দুজনেই বেলা ফুরিয়ে যাওয়াদের দলে। নিজেদের তো বটেই, দুটি দেশের পাহাড়সমান প্রত্যাশার মহাভার কাঁধে নিয়ে কাতারে নোঙর ফেলেছিলেন তারা। ঝড়-ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে আর্জেন্টিনা-ক্রোয়েশিয়া যখন মুখোমুখি হলো সেমি-ফাইনালে, দুজনকে দাঁড়াতে হলো যেন ফায়ারিং স্কোয়াডে-ঝরে পড়তেই হবে একজনকে। লিওনেল মেসি নাকি লুকা মদ্রিচ, প্রশ্নের উত্তর মিলে গেল শেষ বাঁশি বাজতেই। বিশ্বকাপের আঙিনা থেকে ঝরে পড়া তারা হয়ে গেলেন মদ্রিচ।
শেষের বাঁশি মেসির কানে তুলল সুমধুর সুর, মদ্রিচের জন্য তা হয়ে উঠল বিষাদের রাগিনী। এবারের জন্য তো বটেই, হয়ত শেষবারের মতো! ৩৫ বছর বয়সী মেসির চেয়ে বছর দুয়েকের বড় মদ্রিচ। চার বছর পরের বিশ্বকাপে ক্রোয়াট এই মিডফিল্ডারের দেখা পাওয়া যে বড্ড কঠিন। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
বয়সের থাবা যে কতটা ভয়ঙ্কর, তার প্রমাণ তো ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো। সাফল্যের দুর্বার ক্ষুধা, প্রচন্ড মনোবল নিয়ে মরুদ্যানে এসেছিলেন পর্তুগিজ মহাতারকা। কিন্তু মনের জোর পায়ে অনুবাদ করা হয়নি ৩৭ বছর বয়সী রোনালদোর। আগের সেই গতি, ক্ষিপ্রতা হারিয়ে নিজেকে খুঁজে ফিরেছেন, মাথা কুটেছেন, কিন্তু দেখা পাননি সেরা ছন্দের। বরং ছায়া হয়ে থাকতে থাকতে একসময় মিলিয়ে গেলেন অন্ধকারে।
সেই একই দৃশ্যের মঞ্চায়নই যেন হলো লুসাইলের সেমি-ফাইনালে। মদ্রিচের পা যেন সরতে চায় না। অবশ হয়ে আসে। খালি হাতে ফেরার বেদনা ডুকরে ওঠে বুকের ভেতরে। অশ্রু হয়ে ঝরে, কিন্তু সান্ত্বনার ভাষা খুঁজে পাওয়া যায় না কোনোভাবেই।
মেসির চেয়ে এই বিশ্বকাপে তার শুরুটাও দারুণ। মেসির শুরু ‘পুঁচকে’ সৌদি আরবের কাছে হেরে। সেখানে কোয়ার্টার-ফাইনাল পর্যন্ত ক্রোয়েশিয়া অপরাজিত। প্রতি ম্যাচেই মাঝমাঠের সুর বেঁধে দিয়েছেন মদ্রিচ। কিন্তু এদিন পারলেন না। মাঝমাঠের লাগাম প্রায়ই ফসকে গেল মুঠো থেকে। প্রাণান্ত তা আকঁড়ে ধরার চেষ্টা করলেন রিয়াল মাদ্রিদ মিডফিল্ডার, কিন্তু পেরে উঠলেন না কোনোভাবে।
বিপরীতে মেসি যেন ফিরে পান তারুণ্য। গোল করলেন, করালেন। মুগ্ধতা ছড়ালেন বাঁ পায়ের নরম তুলির আচঁড়ে।
আর্জেন্টিনার হুলিয়ান আলভারেজ ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে দলের দ্বিতীয় গোল করার পর অধিনায়ক লিওনেল মেসির সাথে উদযাপন করছেন। ছবি — রয়টার্স
আর্জেন্টিনার চাওয়া তিনি মেটাচ্ছেন গ্রুপ পর্ব থেকে। সৌদি আরব ম্যাচের ধাক্কায় আলবিসেলেস্তাদের টালমাটাল তরি দিশা খুঁজে পায় মেক্সিকোর বিপক্ষে জয়ে। এরপর পোল্যান্ড বাধা পেরিয়ে মেসি-মার্তিনেসরাই গ্রুপসেরা দল।
এরপর একে একে অস্ট্রেলিয়া বাধা পেরিয়ে, নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে কোয়ার্টার-ফাইনালে হঠাৎ জমে ওঠো শঙ্কার মেঘ সরিয়ে সেরা চারের মঞ্চে আসা আর্জেন্টিনার। বয়সের ভারকে স্রেফ তুড়ি মেরে উড়িয়ে পুরোটা পথ আর্জেন্টিনাকে মেসি আগলে রেখেছেন। লুসাইলেও আগলে রাখলেন দারুণ নির্ভরতার ছায়া দিয়ে।
মাঠের লড়াই শুরুর আগ পর্যন্ত এই দুজনকে নিয়ে কত আলোচনা। গত বিশ্বকাপে মেসির আর্জেন্টিনাকে ৩-০ গোলে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল মদ্রিচের ক্রোয়েশিয়া, সে প্রতিশোধ পিএসজি ফরোয়ার্ড নিতে পারবেন তো? নাকি আবারও মদ্রিচ শো’য়ে আড়াল হয়ে যাবেন তিনি? উত্তরটা পরিষ্কার ম্যাচের স্কোরলাইনে; আর্জেন্টিনা ৩ ক্রোয়েশিয়া ০।
আসর জুড়ে দারুণ লড়াকু ফুটবল উপহার দেওয়া ক্রোয়েশিয়ার শেষটা তাই অনেকের কাছেই অপ্রত্যাশিত, বড্ড সাদামাটা।
এটা ঠিক যে, তারা ফেভারিট হয়ে বিশ্বকাপে পা রাখেনি। কিন্তু অনেক বাধা পেরিয়ে, বিশেষ করে কোয়ার্টার-ফাইনালে ব্রাজিলের মতো শক্তিশালী দলের বিপক্ষে দুর্দান্তভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প লিখে সেমি-ফাইনালে ওঠায় স্বপ্নের পরিধি তো বাড়বেই। তাছাড়া দলে যখন আছেন মদ্রিচের মতো একজন, মেসি-রোনালদো যুগের মাঝে ২০১৮ সালের বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কার জয়ী।
মদ্রিচের এমন শেষ তাই কাম্য নয়।
ক্রোয়াট যুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যে বেড়ে ওঠা, প্রিয়জনদের হারানোর শোক, হালকা-পাতলা গড়নের বলে ট্রায়ালে বাতিলের খাতায় পড়ে যাওয়া শৈশব, যাদার ও দিনামো জাগরেবের যুব দলে হাড়ভাঙা খাটুনির দিনগুলো, ধারে খেলে বেড়ানোর সময় পেরিয়ে টটেনহ্যাম হটস্পারে এবং বর্তমানে রিয়ালের আলো ঝলমলে দিনগুলোর স্মৃতি হয়ত বয়ে যাচ্ছে মদ্রিচের ভেতরে।
ক্রোয়েশিয়ার জার্সিতে কোনো ট্রফিতেই চুমু আঁকা হলো না মদ্রিচের। ২০১৮ সালে বিশ্বকাপের ফাইনাল সুবর্ণ সুযোগ হয়ে কড়া নেড়েছিল দরজায়, কিন্তু সাড়া দিতে পারেনি ক্রোয়াটরা। ফ্রান্সের কাছে হেরে রানার্সআপ হয় তারা, যদিও ফুটবলের ইতিহাসে এটাই তাদের সেরা সাফল্য। কিন্তু ট্রফিহীন ‘সাফল্যে’ তৃপ্তি কোথায়?
এবার প্রতিশোধের তীব্র তাড়না নিয়ে নামা আর্জেন্টিনার সামনে খড়কুটোর মতো উড়ে গেল ক্রোয়েশিয়া। ম্যাচ শেষে বিষণ্ণ মুখে সতীর্থ, প্রতিপক্ষ সবার সঙ্গে হাত মেলালেন, কিন্তু চাওয়া-পাওয়ার হিসেব মিলল না এবারও। হয়তো এই অপূর্ণতা আর পূরণ হওয়ার নয়।