ব্রয়লার মুরগী দেশের মানুষের বড় একটি অংশের আমিষের চাহিদা পূরণের ‘সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী’ উৎস হলেও এতে ক্ষতিকর অ্যান্টিবায়োটিক ও ভারী ধাতুর উপস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ দীর্ঘদিনের। তবে সরকারের সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, ব্রয়লার মুরগি খাদ্য হিসেবে ‘নিরাপদ’, এতে জনস্বাস্থ্যেরও ‘কোনো ঝুঁকি নেই’।
সরকারে কৃষি মন্ত্রণালয়ের এ গবেষণায় বলা হয়েছে, ব্রয়লার মুরগিতে ১০ ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক ও তিনটি ভারী ধাতুর উপস্থিতি মিললেও তা মানুষের জন্য ঝুঁকির মাত্রার অনেক নিচে রয়েছে।
সচিবালয়ের তথ্য অধিদপ্তরের সম্মেলন কক্ষে বৃহস্পতিবার এ গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
কৃষিমন্ত্রী বলেন, “পোল্ট্রি মুরগিতে ক্ষতিকর পদার্থ থাকার কথা প্রচার হওয়ায় আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, ২০২০ সালে শুরু হওয়া কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবের প্রথম দিকে পুষ্টি সমৃদ্ধ ব্রয়লার মাংস খাওয়া অনেক কমে যায়। এই পরিস্থিতিতে মুরগির মাংস নিয়ে গবেষণার উদ্যোগ নেয় কৃষি মন্ত্রণালয়।”
ব্রয়লার মুরগির মাংসে, হাড়ে, কলিজা, কিডনি, ঘিলা ও মুরগির খাদ্যে কী পরিমাণ অ্যান্টিবায়োটিক ও ভারী ধাতু আছে তা নির্ণয় করতেই এ গবেষণা কার্যক্রম চালায় কৃষি মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল।
সেজন্য গত বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে ঢাকা, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও বরিশাল জেলা শহরের খামার ও বাজার থেকে এক হাজার ২০০ মুরগি ও ৩০টি খাদ্য থেকে ৩১৫টি নমুনা নেওয়া হয়।
কৃষি মন্ত্রী জানান, গবেষণায় মুরগির মাংসে এনরোফ্লাক্সাসিন, সিপ্রোফ্লক্সাসিন, নিওমাইসিন, টাইলোসিন, কলিস্টিন, এমোক্সাসিলিন এবং সালফাডায়াজিন অ্যান্টিবায়োটিক পরীক্ষার জন্য সেসব নমুনা ভারতের চেন্নাইয়ের এসজিএস ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়।
আরও তিনটি অ্যান্টিবায়োটিক ক্লোরামফেনিকল, অক্সিটেট্রাসাইক্লিন এবং ডক্সিসাইক্লিন ও তিনটি ভারী ধাতু আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম ও লেড পরীক্ষা করা হয় সাভারে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কোয়ালিটি কন্ট্রোল ল্যাবরেটরিতে।
গবেষণার ফলাফল তুলে ধরে প্রেস ব্রিফিংয়ে বলা হয়, ব্রয়লার মুরগির মাংসে অক্সি টেট্রাসাইক্লিনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে ৮ পিপিবি (পার্টস পার বিলিয়ন), যেখানে মানুষের সর্বোচ্চ সহনশীল মাত্রা হচ্ছে ১০০ পিপিবি।
একইভাবে আর্সেনিক উপস্থিতি রয়েছে ৬ দশমিক ২ পিপিবি, যেখানে সর্বোচ্চ সহনশীল মাত্রা হচ্ছে ৪০ পিপিবি; ক্রোমিয়ামের উপস্থিতি ১৯০ দশমিক ৭ পিপিবি, সহনশীল মাত্রা হচ্ছে ১০০০ পিপিবি। ক্ষতিকর লেডের উপস্থিতি ২৫৯ দশমিক ১ পিপিবি, যেখানে সর্বোচ্চ সহনশীল মাত্রা হচ্ছে ৬০০০পিপিবি।
কৃষি মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, দেশের অধিকাংশ মানুষের আয় কম, যা দিয়ে তারা প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার, বিশেষ করে আমিষ সমৃদ্ধ খাবার কিনে খেতে পারে না।
“ব্রয়লার মুরগির মাংসে সর্বোচ্চ সহনশীল মাত্রার অনেক কম পরিমাণ অ্যান্টিবায়োটিক ও ভারী ধাতুর উপস্থিতি রয়েছে, ফলে ব্রয়লার মাংস একটি নিরাপদ খাদ্য। জনস্বাস্থ্যের জন্যও কোনো ঝুঁকি নেই।”
<div class="paragraphs"><p>ব্রয়লার মুরগির মাংসে মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর অ্যান্টিবায়োটিক ও ভারী ধাতু নিয়ে গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হয় সচিবালয়ে।</p></div>
ব্রয়লার মুরগির মাংসে মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর অ্যান্টিবায়োটিক ও ভারী ধাতু নিয়ে গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হয় সচিবালয়ে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডা. মনিরুল ইসলাম বলেন, “ক্রোমিয়াম-৬ বা হেক্সা ক্রোমিয়াম মানবদেহের জন্য বড় সমস্যা তৈরি করে। আমাদের পোল্ট্রি খাতে এ উপাদানটি নেই।”
তিনি জানান, ৩৫দিনে যে মুরগিটি বাজারে বিক্রির উপযোগী হত, তা এখন অতিরিক্ত খাদ্য ও অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের মাধ্যমে ২৮ দিনে করা হচ্ছে। খামারিদের এ বিষয়ে আরও সচেতন করতে পারলে বিভিন্ন পর্যায়ে মুরগির মাংসে দূষণ ৯০ শতাংশ কমে যাবে।
পোল্ট্রি মুরগির খাবারে ট্যানারির বর্জ্য মেলার পুরনো অভিযোগের বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী বলেন, “আগে কিছু কিছু ছিল। এখন আর হয় না। আর ট্যানারিও হাজারিবাগ থেকে সাভারে চলে গেছে।”
পোল্ট্রিকে দেশের সম্ভাবনাময় শিল্প হিসেবে বর্ণনা করে এই খাতে প্রণোদনা দেওয়ার কথাও জানান মন্ত্রী।
“কৃষি পণ্য রপ্তানিতে ২০ শতাংশ প্রণোদনা পাওয়া যায়। কিন্তু সেই তালিকায় পশুসম্পদ ও মাছ নেই। আমি চেষ্টা করছি মুরগির মাংস রপ্তানিতে সেই প্রণোদনা দেওয়া যায় কি না।”
পোল্ট্রি খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রি সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) পরিসংখ্যান দিয়ে ব্রিফিংয়ে বলা হয়, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে ৩৮ দশমিক ৪৪ লাখ টন পোল্ট্রি মাংস উৎপাদন হয়েছে। যেখানে বাজারের চাহিদা রয়েছে ৯৫ লাখ টন।
বাংলাদেশ থেকে গত অর্থবছরে ১০০ টন পোল্ট্রি মাংস রপ্তানি হয়েছে। দেশে মোট মাংস উৎপাদন হয়েছে গত অর্থবছরে ৯২ দশমিক ৬৫ লাখ টন, যার মধ্যে গবাদী পশু থেকেই ৫৪ দশমিক ২১ লাখ টন।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী রেজাউল করিম ব্রিফিংয়ে বলেন, হাঁস-মুরগি এক সময়ে গ্রামের ঘরে ঘরে লালন-পালন করা হত। এখন তা শিল্পে পরিণত হয়েছে। মাঝে মধ্যে তা নিয়ে কিছু ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ তথ্য পরিবেশিত হচ্ছে। সঠিক তথ্য উপস্থাপনের জন্য এই গবেষণা ভূমিকা রাখবে।
মুরগির মাংসের দাম বাড়লে মন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপ কেমন হবে- এমন প্রশ্নে কৃষিমন্ত্রী জানান, ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখতে ‘ইতিবাচক’ পদক্ষেপ নেওয়া হবে সরকারের পক্ষ থেকে।
দাম বৃদ্ধির বিষয়ে বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রি সেন্ট্রাল কাউন্সিলের প্রতিনিধি মশিউর রহমান বলেন, “উৎপাদন খরচ ও মুনাফার হার বিশ্লেষণ করে একটি দর সারা বছরের জন্য নির্ধারণ করে দিতে পারে সরকার।”