শরীরের জন্য অত্যাবশ্যকীয় একটি ভিটামিন হলো ভিটামিন বি ১২। শরীর স্বয়ংক্রিয়ভাবে এটি তৈরি করতে পারেনা। তাই খাবারের মাধ্যমেই শরীরে এটি নিতে হয়। স্নায়ুতন্ত্রের সুরক্ষায় এর রয়েছে বিশেষ ভূমিকা। তাই কোনোভাবেই উচিত নয় শরীরে এর কোনো ঘাটতি হতে দেয়া। কিছু খাবার আছে যাখাদ্যতালিকায় রাখলে খুব সহজেই পেয়ে যাওয়া যায় ভিটামিন বি ১২।
এই ভিটামিনটি ভিটামিন বি এর আটটি প্রকারের মধ্যে একটি। বি ১২ এর কিছু সুনির্দিষ্ট কাজ আছে। বিশেষজ্ঞ ডায়েটিশিয়ান নিকোলা লুডহামর্যাইন - এর মতে, ভিটামিন বি ১২ শরীরে গৃহীত খাবার থেকে শক্তি উৎপন্ন করতে সাহায্য করে, স্নায়ুতন্ত্রকে সুস্থ রাখে ও লোহিত রক্ত কণিকা তৈরিতে সহায়তা করে যার মাধ্যমে সমগ্র দেহে অক্সিজেন প্রবাহিত হয়।
ব্রিটেনের জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট এর মতানুসারে, ভিটামিন বি ১২ এর অভাবজনিত কিছু লক্ষ্মণ আছে। যেমন- চামড়ায় ফ্যাকাশে হলদেটে ছাপ, শুষ্ক লাল জিহবা, অবসন্নতা, বিষণ্ণতা, দৃষ্টিশক্তি হ্রাস, মুখের আলসার ও ঘা।
লুডলামের মতে, 'যাদের পাকস্থলীর কিছু অংশ বা সম্পূর্ণটাই বাদ দিতে হয়েছে (অপারেশনের কারণে), তাদের ভিটামিন বি ১২ এর ঘাটতি হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি। উদাহরণস্বরূপঃ যারা ব্যারিয়াটিক সার্জারি, যেমন: গ্যাস্ট্রিক বাইপাস বা স্লিভ গ্যাসট্রেকটোমির ভেতর দিয়ে গেছেন। ''
এর কারণ জানাতে তিনি বলেন, "এর কারণ হলো পাকস্থলিতে 'ইনট্রিনসিক ফ্যাক্টর' বলে এমন একটা ব্যাপার ঘটে যা এটি শোষণে সাহায্য করে। যারা শাকাশি কিংবা শুধু শাকাহার করেন, তারাও ভিটামিন বি ১২ এর স্বল্পতায় ভুগতে পারেন। কারণ, এটি প্রাকৃতিকভাবে মূলত মাংস ও মাছেই পাওয়া যায়; তবে পাওয়া যায় দুগ্ধজাত দ্রব্য ও ডিমেও।"
যদিও ঘাটতির ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের বি ১২ প্রাপ্তি নিশ্চিত করা দরকার, তবে এর পাশাপাশি ভিটামিন বি ১২ এর উৎসগুলো সম্পর্কে সবারই জানা থাকা প্রয়োজন, যাতে করে তাদের খাবারে এর উপস্থিতি থাকে। ভিটামিন বি ১২ পানিতে দ্রাব্য হওয়ায় ব্রিটেনের জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট এর দৈনিক নিউট্রিয়েন্ট রেফারেন্স ভ্যালু (এনআরভি) ঠিক করেছে ২.৪ মাইক্রোগ্রাম যা সকল পুরুষ ও গর্ভবতী কিংবা বাচ্চাকে দুধ খাওয়াচ্ছেন এমন মা ছাড়া সকল নারীর জন্যও প্রযোজ্য।
তাহলে কোন কোন খাবারে আমরা পাবো পর্যাপ্ত ভিটামিন বি ১২? চলুন, দেখে নেয়া যাক।
গরুর মাংসের স্টেক
গরুর মাংস অনেকেই এড়িয়ে যান নানান ক্ষতির কথা ভেবে। তবে নিয়ন্ত্রিতভাবে খেলে এরও আছে বিভিন্ন উপকারী দিক। গরুর মাংস না খেলে ভেড়া কিংবা খাসিও হতে পারে ভিটামিন বি ১২ এর চমৎকার উৎস।
বিফ স্টেকের কথাই ধরা যাক। প্রচুর ভিটামিন ১২ আছে এতে। ১৯০ গ্রাম ওজনের একটি স্টেকে বি ১২ এর পরিমাণ ১১.২ মাইক্রোগ্রাম।
শুধু প্রোটিনেরই ভালো উৎস নয়, বরং লোহা, জিংক, সেলেনিয়াম ও অন্যান্য বি ভিটামিনগুলোরও ভালো উৎস গরুর মাংস।
প্রোটিন হাড়, পেশি ও কোষের স্বাস্থ্যরক্ষায় সার্বিকভাবে ভালো। লোহা লোহিত রক্ত কণিকা তৈরিতে দরকারি যা গোটা দেহে অক্সিজেন নিয়ে যায় ; জিংক আমাদের শরীরে নতুন কোষ তৈরিতে ও ক্ষতস্থান সারাতে ও শুকাতে ভূমিকা রাখে। সেলিনিয়াম আমাদের শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে দৃঢ় করার জন্য জরুরি।
খাবার ইস্ট
সাধারণত গুড়া বা পাউডার হিসেবে পাওয়া যায় এটি৷ ইস্টে আছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি ১২। বিশেষত যারা প্রাণিজ মাংস খাননা, মূলত শাকসবজি ও উদ্দিজ উপাদানই খেয়ে থাকেন, তাদের জন্য এটি আলাদাভাবে উপকারি ; কেননা, এটি কোনো প্রাণিজ উৎস নয়।
এটি স্যুপ ঘন করতে আদর্শ ভূমিকা রাখে, পাস্তা, সালাদ ও রিসোটোসে ব্যবহার করা যায়, এমনকি এটি যোগ করা যায় স্মুদিতেও। পরিশোধিত ও পুষ্টিমানসম্পন্ন ৫ গ্রাম ইস্টে ২.২ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন বি ১২ থাকে, যা আমাদের প্রতিদিনের চাহিদা (২.৪ মাইক্রোগ্রাম) পূরণের প্রায় কাছাকাছি। পরিশোধিত ইস্টে অন্যান্য বি ভিটামিনও থাকে, পাশাপাশি থাকে লোহা ও জিংকের মতো খনিজ উপাদানও।
দুধ
এমন না যে, শুধু দুধ আমাদের ভিটামিন বি ১২ দেয়, বরং দুগ্ধজাত দ্রব্য যেমন পনির ও দই আমাদের এই ভিটামিন সরবরাহ করে থাকে। এক কাপ ননীযুক্ত দুধে ১.১ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন বি ১২ থাকে, যা দৈনিক চাহিদার অর্ধেক পূরণ করে দিতে পারে।
ব্রিটিশ ডায়াবেটিক এসোসিয়েশনের রেজিস্ট্রার্ড ডায়েটিশিয়ান ও মুখপাত্র হেলেন বন্ড এর মতে, দুগ্ধজাত দ্রব্য যেমন- দুধ, দই ও পনির অন্যান্য পুষ্টিউপাদানও ধারণ করে। যার ভেতর অন্যতম ক্যালসিয়াম, যা আমাদের শক্ত হাড় ও দাঁত গঠণের জন্য খুবই জরুরি।
তিনি বলেন, " ক্যালসিয়াম আমাদের পেশির কার্যকারিতায় ও রক্ত জমাট বাঁধার ক্ষেত্রে খুব দরকারি। দুগ্ধজাত উপাদানে থাকা ক্যালসিয়াম দ্রুত শোষিত হয় ও অন্যান্য খাবারের তুলনায় শরীর দ্রুত ব্যবহার করতে পারে।"
বন্ড আরো যোগ করেন এতে থাকা আয়োডিনের বিষয়টি। দুগ্ধজাত দ্রব্যে থাকা আয়োডিন মৌলবিপাক শক্তি বা মেটাবলিজমকে ভালো রাখতে সহায়ক, পাশাপাশি আমাদের ত্বকের সুস্থতা ও স্নায়ুতন্ত্রের জন্যও ফলদায়ক।
ডিম
বিভিন্ন উপায়ে খাওয়া যায় ডিম।এটি শুধু আমিষেরই ভালো উৎস তা নয়, এটি ভিটামিন বি ১২ এরও অন্যতম প্রধান উৎস।
প্রকৃতপক্ষে, একটি ডিম থেকেই আমরা ১.৪ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন বি ১২ পেতে পারি যা ভিটামিন বি ১২ এর এনআরভি মানের অর্ধেকেরও বেশি। তাই সকালের নাস্তায় দুটি ডিম খেলে আমরা দৈনিক ভিটামিন বি ১২ এর চাহিদা তা থেকেই মিটিয়ে ফেলতে পারি।
ডিম অন্যান্য ভিটামিন, (যেমন ডি) ও খনিজেরও গুরুত্বপূর্ণ উৎস। যা সাহায্য করে আমাদের হাড়, দাঁত ও পেশি গঠণে। এতে আছে সেলেনিয়াম ও ক্লোরিনও- যা যকৃতের কার্যকারিতায় ও এর চর্বি দূর করতে সহায়ক।
বাজারজাতকৃত বি ১২ সমৃদ্ধ খাবার
বিভিন্ন খাবার আছে যা ভিটামিন বি সমৃদ্ধ করে বাজারে আনা হয়েছে। যেমন- সেরিয়াল (গমের দুধ বা কর্নফ্লেক্স) , স্প্রেড (জ্যাম, জেলি, নোসিলা, নিউটেলা) ও বিকল্প দুগ্ধজাত দ্রব্যসমূহ। এটি হতে পারে মাংশাসী ও শাকাশি- উভয়পক্ষের জন্যই ভিটামিন বি ১২ গ্রহণের ভালো উপায়।
আমেরিকান জার্নাল অভ ক্লিনিকাল নিউট্রিশনে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, দৈনিক ১ কাপ ফরটিফায়েড সেরিয়াল গ্রহণের ফলে (তিনটি বি ভিটামিন সমৃদ্ধ, যার ভেতর ভিটামিন বি- ও আছে) তা গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের শরীরে ভিটামিন বি এর মাত্রা মাত্র দু সপ্তাহেই উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়িয়েছে৷
ফরটিফায়েড খাবারগুলো অন্যান্য পুষ্টি উপাদান, যেমন- লোহা, ভিটামিন ডি ও ভিটামিন সি ও সরবরাহ করে, ফলে অন্যান্য স্বাস্থ্যগত উপকারিতাও মিলবে।
কলিজা ও গুর্দা
সবার কাছে হয়ত গুর্দা বা কলিজা মাংসের মতো অত প্রিয় না। তবে অনেকের কাছে খাবার খুবই প্রিয়৷ তবে এই অঙ্গ দুটো ভিটামিন বি ১২ এর অন্যতম সেরা উৎস। যেমন- ভেড়ার কলিজার মাত্র ১০০ গ্রাম নিলে সেখানে পাওয়া যায় অভাবনীয় পরিমাণ- ৮৫.৭ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন বি ১২! এটি আমাদের দৈনিক চাহিদা বা এনআরভির ৩৪ গুণ বেশি!
এই অঙ্গগুলোতে লোহার মতো উপাদানও আছে, বন্ডের মতে যা ক্লান্তি ও অবসন্নতা দূর করতে সহায়ক। তার মতে, " এই অঙ্গগুলো (কলিজা ও গুর্দা ) ভিটামিন এ-রও উৎস, যা আমাদের দৃষ্টিশক্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। "
তবে একটি বিষয়ে সতর্কতা কাম্য। গর্ভবতী নারীদের জন্য কলিজা খাওয়া ক্ষতিকর হতে পারে, কারণ এতে থাকা ভিটামিন এ হতে পারে 'ফিটাস' এর জন্য ক্ষতির কারণ।
তবে যদি আপনার কলিজা বা গুর্দা খেতে ভালো না লাগে, সেক্ষেত্রে মাংসের সাথে না দিয়ে এটিকে আলাদাভাবে ভুনা বা ঝাল দিয়ে কষিয়ে রান্না করতে পারেন। কিংবা করতে পারেন মসলাদার ঘন ঝোল। তাহলে স্বাদ বদলের সাথে সাথে খেতেও ভালো লাগবে, পেয়ে যাবেন ভিটামিনও।
মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী।