এবারের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পাসের হার কমার এবং শতভাগ ফেল করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ার পেছনে গতবারের চেয়ে বর্ধিত সিলেবাসকে কারণ হিসেবে মনে দেখাচ্ছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছেন, “গতবার মাত্র তিনটি বিষয়ে পরীক্ষা হয়েছে, সংক্ষিপ্তভাবে। সেখানে বেশিরভাগই ভালো করেছে। সেজন্য আমাদের পাশের হারও প্রায় ৯৫ শতাংশ ছিল। এবার যখন ১২টি পত্রে পরীক্ষা হয়েছে, তখন সবাই তত ভালো করতে পারেনি।“
“সেজন্যই যে সকল প্রতিষ্ঠানে শূন্য সংখ্যক পরীক্ষার্থী পাস করেছে, সেই ধরনের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এবার এইচএসসিতেও ৫০টি প্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থী পাস করেনি। আমরা সেগুলো দেখতে গিয়ে দেখেছি, অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই নন এমপিও ভুক্ত। অল্প কয়েকটি এমপিওভুক্ত, অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান মাদ্রাসা ছিল।“
এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় এবার পাস করেছে ৮৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। ২০২১ সালে কোভিড মহামারীর কারণে তিন বিষয়ে পরীক্ষা নিয়ে পাসের হার ছিল ৯৫ দশমিক ২৬ শতাংশ।
২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে পাসের হার কমেছে ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ পয়েন্ট; জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে ১২ হাজার ৮৮৭ জন। কেউ পাস করেনি এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্য্যা গতবার ছিল পাঁচটি, এবার তা বেড়ে ৫০টি হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে এইচএসসির ফলাফল জানাতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দীপু মনি বলেন, “আমরা বলছি শতভাগ ফেল করেছে। দেখা গেছে, অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা দিয়েছে একজন বা দুইজন। সেইখানে একজন বা দুইজন পাস করতে না পারলে সেই প্রতিষ্ঠান ‘শতভাগ ফেল করেছে’- এই তকমা গায়ে লেগে যায়।” খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
পাসের হার ও জিপিএ ফাইভ কমা এবং শূন্য পাস করা প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধির পেছনে কিছু প্রতিষ্ঠানকেও দায়ী করেন শিক্ষামন্ত্রী।
শতভাগ ফেল করা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে ওয়ার্কশপ করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, “তাদেরকে আমরা বলেছিলাম, কোন সহযোগিতা তাদের প্রয়োজন, কীভাবে তাদেরকে আমরা পাশে দাঁড়াতে পারি, যেন তাদের শিক্ষার্থীরা কৃতকার্য হতে পারে।
“তাদের কাছে আমরা গত কয়েক বছরের তথ্য চেয়েছি, আমরা যা যা চেয়েছি তারা তা পাঠিয়েছে। আমরা মার্চের প্রথম সপ্তাহে তাদেরকে নিয়ে একটি ওয়ার্কশপ করব। সেখানে দক্ষ অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠান প্রধানদের তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করার জন্য এবং কোন কোন ক্ষেত্রে কীভাবে আমরা সহযোগিতা করতে পারব সেই বিষয়গুলো দেখব।”
বুধবার সকালে সব শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানদের সঙ্গে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর হাতে ২০২২ সালের এইচএসসি পরীক্ষার ফলের সারসংক্ষেপ হাতে তুলে দেন শিক্ষামন্ত্রী। পরে বেলা সোয়া ১টায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত তুলে ধরেন তিনি।
এবার এগারোটি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ১১ লাখ ৭৭ হাজার ৩৮৭ জন শিক্ষার্থী এবার পরীক্ষায় অংশ নেয়। তাদের মধ্যে ১০ লাখ ১১ হাজার ৯৮৭ জন পাস করেছে। সার্বিক পাসের হার ৮৫.৯৫ শতাংশ ।
নয় সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৮৪.৩১ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৫৯ হাজার ৭৫৫ জন। মাদ্রাসা বোর্ডে পাসের হার ৯২.৫৬ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছে ৯ হাজার ৪২৩ জন। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৯৪.৪১ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছে ৭ হাজার ১০৪ জন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষাও সংক্ষিপ্ত সিলেবাসেই হবে কি না-সাংবাদিকদের প্রশ্নে দীপু মনি বলেন, “যে সিলাবাসে এইচএসসি বা সমমানের পরীক্ষা হয়েছে, ঠিক সেই সিলেবাসের উপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা হওয়া উচিৎ।
“আমাদের যে মতামত, ইতোমধ্যে আমরা এই কথাগুলো বলেছি। সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে এই বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেছি। বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের সঙ্গেও আমরা অতি সম্প্রতি আলাপ করেছি।”
তিনি বলেন, “সব জায়গায় পরীক্ষা কীসের উপর হয়? এসএসসিতে যে বিষয়গুলোর উপর পরীক্ষাগুলো হয়, তারই উচ্চতর পরীক্ষা এইচএসসি। সেই এইচএসসি পরীক্ষার উপর আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা হয়।
“যেহেতু এখন পর্যন্ত সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে বা পুনর্বিন্যাসকৃত সিলেবাসে হয়েছে এইচএসসি বা সমমানের পরীক্ষা, ঠিক সেই সিলাবাসে ভর্তি পরীক্ষা হওয়া উচিৎ।”
এবার ১১টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ১১ লাখ ৭৭ হাজার ৩৮৭ জন শিক্ষার্থী এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। তাদের মধ্যে ১০ লাখ ১১ হাজার ৯৮৭ জন পাস করেছে। এই শিক্ষার্থীরাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিযুদ্ধে নামবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে একটি পরীক্ষা?
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গুচ্ছ পদ্ধতিতে আনতে ১০ বছর লাগলেও মাত্র একটি পরীক্ষা নিয়ে ভর্তির জন্য সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়কে আনতে বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে না বলে আশা প্রকাশ করেছেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি।
এখন দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ পদ্ধতিতে এলেও পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এতে আসেনি। এরমধ্যেই একটি পরীক্ষা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি সম্পন্ন করার আশা করছেন দীপু মনি।
তিনি বলেন, “বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের যে পরীক্ষাগুলো হয়, সেগুলো একটা পরীক্ষা হয়। সেখানে হয় তো গণিত, বিজ্ঞান বা ভাষা এই জাতীয় বিষয়গুলো এবং সাধারণ জ্ঞানের উপর পরীক্ষাগুলো হয় এবং সেই একটি পরীক্ষা দিয়ে জাতীয় একটা তালিকা তৈরি হয় এবং তার উপর ভিত্তি করে, সেই পরীক্ষার যে স্কোর, সেই স্কোরের ভিত্তিতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়।”
এতে ইংরেজি মাধ্যমে যারা পড়ছে, তাদেরও ভর্তির সুযোগ হওয়ার কথা বলেন শিক্ষামন্ত্রী।
তিনি বলেন, “এই ইংরেজি মাধ্যম যখন শুরু হয়েছিল, তখন শুধু উচ্চবিত্তরা পড়ত। এখন কিন্তু মধ্যবিত্তরা, নিম্ন মধ্যবিত্ত সন্তানেরাও এখানে পড়ে। কিন্তু তারা এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগই পায় না, যেহেতেু সিলেবাসটা অন্য রকম। তাদেরও এখানে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ থাকা উচিৎ। আর সবচেয়ে বড় কথা হল, একই জিনিস বার বার হওয়ার কোনো যৌক্তিকতা দেখি না।”
ভর্তি পরীক্ষাকে এমন ধারায় আনতে কত সময় লাগতে পারে- এ প্রশ্নের জবাবে দীপু মনি বলেন, “গুচ্ছ পদ্ধতিতে যেতে আনেক দিন লেগেছে। কারণ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক স্টেক হোল্ডার আছেন, আবার কিছু বিশ্ববিদ্যালয় আবার পুরোপুরি স্বায়ত্তশাসিত। এই ব্যবস্থাটা প্রয়োগ করতেও সময় লেগেছে।
“কিন্তু যদি একটি পরীক্ষাতে যেতে হয়, সেটি আমরা হয়তবা আরও অনেক কম সময় …. আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে কথা বলে তাদের কাছ থেকে যে ধরনের মতামত পেয়েছি, আমাদের কাছে মনে হয় আরও কম সময় লাগবে। আশা করি সেই পরীক্ষাতে সকলেই আসবেন।”
শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কারিগরি শিক্ষায় আগ্রহী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, “একটা দেশে কত লোক আসলে অনার্স-মাস্টার্স করবে, এটাও আমাদের ভাবতে হবে। উচ্চশিক্ষা কি সবাই করবেন? নিশ্চয়ই উচ্চ মাধ্যমিকের পরে আরও কিছু পড়তে চাইবেন।
“সবচেয়ে বড় কথা হল, আমি কর্ম জগতে প্রবেশ করব। সেই কর্ম জগতে প্রবেশ করার জন্য আমি কী কী করতে পারি। যেখানে যত বেশি দেশ উন্নত সেখানে তত বেশি কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষার্থীরা যায়। আমাদের এখানে একটা মাইন্ড সেট আছে, সেখানে যায় না। এখন অবশ্য ১৭ ভাগের বেশি হয়েছে।”