গল্প-উপন্যাস, লোককথা এবং পপ কালচারের একটা বড় অংশ জুড়েই রয়েছে ভ্যাম্পায়ারদের গল্প এবং বিশ্বের নানা প্রান্তে মানুষদের কল্পনায় সেসব গল্পের ডাল-পালা বেড়েছেও অনেক। এই ভ্যাম্পায়ারের অতীত ইতিহাস পুরাণের গল্প খুঁজে বের করতে গেলে তা প্রাচীন সভ্যতা পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। তবে বর্তমানে ভ্যাম্পায়ারের যে রূপ লোকমুখে প্রচলিত এবং পরিচিত, সেই অতিলৌকিক জীব যারা বেঁচে থাকে অন্য জীবন্ত প্রাণীর রক্ত খেয়ে, এই ধারণাটি এসেছে পূর্ব ইউরোপ এবং বলকান অঞ্চল হতে।
ভ্যাম্পায়ারের এই ভিন্ন ভিন্ন রূপের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে বিভিন্ন অঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি। সেই সুদূর অতীতের মেসোপটেমিয়া, হিব্রু এমনকী প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সভ্যতা থেকেই রক্তখেকো ভ্যাম্পায়ারের উপস্থিতি পাওয়া যায় ভিন্ন ভিন্ন নামে। মেসোপটেমিয়ার “লামাশতু” নামের ভ্যাম্পায়ারের শরীর ছিল গাধার, মাথা ছিল সিংহের। গ্রিক “স্ট্রিগেস” ছিল রক্তচোষা পাখি। এমনকী ফিলিপাইনের উপকথায় “মানাংগাল” নামের যে রক্তখেকো মেয়েকে ভ্যাম্পায়ার হিসেবে দেখানো হয়, তার শরীরের উর্ধাংশে রয়েছে বিশাল বাদুড়ের পাখা। অঞ্চলভেদে সমাজের মানুষের কাছে এর গ্রহণযোগ্যতাতেও রয়েছে ভিন্নতা। কোথাও এদেরকে দেখা হয়েছে পিশাচের জীবন্ত রূপে, আবার কেউ কেউ স্বর্গীয় ও শক্তিশালী হিসেবেও দেখেছেন।
ছবি: ভ্যাম্পায়ার অফিশিয়াল
আগেই বলেছি, বর্তমানের যে ভ্যাম্পায়ারের চেহারা সবার কাছে পরিচিত, এই চেহারা এসেছে অষ্টাদশ শতাব্দীর পূর্ব ইউরোপ থেকে। তখন আচমকা ভিন্ন ভিন্ন রোগে মানুষের মৃত্যু হতো, চিকিৎসাসেবা ততোটা উন্নত ছিল না। হঠাৎ মৃত্যুর পর তাই প্রায়ই দেখা যেতো, মৃতদেহ দেখতে অনেকটাই জীবন্ত মানুষের মতো। আবার বিভিন্ন অসুখে মুখে রক্ত উঠে আসতো, ফলে মৃতদেহের ঠোঁটের কোণেও রক্তের দাগ থেকে যেতো। এভাবেই অকালমৃত, জীবন্ত মানুষের মতো চেহারা এবং ঠোঁটের কোণে রক্ত হয়ে উঠলো বিশ্বজুড়ে ভ্যাম্পায়ারের পরিচিত মুখ।
সাহিত্যের পাতায় ভ্যাম্পায়ারের চরিত্রকে রোমান্টিক ছোঁয়া এনে দেয়া হয়েছে বারবার। রক্তের প্রতি ভ্যাম্পায়ারের আকর্ষণকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে আদিম প্রবৃত্তির সাথে জীবনের সংযোগ হিসেবে। ১৮৯৭ সালে ব্রাম স্টোকারের লেখা সাড়াজাগানো উপন্যাস “ড্রাকুলা”তে, লেখক তুলে ধরেছিলেন ভ্যাম্পায়ার কাউন্ট ড্রাকুলার সাথে তার কাঙ্ক্ষিত নারী মিনা হারকারের গল্প। প্রচণ্ড ভয়ংকর হওয়া সত্ত্বেও কাউন্ট ড্রাকুলাকে দেখানো হয় একজন ট্রাজিক হিরো হিসেবে যাকে অমরত্ব দিয়েছে একাকিত্ব ও বিষণ্নতার এক বিষাক্ত জীবন।
ব্রাম স্টোকারের উপন্যাস, ড্রাকুলা (ছবি: উইকিপিডিয়া)
তবে পপ কালচারে ভ্যাম্পায়ারের চেহারায় বারবার ভয় এবং ভালোবাসা – এই দুই আলোর ছোপ পড়েছে বারবার। একদিকে অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং সুদর্শন চিরযৌবনা যুবক-যুবতীর রসায়ন তুলে ধরা হয়েছে ভ্যাম্পায়ারের গল্প হিসেবে। যেমন টোয়াইলাইট সিরিজে ভ্যাম্পায়ার এবং মানুষের ভালোবাসার গল্প ছিল মূল উপজীব্য। আবার ভয়ংকর ও বিপদজনক ভ্যাম্পায়ার কীভাবে হিংস্র আচরণ করে ক্ষতি করে মানুষের, সাধারণ মানুষের জীবনের জন্য হয়ে ওঠে হুমকিস্বরূপ – এমন ঘটনাকেও অনেকক্ষেত্রে উপস্থাপন করা হয়েছে রূপালী পর্দায়।
টোয়াইলাইট সাগার জনপ্রিয় ভ্যাম্পায়ার জুটি (ছবি: ফ্যানপপ)
সময়ের পরিবর্তনে এই ভ্যাম্পায়ারদের উপস্থাপনে যুক্ত হচ্ছে সেখানে আসছে নতুন নতুন মাত্রা। আধুনিক সময়ের টিভি, ওয়েব সিরিজ বা চলচ্চিত্রের পর্দায় যে ভ্যাম্পায়ারকে দেখানো হয় তাদের জীবনে অনেক বেশি জটিলতা। আগেকার দিনে যেমন শুধু ভালো বা মন্দ হিসেব করে মোটা দাগে পৃথক করা যেতো, সেখানে এখন দেখা যায় মানুষের সাথে মিশে টিকে থাকতে ভ্যাম্পায়ারদের সংগ্রাম। কোনো কোনো গল্পে দেখা যায় ভ্যাম্পায়াররা পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে বাধ্য হয় মানুষের রক্ত খেতে এবং প্রতিমুহূর্তে তারা লড়াই করতে থাকে তাদের নিজস্ব নৈতিকতা ও বিবেকের বিরুদ্ধে। তবে নির্মম ও বর্বর ভ্যাম্পায়ারের গল্পও হাওয়ায় মিলিয়ে যায়নি এখনো, তবে যুক্ত হয়েছে বৈচিত্র্য।
সব মিলিয়ে ছেলেবেলার ঠাকুরমার ঝুলির “কখনো মজার, কখনোবা ভয়” এর মতো করে যুগ যুগ ধরে মানুষের মুখে চলে আসছে ভ্যাম্পায়ারের গল্প। কতোটা ভয়ংকর, কতোটাই বা রোমান্টিক – তা নির্ভর করে প্রকাশের ওপর। ব্যক্তি, সমাজ ও সময়ভেদে ভিন্ন রকম উপস্থাপনায় ভয় বা ভালোবাসা যেটার প্রতীকই হোক না কেন, এর রোমাঞ্চকর গল্পে মানুষ যে অনাগত দিনেও বারবার ডুব দেবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
সিরাজুল আরিফিন বর্তমানে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলোজিতে কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগে অধ্যয়নরত।