বর্জ্য প্লাস্টিক বিনিময়ে বাজার-সদাই, বিদ্যানন্দের ভিন্ন উদ্যোগে বানানো হলো ‘বর্জ্যদানব’


আসরিফা সুলতানা রিয়া | Published: December 17, 2022 13:03:24 | Updated: December 17, 2022 19:37:43


ছবি: বিদ্যানন্দের ফেসবুক পেজ থেকে

‘মেয়ে'রে মুরগি খাওয়াতে পারি না, কুরবানেও না। বৌ নিয়ে তাই দৌড়াইলাম অনেকক্ষণ, বীচের পাশে যত প্লাস্টিক ছিলো সব নিয়ে আসছি। ১৫০-২০০ বোতল দিয়েই মুরগি পাইছি, সাথে চাল-ডাল। ময়লার দাম জীবনে কোনোদিন বুঝি নাই। আজ এটাতে আমার মেয়ের গোস্ত দিয়ে খাওন হবে - এক অসহায় বাবার আত্নতৃপ্তিতে যেন পূর্ণতা পেল বিদ্যানন্দের প্লাস্টিক বর্জ্যের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচী। 

ক্ষুধার রাক্ষসকে হার মানাতে কিংবা ছিন্নমূল হতদরিদ্র মানুষের মাথার ওপরে ছাদ হয়ে দাঁড়ানোর পরিচয়ে বিদ্যানন্দ আজ সবার মুখে মুখে। প্রান্তিক মানুষদের সুখের কান্নার স্বাক্ষী হতে কখনো এক টাকায় আহার, কখনো বা ফুড ভ্যান পার্কের বেশে অলাভজনক এই প্রতিষ্ঠানটি পৌঁছে যায় শহর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের দ্বারে দ্বারে। এ যেন রবীন্দ্রনাথের সংকীর্ণ বাতায়নের বেড়াজাল ডিঙিয়ে ও পাড়ার প্রাঙ্গনের ভিতরে প্রবেশ করার ব্যর্থতাকে জয় করার শামিল। 

সম্প্রতি কক্সবাজারের প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনে প্লাস্টিক বর্জ্যের বিনিময়ে চাল, ডাল, তেল, চিনির মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী বিতরণের অভিনব উদ্যোগ নিয়েছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। দ্বীপের মধ্যভাগে গলাচিপা এলাকায় খোলা হয়েছে ‘প্লাস্টিক এক্সচেঞ্জ স্টোরনামে দোকান। 

যেখানে ১ কেজি ওজনের প্লাস্টিক বর্জ্য জমা দিলে পাওয়া যাচ্ছে ১ কেজি চাল/সুজি/ বুটের ডাল কিংবা ২ প্যাকেট নুডলস বা গোটা দশেক ডিম। ২ কেজি প্লাস্টিক বর্জ্যের বিনিময়ে মিলছে ১ কেজি আটা। ৩ কেজি প্লাস্টিক বর্জ্য জমার বিনিময়ে ১ কেজি মসুর ডাল, ৫ কেজি প্লাস্টিক বর্জ্যের বিনিময়ে ১ লিটার সয়াবিন তেল বা ১টি মুরগি এবং ৬ কেজি প্লাস্টিক বর্জ্যের বিনিময়ে পাওয়া যাচ্ছে লুঙ্গি।

বঙ্গোপসাগরের ৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে থাকা এ দ্বীপের বাসিন্দার সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১০ হাজার। পর্যটন মৌসুমে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পায় কয়েক হাজার। প্রতিদিন জমা হতে থাকে প্লাস্টিকের বোতল, চিপস-বিস্কুটের প্যাকেট, পলিথিন ব্যাগসহ নানা বর্জ্য। যার ফলে দ্বীপের মোহনীয় সৌন্দর্য যেমন ম্লান হয়েছে, জীব-বৈচিত্র্যও পড়েছে বিপর্যয়ের মুখে।  

এমন দৃশ্য উপলব্ধি করে সচেতন নাগরিকদের মতো বিদ্যানন্দের বুক কেঁপে ওঠে। নভেম্বর মাসেই এক দফা কর্মসূচী হাতে নেয় অল্প সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবকের হাত ধরে সেন্ট মার্টিনকে রক্ষা করার অভিপ্রায়ে। সারাদিন এখানে সেখানে ছুটে বেড়িয়ে হাত ভর্তি প্লাস্টিক কুড়িয়েও সন্তুষ্ট হতে পারেনি বিদ্যানন্দ। প্লাস্টিকের সাম্রাজ্য ভাঙতে প্রয়োজন পড়ে আরও হাতের। তখন দ্বীপের মানুষদের সম্পৃক্ত করতে প্লাস্টিকের বিনিময়ে শামুক-ঝিনুকের মালা, বই, শোপিস, ব্যাগ ইত্যাদি উপহার দিয়ে আহবান জানায় তারা। 

তারপর গত মঙ্গলবার (১৩ ডিসেম্বর) পূর্ণ উদ্যমে ১০-১২ জন স্বেচ্ছাসেবকের সহায়তায় তৈরি করা প্লাস্টিক এক্সচেঞ্জ স্টোরের মাধ্যমে দ্বীপের ছিন্নমূল মানুষদের খাদ্যদ্রব্য বিনিময়ের মাধ্যমে প্লাস্টিক বর্জ্যমুক্ত সেন্ট মার্টিন দেখার কর্মসূচী গ্রহণ করে বিদ্যানন্দ। 

এতে করে প্রতিদিন কুড়িয়ে নিচ্ছে-

আমাদের সামনে আস্ত রোস্ট কিংবা কাবাব পর্যটকদের কাছে বিক্রি হয় দেদারসে। আমরা দ্বীপের মানুষ শুধু তো দেখেই যাই, দামের জন্য মুরগির মাংসের স্বাদ নিতাম পারি না

কিংবা ‘প্লাস্টিক দিয়ে মুরগি কিনছি! কতদিন মাংস খাই না, দুই ঈদেও গন্ধ বাদে স্বাদ পাই নাই। আজ সাগর পাড়ের ময়লার উছিলায় মাংস খাইতে পারুম- এর মতো অমূল্য সুখস্মৃতির।   

সেন্ট মার্টিনে যে এত প্লাস্টিক লুকিয়ে ছিল তা জানা ছিল না দ্বীপবাসীদেরও। আবর্জনা সংগ্রহের এ আয়োজন তাদের মধ্যে এত সাড়া ফেলেছে যে বাড়ি থেকেও অব্যবহার্য প্লাস্টিকের জিনিসপত্র খুঁজে আনছে। যা দেখে বিস্মিত বিদ্যানন্দও। এসব প্লাস্টিক যাতে মাটিতে মিশে জীবনের হুমকি না হয় এবং পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করা যায় সে প্রস্তুতি ইতোমধ্যে নিয়েছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি। 

কর্মসূচীর প্রথম দিনে ৪০০ জন মানুষের থেকে সংগৃহীত ৪ মেট্রিক টনের অধিক প্লাস্টিক বর্জ্য কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে সুগন্ধা পয়েন্টের বালিয়াড়িতে তৈরি করা হয়েছে বিশালাকার প্লাস্টিক দানব। এর আগে গত বছরে সেন্ট মার্টিনে পরিত্যক্ত প্লাস্টিক দিয়ে মাছের ভাষ্কর্য তৈরি করেছিল শের-ই বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগ। এবার সমুদ্রে প্লাস্টিক দূষণ রোধে জনসচেতনতা তৈরি করতে উদ্যোগ নিয়েছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। প্রদর্শনীর পর প্লাস্টিকগুলো পুনরায় ব্যবহারের জন্য পাঠানো হবে প্লাস্টিক প্রক্রিয়াকরণ সেন্টারে। 

সংশ্লিষ্টদের তথ্য অনুযায়ী, বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন ও জেলা প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে এবং টুরিস্ট পুলিশের সহযোগিতায় বাস্তবায়িত হচ্ছে এই প্লাস্টিক দানবটি। এটি তৈরিতে গত ৭ দিন ধরে কাজ করছেন ১৬ জন স্বেচ্ছাসেবক। 

ছবি: বিদ্যানন্দের ফেসবুক পেজ থেকে

প্লাস্টিকের দানব তৈরির মূল পরিকল্পনাকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সাবেক শিক্ষার্থী আবির কর্মকার। প্লাস্টিক দানবটি তৈরি করতে ইতোমধ্যে ২০ বস্তা পরিত্যক্ত প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়েছে। এর উচ্চতা ৩৮ ফুট ও প্রস্থ ১৪ ফুট। আবির, শুভ্র বাড়ৈ, নির্জর, সাব্বির, বিদ্যানন্দের ৮ জন স্বেচ্ছাসেবক ও ৪ জন কাঠমিস্ত্রি নিয়ে এই প্লাস্টিক দানবটি তৈরি করা হয়েছে। সেন্ট মার্টিনে প্লাস্টিক যেভাবে দানবের মতো সবকিছু গ্রাস করার সচেতনতার বার্তা পৌঁছে দেয়াই স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে তৈরি এ দানবের উদ্দেশ্য।  

 

আসরিফা সুলতানা রিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। 

asrifasultanareya@gmail.com 

Share if you like