মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রগুলোর মনে দাগ কাটা কিছু দৃশ্য


মাহমুদ নেওয়াজ জয় | Published: December 21, 2022 15:32:40 | Updated: December 21, 2022 19:30:56


আটটি চলচ্চিত্রের ক্রমানুযায়ী পোস্টার কোলাজ, ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস ও বিএমডিবি

মহান মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে নির্মিত হয়েছে বেশ কিছু চলচ্চিত্র। এই সিনেমাগুলোয় যুদ্ধকালীন ভয়াবহতা যেমন দেখানো হয়েছে, তেমনি রয়েছে এমন কিছু দৃশ্য যা হৃদয়ে রয়ে যেতে পারে চিরদিনের মতো।

অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী (১৯৭২)

'তুমি একটা কাপুরুষ। তুমি দেশের জনপ্রিয় অভিনেতা, আনোয়ার হোসেন; প্রাণভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছো৷ শুধু চরিত্রে রূপ দিতে পারো, বাস্তবে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারো না৷ লান্ছিতা নারীর লান্ছনার প্রতিবাদে রুখে দাঁড়াতে পারোনা।'

সুভাষ দত্ত পরিচালিত অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী (১৯৭২) সিনেমার এই দৃশ্যে ক্লোজ শটে দেখানো হয় অভিনেতা আনোয়ার হোসেনের মুখ। সিনেমাটিতে সনামেই অভিনয় করেন তিনি। নামী অভিনেতা আনোয়ার হোসেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে না পারায় মানসিক অন্তর্ঘাতে ভুগতে থাকেন। তখন তার মুখ দেখানো হয় ক্লোজ শটে৷ নেপথ্যে শোনা যায় তারই কণ্ঠ। তার নিজ সত্ত্বা তাকে বলতে থাকে কথাগুলো। লাঞ্চিতা নারীর ওই জায়গায় ক্লোজ শটে দেখা যায় অভিনেত্রী ববিতার মুখ।

শেষে আনোয়ার হোসেন তার গ্লানি কমাতে নির্যাতিতা মেয়েটিকে (ববিতা) বিয়ে করেন। নির্যাতনের ফলে তার গর্ভে আসা শিশু সমেত। এই দৃশ্যটিও দর্শকের মনোজগত নাড়িয়ে যায়।

ওরা ১১ জন (১৯৭২)

চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত এই সিনেমার একেবারে শেষদিকের দৃশ্য। ফল ইন ক্লাইম্যাক্স। মুক্তিযোদ্ধা খসরু ফিরছেন যুদ্ধ জয় করে। তিনি এসেছেন একটা ক্যাম্পে। আটকে পড়া নারীরা সেখান থেকে বের হচ্ছেন। সেখানে তার সাথে আবারো দেখা হলো অভিনেত্রী নতুনের। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে গান 'এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা/ আমরা তোমাদের ভুলব না।'

ভালোবাসার মানুষকে দেখে নতুনের মুখে ফুটে ওঠা হাসি, তারপর ক্লোজ শটে সেই হাসি কিছুক্ষণ স্থায়ী হওয়া; এরপর মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া। লং শটে খসরুর দৌড়ে এসে তাকে ধরে ফেলা।

বহুদিন পর তাদের দেখা হয়। কিন্তু শেষবারের মতো। নতুন মারা যান, ক্লোজ শটে খসরুর চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে দেখি আমরা। পেছনে বাজছে- 'আমরা তোমাদের ভুলব না, ভুলব না।'

প্রিয়তমার জীবনের বিনিময়ে প্রিয় দেশকে পেয়েছেন এমন অনেকেই। দৃশ্যটা সবমিলিয়ে হয়ে উঠেছে অনন্য।

একাত্তরের যীশু (১৯৯৩)

হুমায়ূন ফরীদি এখানে অভিনয় করেছিলেন একজন গীর্জার রক্ষণাবেক্ষণ কর্মীর চরিত্রে। নাম ডেসমন্ড। এই মানুষটি মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেন, খাবার দেন। তারা যুদ্ধে যায় ও ধরা পড়ে।

শাহরিয়ার কবিরের উপন্যাস অবলম্বনে নাসির উদ্দিন ইউসুফ পরিচালিত এই ছবির ক্লাইম্যাক্সে যখন তাদের ধরে এনে ফরীদিকে বলা হয় এদের কাউকে তিনি চেনেন কিনা, তিনি প্রতিবার বলতে বাধ্য হন, 'না।'

তার একেকবার একেকরকম করে না বলা ও বিহ্বল দৃষ্টি দর্শকহৃদয়ে অন্তর্দহন তৈরি করে।

অনুতপ্ত ফরীদি তথা ডেসমন্ড যখন ক্রুশের সামনে বসে মাথা নোয়ান, তীব্র অনুশোচনায় দগ্ধ হন, সে সময় আপ লেভেল থেকে ধরা ক্যামেরায় কানে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে হাঁটু মুড়ে বসে থাকা ডেসমন্ডের অনুতাপ ও অসহায়ত্ব মূর্ত হয়ে ওঠে।

আবার একেবারে শেষ দিকে লং শটে বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে মিড ক্লোজশটে ফরীদির যে আশাবাদী মুখ- তাও এই সিনেমার অন্যতম হৃদয়গ্রাহী দৃশ্য।

আগুনের পরশমণি (১৯৯৪)

হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসটির চলচ্চিত্ররূপ দিয়েছিলেন তিনি নিজেই।

সিনেমায় ক্লাইম্যাক্সের কিছুটা আগে শীলা আহমেদের হাতে ধরা চিঠিটি পড়ে শোনানোর দৃশ্য কিংবা ক্লাইম্যাক্সে আবুল হায়াত ও আসাদুজ্জামান নূরের কথোপকথনের দৃশ্যগুলো অবিস্মরণীয়।

'ভাইয়া তোমার মতো ভালো মানুষ এ পৃথিবীতে জন্মায়নি, আর কোনোদিন জন্মাবেও না।'

শীলা যখন নূরকে (চরিত্রের নাম বদরুল আলম) চিঠিটি পড়ে শুনিয়ে কাঁদতে থাকেন, তখন লংশটে আমরা তার চোখ মুছিয়ে দিতে দেখি নূরকে। এরপর ক্লোজশটে নূর তাকে বলেন, 'কাঁদছ কেন? বোকা মেয়ে।'

অপরিসীম স্নেহমাখা এই দৃশ্যটি সিনেমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ দৃশ্য।

এছাড়া, ক্লাইম্যাক্সে আহত মুক্তিযোদ্ধা নূরের বলা 'ভোর কি হবে?' এর উত্তরে এক্সট্রিম ক্লোজ শটে আবুল হায়াত যখন বলেন, 'অবশ্যই হবে।'

তখন তার কণ্ঠের দৃঢ়তা দৃশ্যটিকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়। সংকটকালেও আশার বার্তা নিয়ে আসে।

হাঙর নদী গ্রেনেড (১৯৯৭)

এই সিনেমার ক্লাইম্যাক্স এর মতো মর্মান্তিক দৃশ্য বাংলা সিনেমার ইতিহাসেই হয়তো বিরল। সেলিনা হোসেনের উপন্যাস থেকে সিনেমাটি নির্মাণ করেছিলেন চাষী নজরুল ইসলাম।

লংশটে দৌড়ে আসছে পাকিস্তানি হানাদাররা। ক্লোজশটে দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা। 'চাচি দরজা খোলো।'

ক্লোজশটে সন্ত্রস্ত সুচরিতার প্রশ্ন, 'হাফিজ না?'

এরপর দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে চালের ড্রামে লুকিয়ে রেখে নিজের বাকপ্রতিবন্ধী ছেলের হাতে অস্ত্র তুলে দেন মা। মা-র চোখের সামনে তার একমাত্র সন্তানকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদাররা।

এভাবে অন্য দুজন মুক্তিযোদ্ধাও এই মা-র কাছে নিজ সন্তানই হয়ে ওঠে। তাদের জন্য গর্ভে ধারণ করা সন্তানকে তিনি চিরতরে উৎসর্গ করেন। এভাবে এই দৃশ্য যে অভিঘাত তৈরি করে, তা এর মার আত্মত্যাগকে সার্বজনীন করে তোলে।

জয়যাত্রা (২০০৪)

আমজাদ হোসেনের গল্প অবলম্বনে তৌকীর আহমেদ পরিচালিত এই সিনেমায় একটি নৌকায় আশ্রয় নেন বিভিন্ন মানুষ, একেকজনের একেকরকম সংকট।

অসুস্থ সন্তানের মৃত্যুর পর সামান্য আলো থাকা ঘরে বিপাশা হায়াত যখন একদম নিরাশ কণ্ঠে দুর্বল অথচ পরিষ্কারভাবে বলছেন, 'দুনিয়ার মানুষরে জানায়া চিৎকার করে উঠবার পারিনা ক্যান?' - তখন মিডশটে নেয়া এই দৃশ্যে যুদ্ধকালীন অসহায়ত্ব ও শোকে স্থবির হয়ে পড়া পরিষ্কার হয়ে ওঠে।

আবার পঞ্চানন চরিত্রে থাকা হুমায়ূন ফরীদি যখন মাহফুজ আহমেদকে কোলকাতার সমাজের উপরতলা-নিচতলার মানুষদের কথা বলেন, আর বিশেষত যখন যুদ্ধের সময় হারিয়ে ফেলা মেয়ের পুতুল জড়িয়ে ধরে কাঁদেন; তখন ক্লোজ শটে বৃষ্টি আর তার চোখের জল একাকার হয়ে যায়৷ কোনো পার্থক্য থাকেনা৷ তখন এই মানুষটির শোক দর্শক হৃদয়কেও আর্দ্র করে তোলে।

শ্যামল ছায়া (২০০৬)

'একজন প্রকৃত মুসলমান কখনো জালিমের শাসনে থাকে না।' - মওলানারূপী রিয়াজ বলছিলেন হুমায়ূন ফরীদিকে।

এই দৃশ্যে মুক্তিযুদ্ধকে ইসলামের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর বিরুদ্ধে চমৎকার ম্যাসেজ দিয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ।

তার নিজের একই নামের উপন্যাস নিয়ে নিজেই সিনেমা বানিয়েছিলেন। এখানে, ফল ইন ক্লাইম্যাক্সে লং শট ও মিড শটে নেয়া নৌকার দৃশ্যগুলো আলাদাভাবে মনে দাগ কেটে যায়।


' পতাকা, সোনাবউ, সোনাবউ, আমাদের পতাকা দেখো।' - শাওনকে বলছেন স্বাধীন খসরু। গুলিবিদ্ধ শাওন তখন অন্তিম শয্যায় নৌকায় শুয়ে। এর আগে ফরীদির মুক্তিযোদ্ধা চরিত্র‍টি তার জন্য হাত তুলে দোয়া করে।

সে অবস্থাতেও মরণাপন্ন শাওনের মুখে আমরা হাসি দেখি। সেই হাসিতে কোনো আক্ষেপ নেই, কোনো হারানোর বেদনা নেই।

কিংবা আরেকটি নৌকায় অসুস্থ তানিয়া আহমেদ যখন বলছেন, 'আমাকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিন, বাবা।'

তার শ্বশুর চরিত্রে থাকা চ্যালেঞ্জারের বলা 'পতাকা, আমাদের পতাকা, বৌমা পতাকা দ্যাখো৷ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।' তারপর বাইনোকুলার দিয়ে পুত্রবধূকে পতাকা দেখানো।

দুই ক্ষেত্রেই নিজ নিজ কষ্ট, এমনকি সম্ভাব্য মৃত্যুর হাতছানি পেরিয়েও স্বাধীনতাপ্রাপ্তির আনন্দই বড় হয়ে ওঠে। পেছনে বাজতে থাকা মুক্তির মন্দির সোপানো তলে আমাদের স্মরণ করায় ত্রিশ লক্ষ মানুষের আত্মদানের কথা।

গেরিলা (২০১১)

'হি ইজ রাইট, আই এম হেয়ার।'

বাহ্যিকভাবে বিধ্বস্ত অথচ মানসিকভাবে বলীয়ান বিলকিস অর্থাৎ, জয়া আহসান বলছেন পাকসেনারূপী শতাব্দী ওয়াদুদকে।

এরপর অব্যাহত নির্যাতনের পর সিনেমার একেবারে শেষের দিকে যখন তার হাতে উঠে আসে বোমা তখন তার সেই মিড শটে তার সেই আত্মপ্রত্যয়ী মুখ ভোলা যায় না। তারপর একটা বিস্ফোরণ! নিজেকে সহ পুরো বাহিনীটাকেই শেষ করে দেন জয়া।

এখানে শতাব্দীর দেয়া গালি ও অন্যান্য কথাতে ইয়াহিয়ার সেই কুখ্যাত 'মানুষ চাই না, মাটি চাই' দৃষ্টিভঙ্গিই প্রতিফলিত হয়েছে।

সৈয়দ শামসুল হকের উপন্যাস 'নিষিদ্ধ লোবান' অবলম্বনে নাসিরউদ্দীন ইউসুফ পরিচালিত এই সিনেমায় এই দৃশ্যটি দর্শককে যেমন ধাক্কা দেয়, তেমনি বুঝিয়ে দেয় দেশের জন্য এমন অনেক বিলকিসরাই নিজেদের উৎসর্গ করেছেন নির্ভয়ে। তাদের জীবনের মতো অনেকগুলো জীবন যোগ হয়েই এনে দিয়েছে আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।


মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী।

mahmudnewaz939@gmail.com

Share if you like