"অতীতের তীর হতে যে রাত্রে বহিবে দীর্ঘশ্বাস,
ঝরা বকুলের কান্না ব্যাথিবে আকাশ,
সেইক্ষণে খুঁজে দেখো, কিছু মোর পিছে রহিল সে
তোমার প্রাণের প্রাণে, বিস্মৃতি প্রদোষে
হয়তো দিবে সে জ্যোতি,
হয়তো ধরিবে কভু নামহারা স্বপ্নে মুরতি।
তবু সে তো স্বপ্ন নয়,
সব চেয়ে সত্য মোর সেই মৃত্যুঞ্জয় –
সে আমার প্রেম।"
— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর অনুভূতি প্রেম। এ শুধু সুন্দর নয়, সুন্দরতম। আত্মার অনুভব, আত্মার উপাসনা। এই সুধারসের ছোঁয়া যাকে ছুঁয়েছে, সে হয়ত নিজেকে অন্তহীন করে বিলিয়ে দিতে পারে। এই প্রেম হাসায়, এই প্রেম কাঁদায়। কারোর হয়ে ওঠে গলার হার, আবার কারো দীর্ঘদিনের না শুকানো পুরাতন ঘা, যেই বেদনা মুছিয়ে দেয়া যায় না কোনো কিছুতেই।
প্রেমে সকলের প্রার্থনা পূর্ণতা। কিন্তু পূর্ণতার প্রেম হতে বিরহের ব্যাকুলতা বেশিই আবেদনময়ী। বিরহের মধুরতা এক অন্য ঘোরে আচ্ছন্ন করে রাখে। কখনো তা পায় অমৃতের কুম্ভ। যেমনটি পেয়েছে মির্চা এলিয়াদ তার অমৃতা মৈত্রেয়ীকে পেয়ে। বিরহ তাদের করেছে শতাব্দীর অমর প্রেমিক। জীবদ্দশায় হয়তো সুদূর রোমানিয়ার মির্চা কিংবা বঙ্গবালা মৈত্রেয়ী কোনোদিন ভাবেননি তাদের প্রেমের দীপশিখা প্রজন্মের পরে প্রজন্মে জ্বলে থাকবে।
দুই লেখকের যুগলবন্দি
প্রেমের অতৃপ্ত তিয়াস বিয়াল্লিশ বছরের কাঁটা ছড়ানো পথ ডিঙিয়ে ষাটছুঁই মৈত্রেয়ীকে ছুটিয়েছে বহু দূর। পাড় করিয়েছে সাত সাগর তের নদী। শেষে ঠেকলো এসে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের আলো ছায়া ঘেরা এক পাঠাগারে। বইয়ের তাকে মুখ ফেরানো এক বৃদ্ধকে ডাকছে সে, যেনো সেদিন অন্তরের সকল আর্তনাদ বেরিয়ে এসেছিল, "মির্চা মির্চা একবার ফেরো, দেখো আমি এসেছি।" বৃদ্ধ ফেরে না, মৈত্রেয়ী কাছে যায় আরো। সেদিন তারুণ্যের মির্চাকে সে পেয়েছিল জরাগ্রস্থ অন্ধ রূপে। সময় তাদের মাঝে দেয়াল তুললেও প্রেমকে রেখেছিল সজীব।
এই প্রেম পুষ্পিত হয়েছিল ১৯৩০ - এর কলকাতাতে। সংস্কৃতের অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের এক বাড়ি ভবানিপুরে। তার ছাত্র হয়ে বাড়িতে পা পড়ে রোমানিয়া থেকে আগত যুবক মির্চা এলিয়াদের। কলকাতায় জীবনবৃত্তির উপযুক্ত ব্যবস্থার অভাবে সুরেন্দ্রনাথেরই কল্যাণে তার এই ঠাঁই হয়।
বাড়ির বড় মেয়ে মৈত্রেয়ী। উজ্জ্বল শ্যামলা, ঘন কালো কেশে সে যেন মৃন্ময়ী কোনো দেবী। তার উচ্ছ্বলতার সৌরভ যেন সারা বাড়ি ঘুরে মির্চার ঘরেই বেশি আসতো।
মৈত্রেয়ীর ছিল জানার অগাধ স্পৃহা। বাবার সুবাদে বাড়িতে ছিল অনেক গণ্য মান্য লোকের ওঠাবসা। মাত্র ষোলতেই তার বিচক্ষণতা যেন দার্শনিকতার ঝলকানি দিতো, যা মির্চাকে জাদুর মতন আকৃষ্ট করতো। সুরেন্দ্র বাবুর আদেশে মৈত্রেয়ীর রোমান ভাষার পাঠ শেখা শুরু হয় মির্চার কাছে, আর মির্চার বাংলা শেখা মৈত্রেয়ীর কাছে।
বাড়িতে আসা নানা সাহিত্যিক অতিথিদের সাথে চঞ্চলা কিশোরীর ছিল নানা বিষয়ে আলাপ। হাসি-ঠাট্টার আসর চলত।
মৈত্রেয়ী রবীন্দ্রনাথকে গুরু মানতেন। শ্রদ্ধা করতেন ও ভালোবাসতেন। মাঝেমাঝেই শান্তিনিকেতনে দেখা করতে যেতেন। কিন্তু এই ভালোবাসাটুকুনও মির্চার সহ্য হতো না। সে রবি ঠাকুরকেও নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতো।
রোজ বাড়ির পড়ার ঘরে দুজনের একবার হলেও দেখা হতো। এটা ওটা নিয়ে খুনসুটি, ধীরে ধীরে অন্তরঙ্গতা বাড়তে থাকলো, অন্দরমহলে মির্চার হলো অবাধ যাতায়াত। আলো আঁধারীর খেলায় মিশে যেতো দুটি হৃদয়। এরপর তো একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়াও হত।
সুরেন্দ্রনাথ মির্চাকে ছেলের মতন দেখতেন। তাই কিছু বাধ সাধেননি। কিন্তু মির্চা-মৈত্রেয়ীর প্রগাঢ়তা পরিবারের অগোচরেই বেড়ে উঠলো।
কিন্তু মৈত্রেয়ীর কিশোরী ছোট বোন চিত্রিতা তাদের ঘনিষ্টতায় অসঙ্গতি খুঁজে পায়। সে ব্যাপারগুলি মেনে নিতে পারছিল না। তার কিশোরী মন তাকে বোঝাচ্ছিল, সবাই দিদিকে ভালোবাসে তাকে কেউ ভালোবাসে না, সে দেখতে দিদির মতোন সুন্দর না। সে মির্চা মৈত্রেয়ীর কাছে আসার কথা মাকে জানিয়ে দেয়।
মির্চা মৈত্রেয়ীর মাঝে চিরতরে প্রাচীর তুলে দেন সামাজিক বাঁধায় বন্দি সংস্কৃতের অধ্যাপক। মির্চাকে ঘর ছাড়া করেন। মৈত্রেয়ীর বিয়ে দেন বিজ্ঞানী মনমোহন সেনের সঙ্গে। মৈত্রেয়ীর মন ভেঙে গিয়েছিল, শান্তির সন্ধানে বারে বারে ছুটে যেতেন রবি বাবুর কাছে। একসময়ে চির শান্ত হয়ে যান।
মির্চার জীবনটা যেন তখন সন্ন্যাসীর মতো হয়ে উঠেছিল। তার প্রেম তাকে যোগী করেছে। সে হয়ে গিয়েছিল পরিব্রাজক, ঝোলায় ভরেছিল জ্ঞান, বেরিয়েছিল ভারতাত্মার সন্ধানে। ভারতের নানা অঞ্চল ঘুরে ফিরে গিয়েছিল দেশে উদাসীর বেশে। জীবনে দুইবার বিয়ের গাঁটছড়া বেঁধেছেন, কিন্তু কোথাও থিতু হতে পারেননি। বিদ্যা সাধনায় মির্চার বাকি জীবন কেটে যায়। বিশ্বধর্ম নিয়ে অধ্যাপনা করে যান জীবনভর।
ইউরোপে বেড়াতে এসে ষাটছুঁই বৃদ্ধার মন আবারো উচাটন করেছিল, ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল ভবানিপুরের দিনগুলোতে। রোমান ভাষায় লেখা 'মৈত্রেয়ী' নামের একটা বই। বইয়ের লেখক মির্চা এলিয়াদ। এক চেনা ইউরোপীয় বন্ধু জানালো, "তোমাকে তো আমার দেশের সবাই জানে, দেবীর চোখে দেখে তোমায়, মৈত্রেয়ী।" শুনে মৈত্রেয়ীর চোখ কপালে উঠলো। ব্যাকুল করলো তিন সন্তানের জননীকে সেই রোমানিয়ার যুবককে আবার খুঁজে পেতে। স্বামীর অনুমতি নিয়েই জীবন সায়াহ্নে মৈত্রেয়ী ছুটে গেছিলেন প্রেমিকের কাছে। জবাব চাইতে, কেন তার বই শুধু শারীরিক ভালোবাসাকে বড় করলো?
মির্চার উত্তর ছিল, ‘তোমাকে হারিয়ে আমার জীবন শুকিয়ে এসেছিল। আমায় বাঁচিয়ে রেখেছিল কল্পনা, আর সেটাই ওই বই। শোনো মৈত্রেয়ী আমি তোমাকে নয়, ছুঁতে চেয়েছিলাম তোমার আত্মাকে।’
মৈত্রেয়ী যেন কোথাও বড় আঘাত পেয়েছিলেন। মির্চার বইয়ের জবাবে পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালে মৈত্রেয়ী দেবী লিখেছিলেন 'ন হন্যতে' বইটি। হারানো প্রেমের ব্যথা তার ঝুলিতে তুলেছিল সাহিত্য আকাদেমির পুরস্কার। মির্চার লেখা 'মৈত্রেয়ী' বইটি পরে ফ্রেঞ্চ ভাষায় অনূদিত হয়ে নাম নিয়েছিল 'লা নুই বেঙ্গলি'। দুইটি বই একাধিক ভাষায় অনুবাদ হয়ে বিশ্বের নানা প্রান্তের পাঠকের হৃদয় ছুঁয়েছে। ১৯৮৮ সালে পরিচালক নিকোলাস ফ্রেঞ্চ ভাষায় 'দ্য বেঙ্গলি নাইট' নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন যাতে মৈত্রেয়ীর ভূমিকায় ছিলেন ভারতের জনপ্রিয় অভিনেত্রী সুপ্রিয়া পাঠক আর সুরেন্দ্রনাথের ভূমিকায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
সুস্মিতা রায় বর্তমানে শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিকেল কলেজে ৪র্থ বর্ষে পড়াশোনা করছেন।