এক নজরে দেখলে একটা সাধারণ ভাতের হোটেল। ভর্তা, ভাজি, নানা পদের তরকারি। তবু অন্যান্য ভাতের হোটেল থেকে মামা হোটেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-নীলক্ষেত এলাকায় একটু আলাদা। এক নামে সবাই চেনে। মামা হোটেলের এই মামা কে? আর কোন বিষয়টা এত বিশেষ করে তোলে এই রেস্তোরাঁটিকে? এমন সব খিদেপেটের প্রশ্ন নিয়ে এক বেলা ভাত খেতে যাওয়া হয়েছিল সেখানে।
ক্যাশ কাউন্টারে বসেন তাইজুল উদ্দিন ওরফে সাজু। কথা বলতে চাইলে মুচকি হেসে বড় ভাই আসলাম উদ্দিন রাজুর দিকে তাকান। বড় ভাইই সব কথা ভালো বলতে পারবেন, এমনটাই ভরসা। রাজুও বেশ আন্তরিকতার সাথে কথোপকথনে আগ্রহী হন। যার নামডাকে সুপরিচিত এই হোটেল, সেই ‘মামা’ ছিলেন তাদের বাবা কছিম উদ্দিন। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় খিচুড়ি বিক্রি করা থেকে তার শুরু। পরবর্তী সময়ে তিনি এখানে মামা হোটেলের পত্তন ঘটান। মূলত শিক্ষার্থীদের সবার ‘মামা’ ডাক থেকেই এ নাম। আগে যেখানে হোটেলের খাওয়াদাওয়া হতো– অর্থাৎ মামা হোটেলের ‘প্রথম শাখা’, বর্তমানে সেটি ব্যবহার করা হচ্ছে গুদামঘর হিসেবে। খাওয়ার জায়গাটা আগের চেয়ে সুবিস্তৃত করা হয়েছে। গুদামঘরের সাথেই রান্নাঘর। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে মা আসমা বেগমই বেশিরভাগ দায়িত্ব সামলান বলে জানা যায়। এমনকি প্রতিদিনের খুঁটিনাটি দিকনির্দেশনা দেয়া থেকে শুরু করে রান্নার মশলাপাতি তিনিই তৈরি করেন। বাবুর্চিরা তার নির্দেশমতো উনুনে রান্না চড়ায়।
মামা হোটেলে কেন এত মানুষ প্রতিদিন খেতে আসে আর এখানকার বিশেষত্ব কী, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হল ক্যান্টিনের একঘেয়ে খাবার খেতে খেতে ভার্সিটির স্টুডেন্টরা হাঁপিয়ে ওঠে। একটু ঘরোয়া পরিবেশে আরাম করে ভাত খেতেই ওরা এখানে আসে।’ তাহলে কি বেশিরভাগ খদ্দের এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই? একটু ভেবেচিন্তে তিনি জানান, ‘পাঁচ পার্সেন্টের বেশি বাইরের কাস্টমার নেই এখানে। আমাদের বেশিরভাগ কাস্টমারই এখানকার শিক্ষার্থীরা।’ নিয়মিত খদ্দেরদের প্রতি বেশ স্নেহময় মনোভাব কাজ করে তার বক্তব্যে। এজন্য হয়তো খাবারের প্লেট দু-তিনবার ‘রিফিল’ করা বা শেষমেশ বিল দশ-বিশ টাকা ‘অ্যাডজাস্ট’ করে নেয়া এখানকার নিত্যচিত্র।
এ হোটেলের নিয়মিত খাবারের পদে দুয়েকমাস আগেই যুক্ত হয়েছে খাসি ভুনা, গরুর কলিজা এবং কোয়েল পাখির মাংস। দামটাও নাকি খদ্দেরদের সাধ্যের মধ্যে রাখার চেষ্টা করেছেন তারা। সুলভ মূল্য শুধু নয়, সুস্বাদের দিকেও নজরটা কম নয় এ হোটেলে। যেকোনো বেলায় খেতে বসলেই স্বাভাবিক নিয়মে চলে আসে মাথা গুনে ভাতের প্লেট, সে বেলায় থাকা বিভিন্ন ভর্তা, সবজি আর ডাল। এর মধ্যে ঝাল ঝাল পেঁয়াজভর্তাটা যেন খিদেটাকে আরো চাগিয়ে তোলে। ওটা দিয়ে দুয়েক লোকমা ভাত মুখে দিলে রসনা সক্রিয় হয়, এবেলা পেটচুক্তি খাবার আসছে। প্রাথমিক এই পদগুলো দিয়ে খাওয়া শুরু করে আরামসে সিদ্ধান্ত নেয়া যায় ‘মেইন কোর্স’টা কী হবে। মূল পদের মাঝে এখানে বেশি জনপ্রিয় হচ্ছে হাঁসের মাংস, গরু বা খাসির মগজ এবং মুরগির ঝাল ফ্রাই। বেলা বারোটা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত খদ্দেরদের আনাগোনায় মুখর থাকে গাউসুল আজম মার্কেটের পেছনের এই দোতলা। সামনে আছে চায়ের দুয়েকটি স্টল। পেট ভরে খেয়ে ওখানে চায়ের আড্ডা জমাতে দেখা যায় অনেককেই। মামা হোটেল সবচেয়ে বেশি সক্রিয় থাকে দুপুরের গনগনে রোদেই। ক্লাস সেরে কিংবা ক্লাসের ফাঁকে একটু জিরোতে এবং ক্ষুধা নিবারণে চলে আসেন অনেকেই। বসার বেশ সুব্যবস্থা রয়েছে এখানে। বেশি বা কম মানুষের জন্য আলাদা আকৃতির টেবিল পাতা আছে। মামা হোটেলে খেতে যাবার সবচেয়ে ভালো বুদ্ধি হচ্ছে দল বেঁধে যাওয়া, তাহলে বিভিন্ন স্বাদের খাবার চাখা যাবে, বিলটাও আসবে নামেমাত্র। তবে সবসময় সব পদ পাওয়া যায় না এখানে। যেমন একটু বেশি রাত করে গেলেই আর খাসির মগজ জোটে না কপালে। প্রতিটি পদ সীমিত পরিমাণে রান্নাই এর কারণ।
খাবারের তালিকায় ভবিষ্যতে আরো কিছু নতুন পদ সংযোজনের ইচ্ছা আছে স্বত্বাধিকারীদের। পরিকল্পনা আছে আরো দুয়েকটি নতুন শাখায় মামা হোটেলকে এগিয়ে নেবারও। তবে এই এলাকা থেকে বেরোবার ইচ্ছা নেই তাদের। যাই করবেন, মামা হোটেলকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশে– যেমন চানখারপুল, বকশিবাজার, শাহবাগ, এসব সীমানাতেই রাখতে চান; কেননা তাদের মূল খদ্দের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই।
খাবারের শেষ পাতে কোনো মিষ্টি পদ রাখার ইচ্ছে আছে কি না জানতে চাইলে মিষ্টি হেসেই রাজু জানান যে আনলে চলবে ভালোই, কিন্তু আপাতত ওটা যোগ করা হচ্ছে না। অতঃপর তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে, ক্যাশ কাউন্টার থেকে এক মুঠো মশলা আর দুটো রংবেরঙের সুইটবল মুখে দিয়েই বেরিয়ে আসতে হয়।
অনিন্দিতা চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে সম্প্রতি মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। [email protected]