Loading...
The Financial Express

ব্যবসায়ীদের কথায় বেরিয়ে এল দাম নিয়ে ‘লুকোচুরি’


ফাইল ছবি (সংগৃহীত) ফাইল ছবি (সংগৃহীত)

নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক দাম নিয়ে উৎপাদনকারী ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের মুখোমুখী আলাপে বেরিয়ে এসেছে বিভিন্ন পর্যায়ে মূল্য নির্ধারণের ফাঁকফোকর।

রোববার ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের আহ্বানে মতিঝিল ফেডারেশন ভবনে রোজার মাসকে সামনে রেখে নিত্যপণ্য বিষয়ক এ মতবিনিময় সভা হয়।

এতে মিল গেটে বেশি দাম রাখা, চালানে যে দর লেখা হয় তার চেয়ে বেশি নেওয়া, বিভিন্ন পর্যায়ে কেনা দর লুকিয়ে রাখার মত বিষয়গুলো নিজেদের বক্তব্যেই তুলে ধরেন ব্যবসায়ীরা। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।

সরকারি একটি সংস্থার এক প্রতিনিধি বাজারে মূল্য কেন কার্যকর হয় না তা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, এগুলো নিয়ে কথা বলতে গেলে অনেক ভেতরের খবর চলে আসবে।

আর এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন ডলার সংকটের বিষয়টি মাথায় রেখেই রোজার আগে শতভাগ এলসি মার্জিনের শর্ত শিথিল এবং কিছু পণ্য আমদানির পথ খুলে দেওয়ার আহ্বান জানান।

এবার মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে বাংলাদেশে রোজা শুরু হতে পারে। এ মাসে বেশ কিছু খাদ্যপণ্যের চাহিদা দেড় থেকে দ্বিগুণ বেড়ে যায়। পাশাপাশি আমদানি করা ফল ফলাদি, মসলা ও ডালের চাহিদাও বাড়ে। চাহিদা বাড়ার এ সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে প্রতি রমজানেই এক বা একাধিক পণ্যের দাম বাড়ানোর অভিযোগ পুরনো।

এদিন আসন্ন রোজায় পণ্য পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে সভায় তেল ও চিনি ব্যবসায়ীরা মূল্য নির্ধারণ নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিরোধে জড়ান। ‘সব কথা বললে’ ব্যবসা হারাতে হবে বলেও শঙ্কার কথা জানান পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী গোলাম মাওলা।

বর্তমানে সরকার নির্ধারিত চিনির সর্বোচ্চ দাম প্রতিকেজি ১০৭ থেকে ১১২ টাকার মধ্যে হলেও বাস্তবে খুচরা দোকানে ১২০ টাকার নিচে খোলা বা প্যাকেট চিনি পাওয়া যাচ্ছে না।

চিনির পাইকারি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত চিনি ব্যবসায়ী সমিতির সহসভাপতি আবুল হাশেম বলেন, সরকার যে দর নির্ধারিত করে দিয়েছে মিল থেকে সেই দরে চিনি পাওয়া যায় না। তারা রশিদও দেয় না। তাহলে আমরা কিভাবে নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি করব?

এসময় সেখানে উপস্থিত সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধি মেঘনা গ্রুপের সিনিয়র অ্যাসিসটেন্ট জেনারেল ম্যানেজার তসলিম শাহরিয়ার দাবি করেন, পাইকারি ব্যবসায়ীদের দাবি সঠিক নয়। তারা অবশ্যই ইনভয়েস দেন। সেখানে বিক্রির তথ্য উল্লেখ থাকে।

তখন ব্যবসায়ী গোলাম মাওলা বলেন, ইনভয়েস বলেন আর যাই বলেন, যেটা দেওয়া হয় সেখানে প্রকৃত দামের চেয়ে আরও কম লেখা থাকে। আরও অনেক বিষয় আছে। কাগজে যে দাম লেখা থাকে নেওয়া হয় তারচেয়েও বেশি। এসব কথা বলতে গেলে আমরা ব্যবসা করতে পারব না। আমাদেরকে আর পণ্যও দেওয়া হবে না।

এসময় এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, আপনারা এসব নাটক সিনেমা বন্ধ করেন। এক কোটি মানুষ ব্যবসা বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। মাত্র কয়েকজন লোকের জন্য পুরো ব্যবসায়ী সমাজকে অসাধু বলা হয়। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ অনিয়মগুলো করছে।

“অমুক মেমো দেয় না, তমুক মেমো দেয় না, এই কথা আমরা অনেক আগে থেকেই শুনে আসছি। টাকা নেবেন রিসিট দেবেন না এটা তো হতে পারে না। আপানারা এসব হাইড অ্যান্ড সিক ছেড়ে দেন। আপনি বলছেন মিল থেকে মেমো পান না। আবার আপনিও খুচরা ক্রেতাদের মেমো দেন না।”

এসব কেন করেন-প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ব্যবসার মতো ব্যবসা করেন। এসব নাটক সিনেমা বন্ধ করেন আপনারা। আপনি মিল থেকে যেমন দামে পান সেই অনুযায়ী একটা দাম ধরেও বিক্রি করতে পারেন। কিন্তু আপনিও তো মেমো দিচ্ছেন না।

দিনাজপুর চেম্বারের পক্ষ থেকে বলা হয়, পাইকারি বিক্রেতারা ম্যামো দেয় না। ম্যামো দিলেও সেখানে সঠিক দাম উল্লেখ থাকে না। মাঠ পর্যায়ে প্রশাসন সক্রিয়। খুচরা ব্যবসায়ীরা অনেক হয়রানি হচ্ছেন।

এসময় পাইকারি ব্যবসায়ী আবুল হাশেম বলেন, যেখান থেকে ম্যামো সৃষ্টি হয় সেখান থেকেই দেওয়া হয় না। আমরা কিভাবে দেব? উৎপাদকরা যদি মেমো দিতে না পারে, তাহলে পাইকারি পর্যায়ে মেমো পাবে না এবং খুচরা পর্যায়ে মেমো পাবে না। এভাবে হাইড করেই ব্যবসা চলছে। আমি জরিমানার ঝুঁকি নিয়েই ব্যবসা করছি।

ডলার সংকটে আমদানি কিছুটা কম থাকলেও চিনি, তেল, ছোলা, ডাল, পেঁয়াজ-রসুন, খেজুরসহ রোজার মাসে প্রয়োজন হয় এমন সবকটি পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ আছে বলে মতবিনিময় সভায় সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানান।

ট্যারিফ কমিশনের একজন প্রতিনিধি বলেন, যেই মূল্য ঘোষণা করা হয় সেটা ব্যবসায়ীরাই ঠিক করেন। আমাদের বিভিন্ন রকম প্যারামিটার আছে। ব্যবসায়ীরা ওইসব খাতে তাদের খরচের হিসাব ট্যারিফ কমিশনে জমা দেন। সূত্র অনুযায়ী তাদের তথ্যগুলো যাচাই বছাই করে আমরা দামটা ঘোষণা করি। এই মূল্য কেন কার্যকর হয় না সেটা বলতে গেলে অনেক ভেতরের খবর চলে আসবে। আমি ওইসব বলতে চাচ্ছি না।

রোজার আগে আমদানি নির্বিঘ্ন করার আহ্বান

আসন্ন রোজাকে মাসকে সামনে রেখে ডলার সংকটের কারণে বন্ধ থাকা বেশ কিছু পণ্যের আমদানি আবার চালু করার আহ্বান জানান এফবিসিসিআই সভাপতি।

কিছু বিলাস পণ্য আমদানির সুযোগ করে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, এসব পণ্যের বিপণনের সঙ্গে অনেক মানুষের জীবিকা জড়িত। সারা বছরের বেচাকেনার অর্ধেকই হয় রোজার মাসে।

“ডলার এখনও ৩২ বিলিয়নের ঘরে আছে। আমি মনে করি- সেখান থেকে ৩/৪ বিলিয়ন খরচ করলে এমন অসুবিধা হবে না। সরকার এটাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও এবিষয়ে আন্তরিক।

আমদানি নিয়ন্ত্রণ ১০০ শতাংশ এলসি মার্জিন আরোপ আর কতদিন সেই প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, রোজাকেন্দ্রিক, ঈদকেন্দ্রিক যে একটা ইকোনমি, এটা যদি আমি না দিতে পারি তাহলে ব্যবসায়ীর অবস্থাটা কী হবে?

“সারা বছর যা বেচাকেনা তার ৫০ শতাংশ রোজার মাসে। রোজা যখন চলে যাবে, ওই ব্যবসায়ীটার অবস্থাটা কী হবে। কোভিডের দুই বছরে অনেক দোকান, অনেক ব্যবসায়ী কিন্তু শেষ হয়ে গেছে। কোনো এক সময় আমরা এক বিলিয়ন ডলার দিয়ে চলছি। সেখানে এখন ৩০/৩২ বিলিয়ন থাকার পরও আমাদের কেন এলসি খুলতে দিচ্ছে না। এত চিন্তা কেন? আমার কী এক্সপোর্ট বন্ধ হয়ে গেছে? আমি মিডিয়ার মাধ্যমে অনুরোধ করছি- রোজা ও ঈদ কেন্দ্রিক ব্যবসাগুলো বন্ধ করা ঠিক হবে না।”

হুন্ডিতে ডলারের রেট ১১৫ টাকায় উঠেছে মন্তব্য করে জসিম উদ্দিন বলেন, এটা কেন হয়েছে। এলসি চালু না থাকার কারণে টাকাটা হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানো হচ্ছে। এখন উল্টাটা হবে কিন্তু? এলসি ছাড়াই কয়েক হাজার গাড়ি চলে আসছে। চকবাজারে একটি দোকান, গুলশানে একটি দোকান। সে তার মাল আনতে হবে না। কিছু টাকা ব্যাংকে দিয়ে বাকি টাকা সে হুন্ডি করে দেবে। সেজন্য আমি গভর্নর মহোদয়কে অনুরোধ করেছি।

ফল আমদানিকারক সমিতির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, রোজার মাসে ৪০ হাজার টন খেজুরের চাহিদা আছে। গত নভেম্বরে খেজুরের মৌসুমের সময়ে এলসির কিছু সমস্যা ছিল। পরে সেই সমস্যা কেটে গিয়ে খেজুর আমদানি করা গেছে। এখন আশা করছি রোজার মাসে খেজুরের কোনো সংকট হবে না। তবে ৮৫ টাকার ডলার ১০৫ টাকা হয়ে যাওয়ায় দাম গতবছরের চেয়ে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বেশি হতে পারে।

মসলা আমদানি হানিফ মিয়া বলেন, রসুনের দাম বেড়েছিল এলসি সমস্যার কারণে। কিন্তু এখন সমস্যা কেটে গেছে। রসুনের দাম শিগগির কমে যাবে। ইসলামী ব্যাংক শ্যামবাজার শাখা থেকে ভারতে কিছু মসলার এলসি করা হয়েছে শতভাগ এলসি মার্জিন দিয়ে। কিন্তু ব্যাংক আমাদের পেমেন্ট দিচ্ছে না।

একজন ছোলা ব্যবসায়ী বলেন, মিয়ানমার, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত থেকে ছোলা আসছে। ছোলার কোনো সংকট হবে না। ৮২ থেকে ৮৫ টাকার মধ্যে ছোলা খাওয়া যাবে।

বৈঠকে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এইএইচএম সফিকুজ্জামান, টিসিবির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আরিফুল হাসান, এফবিসিসিআই সহ সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু, দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন।

Share if you like

Filter By Topic