সিনেমা, কার্টুন কিংবা বাস্তব জীবন, সকল ক্ষেত্রেই মানুষের প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা এবং ভালোবেসে তাদের পোষার দৃশ্য হরহামেশাই আমাদের চোখে পড়ে।
কুকুর, বিড়াল, খরগোশ, বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বা পাখিকে পোষা প্রাণীর তালিকায় খুব সহজেই ফেলে দেওয়া যায়। কোনো প্রাণী লালন-পালন করার চিন্তা মাথায় আসলে শুরুতেই মানুষ এদের কথাই ভাবে।
কিন্তু, সেই সব প্রাণীদের নিয়ে যাদের পোষার কথা সচরাচর মাথায় আসে না তাদের বিষয়ে চলুন জেনে নেওয়া যাক টুকটাক।
গিরগিটি:
রাপুনজেল এর পোষা প্রাণীটির কথা মনে আছে? বন্ধ দুর্গের একাকী জীবনে যে ছিলো রাপুনজেল এর সঙ্গী। সেই প্রাণীটির নাম গিরগিটি।
কার্টুনে রাপুনজেল এর জন্য গিরগিটি পালন করা খুব সহজ হলেও বাস্তবে গিরিগিটিকে পোষা কিন্তু অন্য যেকোনো প্রাণীদের পোষার থেকে বেশি কঠিন। এর খাদ্যাভ্যাস, অনন্য অভ্যাস এই সবকিছু মাথায় রেখেই এটি পোষার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত।
গিরগিটি এমন একটি প্রাণী যেটি তার চারপাশের পরিবেশের রঙ অনুযায়ী নিজের শরীরের রঙ পরিবর্তন করতে সক্ষম। সরীসৃপ গোষ্ঠীর এই প্রাণীটির শরীর অমসৃণ ও কাঁটাযুক্ত। তবে মুহূর্তেই রঙ পরিবর্তন করে এর ছদ্মবেশ ধারণ করে ফেলার ক্ষমতা সবাইকে বিষ্মিত করতে সক্ষম।
পূর্বে গিরগিটিকে কেউ পোষা প্রাণীর তালিকায় না ফেললেও বর্তমান সময়ে এটি নিজের নাম সেই তালিকায় প্রবেশ করাতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্বজুড়ে গিরগিটি পোষার মাত্রা যেনো বেড়েই চলেছে।
অন্য দশটা প্রাণীর মতো একটা খাঁচায় বন্দী করে গিরগিটি পালন করা যাবে না। গিরগিটি পালন করার জন্য ছোট/বড় গাছ, লতাপাতা ইত্যাদির মাধ্যমে বন্য পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে।
খাবারের জন্য এটিকে দিতে হবে জীবিত বাগ জাতীয় পোকা যেমন কীট, কৃমি ইত্যাদি। কোনো পানির পাত্র থেকে গিরিগিটি পানি পান করবে না। সে জন্য পানিকে কুয়াশার মতো করে গাছের পাতায় ছিটিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
গিরগিটিকে জড়িয়ে ধরে নিজের বিছানায় শুয়ে থাকার কথা যদি কেউ ভেবে থাকেন তবে সেই ভাবনা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। কারণ গিরগিটি নিজের সান্নিধ্যই বেশি উপভোগ করে। যদি সেটিকে অতি সামাজিক জীবে পরিণত করার চেষ্টা করেন তবে হিতে বিপরীত-ই হবে।
হেজহগ:
শজারুর মতো দেখতে কিন্তু শজারুর থেকে আকারে ছোট এবং সারা শরীর কাঁটাযুক্ত একটি প্রাণী, নাম হেজহগ বা কাঁটাচুয়া। কিন্তু কাঁটাযুক্ত প্রাণীকে কীভাবে পোষা যায় সেটি আপনাকে ভাবনায় ফেলতেই পারে। আর সে জন্য জানতে হবে কিছু পদ্ধতি।
হেজহগ সবসময় তাদের পিঠের কাঁটাগুলো উঠিয়ে রাখে না। শান্ত হয়ে বসলে এটি পিঠের কাঁটাগুলো নিচে নামিয়ে সমান করে দেয়। তখন তাদের পিঠে হাত বোলানা যায় এবং কাঁটা থেকে নিজের হাতকেও বাঁচিয়ে রাখতে পারবেন।
হেজহগ এর শরীরের নিচের অংশে কোনো কাঁটা নেই তাই নিচ থেকে তাদের হাতে নেওয়া যায়। চেষ্টা করতে হবে কোনো হাতমোজা বা লোশন হাতে না লাগিয়ে তাদের হাতে নেয়ার। এতে করে হেজহগটিকে যে হাতে নিয়েছে তার শরীরের প্রাকৃতিক গন্ধটি চিনতে বেশি সাহায্য করবে।
হেজহগ হয়ে উঠতে পারে একজন সেরা বন্ধু। একবার কারো সাথে মিশতে পারলে সেটি অবসর সময়কে করে তুলবে আনন্দদায়ক। এর সাথে নানা ধরনের খেলাধুলাও করা যায় যা যিনি পুষছেন তিনি এবং হেজহগ উভয়ের জন্যই উপভোগ্য হতে পারে।
সুগার গ্লাইডার:
সুগার গ্লাইডার ছোট এবং লোমশ প্রাণী। এরা বেশ বুদ্ধিমান প্রকৃতির তাই ছোট ছোট কৌশলের মাধ্যমে এদের প্রশিক্ষিত করা সম্ভব।
সুগার গ্লাইডার পালন করার জন্য বড় জায়গার প্রয়োজন। কারণ এটি উড়ে বেড়াতে সক্ষম। কোনো খাঁচা বা আবদ্ধ জায়গায় এদের পালন না করাই উত্তম। পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য এবং যত্নের মাধ্যমে সহজেই সুগার গ্লাইডারকে লালন-পালন করা যায়।
এটি একটি মিশুক প্রাণী যা মানুষ এবং অন্যান্য সুগার গ্লাইডারের সাথে থাকতে পছন্দ করে। তাই অনেকেই জোড়ায় সুগার গ্লাইডার ক্রয় করেন। কেউ যদি হতাশাগ্রস্ত হয়ে থাকেন তবে আপনার মন ভালো করার জন্য সুগার গ্লাইডার হতে পারে একটি উত্তম সঙ্গী।
কিন্তু সুগার গ্লাইডারকে যেহেতু দলবদ্ধভাবে পালন করতে হয়, তাই এটি পালন করা ব্যায়বহুল হতে পারে। তাছাড়া এটি নিজের প্রজাতি ছাড়া অন্য কোনো প্রাণীর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায় না।
ট্যারেন্টুলা:
বড় পা এবং লোমশ শরীর বিশিষ্ট একটি মাকড়সা। যার আকৃতি অন্য সাধারণ মাকড়সার মতো নয়। মাকড়সাটির নাম ট্যারেন্টুলা। প্রথম নজরে দেখে ভয় পেলেও আদৌতে মাকড়সাটি তেমন কোনো ক্ষতি করে না, যদি না সেটি নিজের কোনো ক্ষতি হবে এমন আভাস পায়।
আর সেই কারণেই ট্যারেন্টুলাকে পোষা প্রাণী হিসেবে গ্রহণ করতে শুরু করেছে মানুষজন। তবে একটুখানি অসাবধানতার কারণে ট্যারেন্টুলা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারণ এর বিষদাঁত রয়েছে।
পোষা প্রাণী হিসেবে ট্যারেন্টুলাকে পালন করা তুলনামূলকভাবে সহজ। এটি দেখতে আকর্ষণীয়, কম জায়গার মধ্যে পোষ্য এবং রক্ষণাবেক্ষণ করাও সহজ।
তবে কুকুর বা বিড়ালের মতো ট্যারেন্টুলাকে নিয়ে খেলাধুলা করা, সেটিকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যাওয়া ইত্যাদি আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না। কারণ ট্যারেন্টুলা মিশুক জীব নয়।
ট্যারেন্টুলার চোখ নেই, পায়ের মাধ্যমে চারপাশ থেকে ভাইব্রেশন অনুভব করে পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা নেয়। সে জন্য এদের ধীরগতিতে চলাফেরা করতে দেখা যায়।
তাই কেউ যদি হঠাৎ করেই ওদের কাছে যেতে চান তবে ভয় পেয়ে কিছু না বুঝেই এরা দৌড়ে পালিয়ে যাবে৷ বেশি আতঙ্কিত বোধ করলে এরা কামড়াতেও পারে।
'বন্যরা বনেই সুন্দর' উক্তিটি ট্যারেন্টুলার সাথে বেশ মানানসই। প্রায় সময়ই এরা বনের এমন সব জায়গায় লুকিয়ে থাকে যাতে করে কেউ এদের ধারে কাছে না যেতে পারে।
কিন্তু পোষা প্রাণী হিসেবে এটিকে পালতে চাওয়ার চাহিদা বাড়ার কারণে বন থেকে এদের তুলে নিয়ে আসা হচ্ছে এবং চড়া দামে বিক্রি করা হচ্ছে। যে কারণে এদের এমন পরিবেশে থাকতে হচ্ছে যা তাদের অপছন্দের।
তাই কারো যদি সত্যি প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা থেকে থাকে তবে এদের বাসায় না এনে বনে কীভাবে ছেড়ে আসা যায় সেই ব্যবস্থা নেওয়াই বরং উত্তম।
ফারজানা জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন।