত হয়ে বাংলাদেশের মেয়ে ইন্দ্রাণী দে শুভজিৎ বাবুকে জানান। পদটি ছিল গাজীপুরের কাশিমপুর রাজবাড়ীর। ইন্দ্রাণীর পিতা অনামিপ্রসাদ রায়চৌধুরী ছিলেন সেখানকার শেষ জমিদার। যখন খুব বর্ষা হতো, বর্ষার রাতে জেলেরা যেতো মাছ ধরতে। তারা ইলিশ তুলতো আর ভোরবেলা সেই রুপোলি চকচকে ইলিশ জমিদার বাড়ির হেঁশেলে। জমিদারবাবু রাত্রিবেলা দুধ গরম করতেন, ঠান্ডা করে সারারাত রেখে দিতেন একখানে। সোঁদা আবহ পেয়ে দুধে উঠতো ননী। সেই ননী তুলেই হতো ইলিশের ননীবাহার, যার স্বাদ ভারী অপূর্ব।
ইন্দ্রাণী দেবীর ইচ্ছে ছিল রেসিপিটা ঘরে ঘরে ছড়াবে, সেই অভিপ্রায়টি এইখানে পূর্ণ হয়ে যায়।
বাংলাদেশের সিরিজ মিলিয়ে চ্যানেলটিতে অঞ্চলভিত্তিক পনেরটির মতো বাংলাদেশি রান্না আছে। যেমন চট্টগ্রামের খুড়বো, বরিশালের চিংড়ির জলবড়া, নাটোরের পুরপুরি, যশোরের নারকেল মুরগি, খুলনার হাত মাখা ভেটকি। এমনকি বৃটিশ আমলে গোয়ালন্দ হতে যেই স্ট্রিমার কলকাতার ঘাটে ভীড়তো তার রসুই হতে নিয়ে এসেছেন স্টীমার মুরগির ঝোল। সবকটি রান্না পরিবেশনা আর স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয়।
শুভজিৎ বাবু নিজের নানা অভিজ্ঞতা হতে বাঙ্গালার রান্নার ঐতিহ্য নিয়ে বলেছেন বাংলা বরাবরই সমৃদ্ধ তার রন্ধন ভাণ্ডারে। ভারতবর্ষের প্রথম রান্নার বইটি বের হয়েছিল খোদ বাংলাতেই। নাম ছিল পাকরাজেশ্বর যার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বর্ধমানের মহারাজ মেহতাব চান্দ। কলকাতা ছিল বৃটিশ শাসনের অন্যতম রাজধানী অপরদিকে ঢাকা অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্র। নানা সংস্কৃতির মিশেলে বাংলার সংস্কৃতি পরিপুষ্টি লাভ করে। পর্তুগিজ, ফ্রেঞ্চ, ডাচ - ইউরোপীয় প্রভাব। কলকাতায় বম্বের পরে অনেক বেশি পার্সি জাতির বাস। হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, শিখ,পার্সি - অনেক ধর্ম আর প্রত্যেকে সেখানে প্রভাব বিস্তার করে। সকল খাদ্য সংস্কৃতির মিশেলে রূপ পেল এক নতুন খাদ্য সংস্কৃতি। এর সাথে আরো যুক্ত হয়ে নবাব ও জমিদারদের রন্ধন শালার রান্নার নিত্যে নতুন গবেষণা।
বাংলাদেশে শুভজিৎ এসেছেন চারবার, গিয়েছেন ঢাকা, মাওয়া আর নারায়ণগঞ্জে। তার সবচেয়ে বেশি চোখ কেড়েছে এখানকার স্মার্ট সাজ পোশাক পরা তরুণ তরুণীর ভাতের হোটেলে গিয়ে ভাত খাওয়া। তিনি জানালেন এমনটা তিনি আর কোথাও দেখেননি। বাংলাদেশের বাঙালিরা ভাতের প্রতি সেই অদ্ভুত টান ধরে রেখেছে, যার দেখে তিনি মুগ্ধ। দৃশ্যটি তার দেখা মাওয়ার ফেরিঘাটে।
নিজের প্রিয় পদটি হলো ইলিশ। সে গঙ্গার হোক, পদ্মার হোক,কোনো বাছাবাছি নেই। তারপরে যদি তা হয় শুধু বেগুন দিয়ে কালজিরে কাঁচা লঙ্কার সহিত তেল ঝোল। বাংলাদেশে বেড়াতে এসে অনেক বন্ধু পেয়েছেন আর এখানকার আতিথেয়তা এককথায় তার কাছে অতুলনীয়।
এপার বাংলা আর ওপার বাংলা রান্না যেন একই মায়ের দুই মেয়ের দুরকম রান্নার মতো। সব মিল তবুও স্বাদে একটুখানি উনিশ-বিশ। বাংলাদেশে রান্নায় ঝাল বেশি খায়, সাথে পেঁয়াজ রসুনের ছোঁয়াচ বেশি। ওপারের দিকে আদার আদর বেশি। সাথে টক-মিষ্টির কৃষ্টি। রান্নায় পড়ে পোস্ত আর চিনি। বাংলাদেশে মাছ জনপ্রিয় মেখে ভাপিয়ে আর ওপারে ভেজেই তবে রান্না। বাংলাদেশের রান্নায় খাটে নবাবী প্রভাব আর ওখানে বয় উত্তর ভারতীয় হাওয়া।
কলকাতাতে কখনো হয় না কাচ্চি বিরিয়ানী। সেইখানের বিরিয়ানীতে মেটিয়াবুরুজের খুশবু আর টিপু সুলতানের বংশধরের কাছ থেকে বয়ে আনা দক্ষিণ ভারতীয় বোল-চাল। আর চট্টগ্রাম অঞ্চলের রান্নার আছে একান্ত নিজস্ব ধরন যার অনেক খানি মিলেছে সেখানে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীদের খাদ্য প্রস্তুত প্রণালী থেকে।
এতো এতো ঐতিহ্যের রান্নাগুলি আমরা কেনো হারিয়ে ফেলছি এর উত্তরে শুভজিৎ ভট্টাচার্য বলেন, "আজকাল লোকে বলে হাতে ওতো সময় নেই। এসব জিনিস পাবো কোথায়? কিন্তু আসলে এটা প্রকৃত কারন নয়। এমন বহু রান্না আছে যা খুব সহজ। যেমন, বিক্রমপুরী কোর্মা এর চেয়ে সহজ আর হয় না।"
এসব রান্না হারিয়ে যাবার কারণ কেউ খোঁজেনি। শিখতে চায়নি। এই জিনিসটি যে সে জানছে জানছে না তাকেও একটা কৃতিত্ব ভাবতে শুরু করা। অথচ সেই লোকই অন্য শিল্প কর্ম নিয়ে খুব মাতামাতি। রান্নাকে শিল্প পর্যায়ে গুরুত্ব দেয়া হয় না। অথচ রান্না এমন এক শিল্প মাধ্যম যাতে আছে পঞ্চ ইন্দ্রিয়য়ের ব্যবহার। আমরা চোখ দেখি, হাতে মাখি, নাকে নিই ঘ্রাণ। কান দিয়ে শুনি রান্নার ফুটে ওঠার আওয়াজ আর নিই জিভে আস্বাদ। এমন মিশেল আর কোনো শিল্পে নেই, কিন্তু এই যন্ত্র সভ্যতায় সেটা আজ ভুলতে বসেছে লোক।
শখের রাঁধুনি শুভজিৎ পুরানো কোনো রান্নার হদিস পেলে তার পেছনে হন্যে হয়ে ছোটেন। বর্তমানে তিনি চিরুনি খোঁজা খুঁজছেন এমন কিছু রান্না - বিটের সানাধ, বাঁধাকপির বুক ধড়ফরি, কুমড়োর হুসেন শাহ আর ফুলকপির মিটি মুখ।
রন্ধনশিল্পী শুভজিৎ জানিয়েছেন তার এই চ্যানেলটি বাংলাদেশ থেকে খুব ভালো সাড়া পেয়েছে। তার মতে বাংলাদেশ খুবই অতিথি পরায়ণ। মন্তব্যে অনেকেই তাকে নিজের বাড়িতে নেমন্তন্ন করেছে খেয়ে যেতে, বলছে আপনার সাথে দেখা হলে বেশ লাগবে। তাই এইদিক নিয়ে তিনি ভীষন আশাবাদী যে লস্ট এণ্ড রেয়ার রেসিপি আরো মানুষের দুয়ারে পৌঁছবে।
যদি পুরানো রান্নার অমৃত সায়রে ডুব দিতে ইচ্ছে হয়, তবে ঘুরে আসা যায় এই ইউটিউব চ্যানেলটি হতে। পাঠককে একটা কথা দেয়াই যায়- ঠকা হবে না মোটেই।
সুস্মিতা রায় বর্তমানে শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিকেল কলেজে ৪র্থ বর্ষে পড়াশোনা করছেন।