আজ প্রখ্যাত শিল্পী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় প্রয়াণ দিবস। তিনি বাংলার এমন এক নক্ষত্র যার কখনো পতন হতে পারে না। আজ পৃথিবী হতে বহু দূরে থেকেও তিনি জাজ্বল্যমান। স্মৃতিচারণে রইল তার উদয়ের গল্প।
বাংলার চলচ্চিত্র জগতের রাজাধিরাজ হলেন সত্যজিৎ রায়। তার পরিচালিত সিনেমাগুলো নিয়ে তিনি যে বিস্তর গবেষণা করেছেন তা আজ অব্দি কেউই সেভাবে করে উঠতে পারেনি। প্রতিটা চরিত্রকে জীবন্ত করতে একেবারে খুঁজে খুঁজে লোক নিয়ে আসতেন। পথের পাঁচালির বিরাট সাফল্যের পরে ১৯৫৬ তে ভাবলেন তিনি এবার কিশোর অপুকে আনবেন দর্শকদের সামনে। নতুন ছবি হবে - 'অপরাজিত'। তবে কাকে যে অপু করবেন সেই নিয়ে ব্যস্ত হলেন।
এবার তার সহকারী নিত্যানন্দ দত্ত সদ্য কলেজ পাশ করা এক কুড়ি বছর বয়সী তরুণকে নিয়ে এলেন। সত্যজিতের সাথে তার দেখা হলো লেক এভিনিউতে। তরুণের চোখে মুখে যেন দেবোপম আভা। নায়ক হবার জন্যে সে নিঃসন্দেহে উপযুক্ত। জহুরীর যেমন হীরে চিনতে ভুল হয় না, তেমনি মানিক বাবু খুঁজে পেলেন আরেক মানিক! কল্পনায় তাকে ফ্রেমবন্দি করে নেন। সবই ঠিকঠাক, তবুও কিশোর অপু হিসেবে এর বয়েস একটু বেশিই। শেষকালে মানিকবাবু বলে বসলেন, "ওহো! আপনি যে বড় লম্বা হয়ে গেলেন!" সেবারটায় অপু হলো অন্য কেউ।
তবুও সেদিনের এটুকু আলাপে মানিকবাবুকে খুব ভালো লাগে তরুণটির। তিনিই হয়ে যান তার প্রিয় পরিচালক। প্রায়ই দেখতে যেতেন তার সিনেমার শুটিং। একদিন 'জলসা ঘর' এর সেটে শুটিং দেখতে দেখতে কাজের সময় হয়ে এলো। গেলেন বিদায় নিতে মানিকবাবুর কাছে। পাশেই ছিলেন সে ছবির 'বিশ্বম্ভর রায়ের' চরিত্র করা ছবি বিশ্বাস। সত্যজিৎ ওনাকে ডেকে বললেন, "ছবি দা, এই হচ্ছে আমার অপুর সংসারের অপু!"
তরুণ হতভম্ব। নাটকীয়ভাবে প্রথম জানলেন তিনিই হচ্ছেন সত্যজিতের অপু, 'অপু ট্রিলজির' শেষ ভাগ অপুর সংসারে।
এইবারে সহজেই অনুমেয় কাকে নিয়ে হচ্ছিলো কথা। সেই তরুণ হলো নদীয়ার মানুষের ভালোবাসার পুলু আর সকলের চিরচেনা নক্ষত্র সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। চলচ্চিত্রের জগতে যার পা ফেলা মহারাজের হাত ধরে।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় শুধু মাত্র অভিনেতা নন। তিনি বহুমুখী প্রতিভার স্রোত। যেখানেই পা ফেলেছেন তাকে ধন্য করেছেন আপন উষ্মায়। অভিনয়ের পাশাপাশি দরাজ কণ্ঠে শ্রোতাদের কাছে জীবন্ত করেছেন কবিতাদের। নিজে নাটক লিখে আবার সেটি নির্দেশনা দিতেন। শুধু যে আবৃত্তি করতেন তা নয়, নিজেও লিখতেন কবিতা।
পুলুর শেকড় বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার কুমারখালীস্থ কয়া গ্রামে। লোকে চাটুজ্জে বাড়ি বলে একনামে চিনত। তবে জন্ম আর শৈশবকাল কাটে নদীয়ার কৃষ্ণনগরে। এরপরে সবটাই কলকাতায়।
সৌমিত্রের বাবা মোহিত চট্টোপাধ্যায় ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের নাম করা উকিল। সৌমিত্রের অনুপ্রেরণার উৎস বাবা। ওকালতি করলেও বাবার ভীষন ঝোঁক ছিল অভিনয়ে। তিনি মঞ্চে অভিনয় করতেন। বালক সৌমিত্র মুগ্ধ দৃষ্টিতে বাবা দেখে যেতো- কী সুন্দর করে বাবা সংলাপ বলে অভিনয় করে। কী স্পষ্ট বাবার আবৃত্তির উচ্চারণ। চোখে তার স্বপ্ন বোনা শুরু হয়।
কলেজ জীবনের শেষ বর্ষে একদিন দেখতে যান প্রখ্যাত নাট্য ব্যক্তিত্ব শিশির ভাদুড়ির নাটক। তারপর থেকে মনস্থির করেন এবার হবে মঞ্চনাটক। জুড়ে যান থিয়েটারের সাথে। আর ওস্তাদ হিসেবে পেয়ে যান আরেক প্রথিতযশা অহীন্দ্র চৌধুরীকে। এদের নির্দেশনায় অভিনয় জগতে পাকাপাকিভাবে পথ চলা শুরু।
এরপরে গন্তব্যটা ঠিক হয়ে যায়। কর্মজীবনের শুরুটা হয়েছিল আকাশবাণীতে ঘোষক হয়ে। তার অম্লান কন্ঠস্বর অল্পদিনেই তাকে জনপ্রিয় করে ফেলেছিল। তবুও অভিনয়কে ধ্যান-জ্ঞান করে ফেলেন একেবারে। নাটকের লোকেদের হরহামেশাই ডাক পড়ে বড় পর্দায়। সৌমিত্র এমনি পেয়েছিলেন। কার্তিক চট্টোপাধ্যায়ের 'নীলাচলে মহাপ্রভু'তে। সেই কুড়িতেই দিয়েছিলেন স্ক্রিন টেস্ট। সেবারটাও আর আলো দেখা হয়নি। তিনি মহাপ্রভু হয়ে বাঙালিকে প্রেমভক্তির সায়রে ভাসাতে পারেননি ঠিকই কিন্তু মানিক বাবুর 'অপুর সংসার' দিয়ে বাঙালির মনে পোক্ত আসন পেতে নিয়েছিলেন। তিনি যেন জাতশিল্পী। ১৯৫৮ এর ৯ই আগস্ট প্রথমবার লাইট-ক্যামেরা-একশনের ভুবনে আসা। প্রথম দৃশ্যে অপু চাকরি খুঁজতে মেশিন ফ্যাক্টরিতে যাবে। মাত্র একটা টেকেই সেই দৃশ্য একদম ফিটফাট। বেশ সাবলীল বাচনভঙ্গি। একেই বলে বুঝি অভিনেতা। একে নিয়ে সত্যজিতের কখনোই অতিরিক্ত খবরদারি করতে হয়নি।
জীবনের প্রথম ছায়াছবিতেই একেবারে বাজিমাত। কে বলবে এই ছোকরার প্রথম অভিনয়! অপূর্ব কুমার রায়ের সংগ্রামী জীবন,খুলনায় বেড়াতে গিয়ে আচমকা বিয়ে, কিশোরী পত্নীর সাথে মিষ্টি খুনসুটি,তারপরে হঠাৎই সেই সুখের সংসারে উল্কা পতন, দিকশূণ্যপুরের দিকে অপুর যাত্রা- সব যেন ছত্রে ছত্রে সাজানো আর সেই জীবনবোধ সৌমিত্র নিজের মাঝে কী সুনিপুণভাবে গেঁথে নিয়েছেন। মনে হয়, অপু যেন সে নিজেই। সত্যজিৎ একদম ঠিক লোককেই বেছে নিয়েছেন।
অভিনয় নিয়ে একদিন সৌমিত্র বাবু নিজেই বলেছিলেন," সেই শৈশবকাল থেকে অভিনয় ছাড়া আমি অন্যকিছু ভাবিনি। অভিনয়টা সবসময় বুকের মধ্যে লালন করতাম। অন্য যা কিছু করেছি সবই ছিল ভালো লাগার বহিঃপ্রকাশ। "তার একখানি আশ্চর্য সত্ত্বা ছিল, সেটা হলো পুরো স্ক্রিপ্ট না পড়ে তিনি কখনোই সই করতেন না, যেটি সত্যজিতের ছবির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য ছিল।
সৌমিত্র নামের নক্ষত্র সত্যজিতের আকাশেই সবচেয়ে বেশি আলো ছড়িয়েছেন। চারুলতার অমল, হীরক রাজার উদয়ন পন্ডিত, সোনার কেল্লার ফেলু মিত্তির,ঘরে বাইরের সন্দীপ, অশনি সংকেতের গঙ্গাচরণ চক্রবর্তীকে চিরকাল মনে রাখবে বাঙালি। এখনো পর্যন্ত যে কোনো বাঙালির কাছেই তিনিই সবচাইতে 'প্রিয় ফেলুদা'। সোনার কেল্লার মুক্তির পরে সত্যজিৎ খুশি হয়ে বলেছিলেন ওর চেয়ে কেউ আর এই চরিত্রে ভালো অভিনয় করতে পারতো না।
সুস্মিতা রায় বর্তমানে শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিকেল কলেজে ৪র্থ বর্ষে পড়াশোনা করছেন।